সিলেটে আন্দোলনের ‘কেন্দ্রবিন্দু’ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ: শিক্ষার্থীদের ফুল হাতে শুভেচ্ছা by ওয়েছ খছরু

হাতে হাতে লাল গোলাপ ফুল। যারাই আসছেন, ফুল দিয়ে তাদের বরণ করা হচ্ছে। এমন দৃশ্যের কারণে গতকাল দিনভর আলোচনায় ছিল সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখস্থল। কোটা সংস্কার দাবিতে আন্দোলরত শিক্ষার্থীদের এমন আচরণে কেউ-ই তাদের ওপর ক্ষুব্ধ হতে পারেননি। বরং হাসিমুখে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন অনেকেই। গতকাল দুপুরের পর সিলেটের সব আন্দোলনের স্রোত এসে মিলিত হয় চৌহাট্টাস্থ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী শহীদ মিনারের সামনের রাস্তায় জড়ো হয়ে দিনভর বিক্ষোভ করেন। তাদের বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধের কারণে সিলেট নগরীর অর্ধেক এলাকা পরিণত হয়েছিল অবরুদ্ধ নগরীতে। ঝড়ো বাতাস, বর্ষণ ও বজ্রপাত কোনো কিছুই থামাতে পারেনি আন্দোলন। বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও এক মুহূর্তের জন্য তারা ছেড়ে যায়নি সিলেটের রাজপথ। সকাল তখন ৭টা। প্রথমেই ক্ষোভ শুরু হয় সিলেটের শাহ্‌জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে। শতাধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন হল থেকে মিছিল সহকারে আসতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটকে। এ সময় তারা ফটকের সামনে অবরোধ সৃষ্টি করে বিক্ষোভ করতে থাকে। বিশেষ করে তারা কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের সমালোচনা করে স্লোগান দেন। এবং অবিলম্বে তাদের দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। সকাল সাড়ে ১০ টার মধ্যে হাজারো শিক্ষার্থীর অবস্থানের কারণে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কেও যানবাহন চলাচল কমে আসে। ওদিকে- সকাল ১০টার একটু পরেই সিলেট নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে জড়ো হতে থাকে শিক্ষার্থীরা। প্রথমে সিলেট মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, নর্থইস্ট ইউনিভার্সিটি ও লিডিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এসে শহীদ মিনারের সামনে জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়কে এসে অবস্থান করেন। তাদের অবস্থানের কারণে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল কমে আসে। এক সময় ওই সড়কে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়ে। বেলা ১১ টার দিকে চৌহাট্টায় এসে আন্দোলনে যোগ দেন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রীরা। এরপর থেকে সিলেটে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম স্থান হয়ে ওঠে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। সকাল থেকে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ওসমানী মেডিকেল কলেজ সহ সিলেটের প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাঙ্গনে বিক্ষোভ চলছিল। ধীরে ধীরে ক্যাম্পাস ছেড়ে ওই সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল সহকারী চলে আসেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে চৌহাট্টা এলাকা। দুপুর ১২ টা খণ্ড খণ্ড মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় সিলেট। এতে করে নগরীর প্রায় রাস্তায় তীব্র যানজট শুরু হয়। দুপুরের পর বদলে যায় সিলেটের প্রকৃতি। হঠাৎ করে কালো মেঘে ঢাকা পড়ে গোটা সিলেট নগরী। সেই সঙ্গে ঝড়োবাতাস। কিন্তু দমেনি শিক্ষার্থীরা। তারা রাজপথ ছেড়ে যায়নি। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই সিলেটের চৌহাট্টায় চলতে থাকে বিক্ষোভ। এদিকে- চৌহাট্টায় অবরোধের কারণে জিন্দাবাজার-আম্বরখানা, নয়াসড়ক-রিকাবীবাজার সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এ কারণে যানজটে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে সিলেটের অর্ধেক নগরী। দুপুরে শাবি ফটকে থাকা শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নেন- তারাও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় আসবে। অন্তত ৩ হাজার শিক্ষার্থী বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস উপেক্ষা করে মিছিল নিয়ে চৌহাট্টার অভিমুখে রওনা দেন। তারা মদিনা মার্কেট, সুবিদবাজার, মীরের ময়দান হয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার এলাকা পাড়ি দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে পৌঁছান। এ সময় ওখানে থাকা  আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তাদের বরণ করে নেন। এরপর থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করেই সিলেটের কোটা সংস্কার আন্দোলন চলে। সিলেটের এই বিক্ষোভস্থলে প্রায় সবার মুখেই ছিল বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা স্লোগান। ওদিকে- সকাল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান করছিলো পুলিশ সদস্যরা। তারা নীরবতা পালন করায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দুপুরে আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে যান সিলেট মহানগর পুলিশের ডিসি ফয়সল মাহমুদসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। পুলিশকে শিক্ষার্থীরা জানায়- তারা কোনো বিশৃঙ্খলতা করবে না। কোটা সংস্কার করার দাবি ক্রমেই দেশের মানুষের দাবিতে পরিণত হয়েছে। পুলিশের কাছে এ ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন তারা। এর একটু আগে ওই এলাকা নিজ কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন সিলেট জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট লুৎফুর রহমান। এ সময় ছাত্ররা তাকে ঘিরে ধরলে তিনি জানান- এই আন্দোলনের সঙ্গে তার একাত্মতা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের হাতে গোলাপফুল তুলে দেন। এবং একটি সাদা কাগজ ধরিয়ে দেন। আর ওই কাগজে এডভোকেট লুৎফুর রহমান নিজের সম্পৃক্ততার কথা জানান দিয়ে লিখেন- ‘সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতিতে নিয়োগ সমর্থন করি না।’ বিকাল পর্যন্ত কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর অবস্থান ছিল সিলেটের চৌহাট্টা এলাকায়। কোটা সংস্কার কমিটি সিলেটের আহ্বায়ক মো. নাসির উদ্দিন জানিয়েছেন- তাদের দাবি যৌক্তিক। এ দাবি পুরোপুরি মেনে নিতে হবে। একই সঙ্গে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। তবেই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে বলে জানান তিনি। 
ছাত্রলীগ যেন কোনো ভুল না করে- জাফর ইকবাল: শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেছেন- যখন সরকার কোনো কিছুর সম্মুখীন হয়, তখন সরকারের পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রলীগও এসে পড়ে।  ছাত্রলীগ যারা করে তারাও তো ছাত্র, তারা পড়াশোনা করবে।  তারা যেন কোনো ভুল না করে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেন কোনো সংঘাত সৃষ্টি না হয়। বুধবার সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া আইআইসিটি ভবনে সাংবাদিকদের সারা দেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। তিনি আরো বলেন, তরুণ প্রজন্মের উপর আমার আস্থা রয়েছে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে তরুণরা নেতৃত্ব দিয়েছে। আমি আশা করব তারা যেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি আরো বলেন, ৫৬ শতাংশ কোটা সে হিসেবে অনেক বেশি।  একসময় হয়তো এটার প্রয়োজন ছিল,  তবে তা এখন একটা সঙ্গত সংখ্যায় নামিয়ে আনা দরকার। কোটা সংস্কারের কথা বলে প্রচ্ছন্নভাবে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে কথা বলছে। এ সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যেন কোনোভাবেই অশ্রদ্ধা না হয় সেইদিকে খেয়াল রাখার আহ্বান জানান।

No comments

Powered by Blogger.