‘আমি মরে গেলে লাশটি যেন দেশের মাটিতে পাঠায়’ by কামরুল ইসলাম

‘আমি আর নির্যাতন সহ্য করতে পারছি না। আমি মরে যাচ্ছি। ওরা আমাকে নির্যাতন করে শেষ করে দিচ্ছে। আমি মরে গেলেও আমার লাশটি যেন দেশের মাটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। গত ১১ বছর থেকে বদ্ধঘরে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছি।’ কথাগুলো বাংলাদেশের এক নারী নিখোঁজ হওয়ার ১১ বছর পর মোবাইল ফোনে তার বাবাকে জানায়।
লাকসামের নারী পাচারকারী আলম। ২০০৭ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবে এক নারীকে নিয়ে বিক্রি করে দেয়। এরপর থেকে ওই নারী গত ১১ বছর পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ ওই মহিলার নাম তাসলিমা বেগম (৩০)। তার বৃদ্ধ বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরা ওই নারী ব্যবসায়ী আলমের কাছে মেয়ের খোঁজ নিতে গেলে হত্যার হুমকি দেয় বলে তারা জানায়। এ নিয়ে লাকসাম থানায় ২০১০ সালে একটি জিডি করেন তাছলিমার বাবা সামছুল হক। থানা পুলিশ ওই নারী ব্যবসায়ী আলমকে থানায় আটক করে নিয়ে আসে। আটকের পর তার মেয়েকে ফেরত ও ৫ লাখ টাকা দেয়ার অঙ্গীকার করে। এরপর লাকসাম থেকে পালিয়ে যায়। গত ২রা এপ্রিল ওই মহিলা সৌদি থেকে তার বাবার ফোনে ফোন করে।  ফোনে জানায়, সৌদি আরবে নিয়ে আলম তাকে এক লোকের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর থেকে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। এ ব্যাপারে নাঙ্গলকোট থানায় একটি জিডি করা হয়েছে গত ৪ঠা এপ্রিল। 
মামলার বিবরণ ও তার পিতা, আত্মীয়স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে জানা যায়, লাকসাম উপজেলার শ্রীয়াং গ্রামের বেপারী বাড়ির আলম হোসেন। সে দীর্ঘদিন সৌদি আরবে থাকা অবস্থায় দেশে তার বড় ভাই ইদ্রিছ, ছোট ভাই নজরুল ও তার ভাতিজা মাসুদ রহমান সুন্দরী নারী সংগ্রহ করে তার মাধ্যমে সৌদি আরবে পাঠায়। ২০০৭ সালে নাঙ্গলকোট উপজেলার মক্রমপুর গ্রামের তাসলিমা আক্তার, বানঘর গ্রামের আমেনা আক্তার ও হাফানিয়া এলাকার সেলিম খানের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নেয় তাদেরকে সৌদি আরব নেয়ার জন্য। এদের ঠিক করে তাসলিমা আক্তার। আলম দেশে আসার পর ১ হাজার রিয়াল বেতনে তাসলিমা আক্তারকে সৌদি আরবে নেয়। বাকি দুজনকে সৌদিতে আর নেয়নি। তাসলিমার মোবাইলে জানা যায়, বাংলাদেশ এয়ারপোর্টে তার পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আলম নিয়ে যায়। সৌদি আরবে নেয়ার পর মালিকের ভাগিনার নিকট তাকে বিক্রি করে দেয়। প্রতি মাসে বেতনের টাকা তাসলিমার বাবা সামছুল হকের ব্যাংক একাউন্টে না গিয়ে ওই টাকা বাংলাদেশে আলমের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। তাসলিমার বাবা দিনমজুর অন্যের জমিতে কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালায়। সামান্য জমি বিক্রি করে মেয়েকে ভাগ্যের চাকা ফিরানোর আশায় সৌদি আরবে পাঠায়। এরপর থেকে তাসলিমার কোনো খোঁজখবর নেই। টাকা পয়সা নেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস যায় কিন্তু তাসলিমার কোনো খোঁজ নেই। মেয়ের খোঁজখবর নেয়ার জন্য আলমকে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন ধরে না আলম। এরপর লাকসাম থানা ২০১০ সালে আলমের বিরুদ্ধে একটি জিডি করেন। জিডির প্রেক্ষিতে আলমকে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ এবং পুলিশের নিকট অঙ্গীকারনামা দেয় তাসলিমাকে সৌদি থেকে ফেরত নিয়ে আসবে এবং ৫ লাখ টাকা ফেরত  দেবে। এরপর থেকে আলম নিরুদ্দেশ। মেয়ের খোঁজখবর না পেয়ে আলমের বাড়িতে গেলে তার ভাইয়েরা হুমকি দেয় এবং মোবাইল ফোনে আলম তাদেরকে হত্যা করার কথা জানায়। গত ১লা এপ্রিল হঠাৎ করে সৌদি আরব থেকে তার বাবার মোবাইলে ফোন আসে। ফোন করার পর তার মেয়ের কণ্ঠ শুনে সবাই কাঁদতে থাকে। তাকে উদ্ধার করে দেশে আনার ব্যবস্থা করার কথা বলে। সৌদি আরব নিয়ে তাকে তার ভিসার কফিলের কাছে না নিয়ে অন্য লোকের নিকট বিক্রি করে দেয়। সুন্দরী তাসলিমাকে একটি বদ্ধঘরে আটকে রাখে এবং তাকে পাশবিক নির্যাতন করে আসছে। প্রতি মাসের বেতনের টাকা বাংলাদেশি ২২ হাজার টাকা। ওই টাকা আলম আত্মসাৎ করে আসছে। তাসলিমা জানায়, সৌদিতে কোন জায়গায় রাখা হয়েছে তা জানে না সে। তাকে বাড়িতে পাঠানোর জন্য কান্নাকাটি করলে, তারা জানায় তোকে ১২ বছরের জন্য ক্রয় করে এনেছি। ১২ বছর শেষ হলে তোকে দেশে পাঠাবো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তার ভাই ও আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে সুন্দরী নারীদেরকে সংগ্রহ করে সৌদিতে নিয়ে আসে আলম। এবং মোটা অঙ্কের টাকার বেতনের আশ্বাস দেয়। সৌদিতে নিয়ে ওই সুন্দরী নারীদেরকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদেরকে বিক্রি করে দেয়। দেশের বাড়িতে আলমের একটি বিলাসবহুল বাড়ি ও ঢাকা উত্তরায় একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এছাড়াও তার বড় ভাই ইদ্রিছ শ্রীয়াং হাইস্কুলের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী। তার বাড়িতেও একটি দ্বিতল ভবন রয়েছে। এলাকায় আলম ও তার ভাই নারী পাচারকারী হিসেবে চিহ্নিত। নাঙ্গলকোট উপজেলার মক্রমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মর্তুজা বলেন, তাসলিমা সৌদি আরবে গিয়ে গত ১১ বছর থেকে নিখোঁজ রয়েছে।
এ ব্যাপারে তাসলিমার বাবা সামছুল হক কান্নাজড়িত কণ্ঠে  বলেন, আমার মেয়েকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করতে চাই। আলম দেশে আত্মগোপন অবস্থায় রয়েছে। আলমকে গ্রেপ্তার করলে তাসলিমা সৌদিতে কোথায় আছে সেটাও জানা যাবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।

No comments

Powered by Blogger.