আসিফা ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড: ফের উত্তাল কাশ্মীর by সামির ইয়াসির

জানুয়ারি মাসের ১৭ তারিখের সকাল। মোহাম্মদ ইউসুফ পুজওয়ালা বসে আছেন ঘরের বাইরে। হঠাৎ এক প্রতিবেশী দৌঁড়ে তার কাছে এল। তিনি ইউসুফের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, তার ৮ বছর বয়সী মেয়ে আসিফা বানুকে পাওয়া গেছে। মাত্র কয়েকশ’ মিটার দূরে আসিফার মৃতদেহ ঝোঁপের মধ্যে পড়ে ছিল। সেদিনের কথা স্মরণ করে ইউসুফ বলেন, ‘আমি জানতাম আমার মেয়ের সঙ্গে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটেছে।’ ইউসুফের স্ত্রী নাসিমা বিবি তার পাশেই বসে আছেন। বারবার কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। মুখ দিয়ে কেবল গোঙানি বের হচ্ছে: ‘আসিফা’।
ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের গুজার গোত্রের বাসিন্দা ইউসুফ। এই মুসলিম সম্প্রদায় মূলত যাযাবর। ভেড়া, ছাগল ও ষাড় পালন করে। ছোট্ট আসিফার ঘটনা এই ছোট সম্প্রদায়কে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। এই একটি ঘটনায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর উপত্যকার মধ্যে বিভেদের বিষয়টি বের হয়ে আসে। কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের রেষারেষি সম্পর্ক। ১৯৮৯ সাল থেকে সেখানে ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ জারি আছে।
আসিফার মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ৮ জন পুরুষকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, চার জন পুলিশ কর্মকর্তা ও এক কিশোর। তবে এদেরকে আটকের ঘটনায় জম্মুতে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। জম্মুর আদালতে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করতে গেলে সেখানকার আইনজীবীদের বাধায় ব্যর্থ হন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি’র দুই জন মন্ত্রী অভিযুক্তদের পক্ষে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। কাশ্মীরে আঞ্চলিক দল পিপল’স ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে জোট বেধে ক্ষমতায় আছে বিজেপি।
আসিফার অন্তর্ধান
১০শে জানুয়ারি আসিফা যখন নিখোঁজ হলেন, তখন তার যাযাবর পরিবার বসবাস করছিলেন জম্মু শহর থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরের একটি গ্রামে। তার মা বলেন, সেদিন বিকেলে গৃহপালিত ঘোড়াগুলো ঘরে নিয়ে আসতে বনের দিকে গিয়েছিল আসিফা। ওই ঘোড়াগুলো বাড়ি ফিরেছে ঠিকই, আসিফা ফেরেনি।
নাসিমা বিবি বিষয়টি তার স্বামীকে জানান। ইউসুফ ও কিছু প্রতিবেশী আসিফাকে খুঁজতে বের হন। তাদের হাতে ছিল ফ্ল্যাশ লাইট, হারিকেন ও কুঠার। তারা খুঁজতে খুঁজতে বনের ভেতরে ঢুকে পড়েন।  কিন্তু রাতভর খুঁজেও আসিফাকে পাননি। দুই দিন পর ১২ই জানুয়ারি, তারা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু ইউসুফ বলেন, পুলিশ তাদেরকে তেমন সহযোগিতা করেনি। তার অভিযোগ, এক পুলিশ কর্মকর্তা বরং পালটা এই কথাও বলেন যে, আসিফা নিশ্চয়ই কোনো এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।
আসিফার অন্তর্ধানের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে, গুজার সম্প্রদায় প্রতিবাদ ডাকে। অবরোধ করে মহাসড়ক। তখনই পুলিশ বাধ্য হয়ে দুই কর্মকর্তাকে তদন্তে নিয়োগ দেয়। কিন্তু এই দুই পুলিশ কর্মকর্তার একজনকেই খোদ পরে এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়। ওই পুলিশ সদস্যের নাম দীপক খাজুরিয়া।
পাঁচদিন বাদে আসিফার লাশ পাওয়া যায়। লাশ পাওয়ার খবর পেয়েই স্বামীর সঙ্গে দৌঁড়ে বনের দিকে যান নাসিমা। তিনি বলেন, ‘আসিফাকে নির্যাতন করা হয়েছে। তার পা ভাঙ্গা ছিল। তার নখ কালো হয়ে ছিল। তার বাহু আর আঙ্গুলে নীল আর লাল ছোপ ছোপ দাগ ছিল।’
তদন্তকারীরা কী মনে করেন?
২৩শে জানুয়ারি, অর্থাৎ আসিফার লাশ উদ্ধারের ছয় দিন পর, জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি রাজ্য পুলিশের বিশেষ ইউনিটকে এই ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দেন। তদন্তকারীরা বলছেন, আসিফাকে বেশ কয়েকদিন স্থানীয় একটি মন্দীরে বন্দী রাখা হয়। তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে অচেতন করে রাখা হয়। চার্জশিটে বলা হয়, আসিফাকে ‘কয়েক দিন ধরে ধর্ষণ, নির্যাতন করে শেষ অবদি হত্যা করা হয়।’ তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পরে তার মাথায় পাথর দিয়ে দু’বার আঘাত করা হয়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সঞ্জি রাম নামে ৬০ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারী কর্মকর্তা পরিকল্পনা করে এই কাজ করেন। তাকে সহায়তা করেন সুরেন্দ্র ভার্মা, আনন্দ দত্ত, তিলক রাজ ও খাজুরিয়া নামে চার পুলিশ কর্মকর্তা। সঞ্জি রাম ছাড়াও তার ছেলে বিশাল, তার ভাতষ্পুত্র ও তার বন্ধু পরবেশ কুমারের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরেক ধরণের। খাজুরিয়া সহ চার পুলিশ কর্মকর্তা আসিফার রক্তাক্ত লাশ ও কর্দমাক্ত কাপড় পরা অবস্থায় পেলেও, তা ধুয়ে মুছে তারপর ময়নাতদন্তের জন্য পাঠান। তদন্তকারীদের ধারণা, অভিযুক্তরা গুজার সম্প্রদায়কে জম্মু ছাড়তে বাধ্য করতেই এই অপরাধ সংঘটন করেন। যাযাবর এই সম্প্রদায় পশুপালনের কাজে জম্মুর সরকারী ও বনের জমি ব্যবহার করেন। এ নিয়ে সম্প্রতি ওই অঞ্চলের কিছু হিন্দু বাসিন্দার সঙ্গে তাদের বিরোধ হয়েছে।
উপজাতি অধিকার কর্মী ও আইনজীবী তালিব হোসেন বলেন, ‘বিষয়টা ছিল জমি সংক্রান্ত।’ আসিফার পরিবারের সমর্থনে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তালিব। তার ভাষ্য, প্রতিবাদ আয়োজন করায় তাকে গ্রেপ্তার করে হুমকি দিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। তবে অভিযুক্তদের পক্ষে প্রতিবাদকারী অন্যতম আইনজীবী অঙ্কুর শর্মা বলেন, জম্মুর জনতাত্বিক ভারসাম্য পরিবর্তন করতে চায় গুজার সম্প্রদায়। তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের বন ও পানি সম্পদ দখল করছে।’ তিনি আরও বলেন, অভিযুক্তদের এই মামলায় সাজানো হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীরা এখনও আড়ালে।
জম্মুতে বিষয়টি অত প্রচার না পেলেও, কাশ্মীর উপত্যাকার রাজধানী শ্রীনগরের পত্রপত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য বিধানসভায়, প্রভাবশালী গুজার নেতা ও বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতা মিঁয়া আলতাফ পত্রিকা নিয়ে এসে তদন্তের দাবি জানান। অপরদিকে বিজেপি আইনপ্রণেতা রাজিব জাসরটিয়া বলেন, এই ঘটনা ‘পারিবারিক বিষয়।’ তিনি এই অপরাধ নিয়ে রাজনীতি করার অভিযোগ তোলেন আলতাফের বিরুদ্ধে।
আসিফার দাফন নিয়েও জটিলতা
গুজার সম্প্রদায় চেয়েছিল আসিফাকে একটি কবরস্থানে দাফন করতে। কয়েক বছর আগে এই জমি তারা কিনে নেন। ইতিমধ্যে ৫ জনকে তারা সেখানে সমাহিতও করেছেন। কিন্তু আসিফাকে দাফন করতে এলে, তাদেরকে চারপাশে ঘিরে ফেলে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা। তারা ইউসুফকে হুমকি দেন, আসিফকে সেখানে দাফন করা হলে সহিংসতা হবে।
ইউসুফ বলেন, ‘পরে তাকে সমাহিত করতে আমরা সাত মেইল হেটে আরেক গ্রামে যাই।’ ইউসুফের দুই মেয়ে ছিল, যারা কয়েক বছর আগে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। আসিফা তার আপন মেয়ে নয়। স্ত্রীর জোরাজুরিতে তিনি তার শ্যালকের মেয়ে আসিফাকে দত্তক নিয়েছিলেন।
নাসিমা বিবি বলেন, আসিফা যেন চঞ্চল এক পাখি যে কিনা হরিণের মতো এদিক সেদিকে ছুটে বেড়াতো। নাসিমা ও ইউসুফ যখন বাইরে থাকতেন, তখন পালের পশুগুলোর দিকে খেয়াল রাখতো আসিফা। নাসিমা বলেন, ‘এ কারণে আমাদের পুরো সম্প্রদায়ের প্রিয় ছিল সে। আমাদের দুনিয়ার মধ্যমনি ছিল সে।’
(বিবিসি)

No comments

Powered by Blogger.