বাবার স্মৃতির খোঁজে ডরোথি by সোহরাব হাসান

১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচারী এরশাদের পুলিশ বাহিনী ট্রাকচাপা দিয়ে খুন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এইচ এম ইব্রাহিম সেলিম ও কাজী দেলোয়ার হোসেনকে। তাঁরা দুজনই ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। সেদিন স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ শান্তিপূর্ণ মিছিল বের করলে পুলিশ বাহিনী সেই মিছিলের ওপর ট্রাক উঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে এ রকম বর্বরোচিত ঘটনা দ্বিতীয়টি ঘটেনি। এরপর ১ মার্চ রাজনৈতিক দল ও শ্রমিকসমাজ দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিলে সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডারা আদমজী মিলে শ্রমিক-মিছিলে হামলা করে শ্রমিকনেতা তাজুল ইসলামকে হত্যা করে। শহীদ ইব্রাহিম সেলিমকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তাঁর কন্যা নূসরাত জাহান ডরোথির বয়স মাত্র ছয় মাস। বাবাকে দেখলেও কোনো স্মৃতি তাঁর মনে থাকার কথা নয়। তারপরও প্রতিবছর ২৮ ফেব্রুয়ারির আগে তিনি ঢাকায় চলে আসেন বাবার স্মৃতির খোঁজে। বাবার স্মৃতি মানে ইব্রাহিম সেলিম সূর্যসেন হলের যে কক্ষে থাকতেন, সেই কক্ষটি একবার ঘুরে আসা। বাবার স্মৃতি মানে ইব্রাহিম সেলিম যে বিভাগে পড়তেন, সেই বিভাগটি ঘুরে দেখা। বাবার স্মৃতি মানে যেখানে এরশাদের পুলিশ তাঁদের ট্রাকচাপা দিয়ে মেরেছিল, সেই জায়গায় ফুল দেওয়া। বাবার স্মৃতি মানে তাঁর বন্ধুদের খুঁজে বের করা। ডরোথির মা অসুস্থ, তাই একাই তিনি বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছেন। প্রতিবার আসেন। বাবার সহপাঠী ও বন্ধুদের কেউ কেউ ডরোথির প্রতি সহমর্মিতার হাতে বাড়ান, তাঁকে সান্ত্বনা দেন। আবার অনেকে এড়িয়ে চলেন। সেলিম, দেলোয়ার ও তাজুলের আত্মত্যাগের পথ ধরে দীর্ঘ নয় বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে নব্বইয়ে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে। রাজনৈতিক দলগুলো সেদিন তিন জোটের রূপরেখা দিয়ে গণতন্ত্রকে সংহত এবং স্বৈরাচারকে চিরতরে প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পরবর্তী সময়ে নূর হোসেন, রউফুন বসুনিয়া, ডা. শামসুল আলম মিলনসহ বহু নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছেন, ক্ষমতার রাজনীতি তাঁদের কথা মনে রাখেনি। শহীদদের স্বপ্ন ও আদর্শ থেকে রাষ্ট্র এখন বহু দূরে। আজ ২৮ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেলিম-দেলোয়ার দিবন। অন্যান্য দিবসের মতো এই দিনটিও হয়তো নীরবে চলে যাবে, চলে যায়। কোনো কোনো পত্রিকায় পাতায় তাঁদের যুগল ছবি ছাপা হয়েছে। হয়তো টেলিভিশনের খবরেও এক ঝলক দেখানো হবে সেই ছবি। কিন্তু তাঁদের স্বজনদের কান্না কে মোছাবে? কে সান্ত্বনা দেবে ইব্রাহিম সেলিমের কন্যাকে? তিনি তো ৩৪ বছর ধরে বাবার অপেক্ষায় আছেন।
তিনি জানেন, এই অপেক্ষার পালা কখনো শেষ হওয়ার নয়। যত দিন বেঁচে থাকবেন, মায়ের কাছে শোনা বাবার গল্প স্মৃতিতে নিয়ে চলবেন। কিন্তু রাষ্ট্র সেলিম-দেলোয়ারের স্মৃতি রক্ষায় কিছু করেনি। অন্তত যেখানে ইব্রাহিম সেলিম ও দেলোয়ার হোসেনকে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করে তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে পারে। ডরোথির দাবি, সেই সড়কটি সেলিম-দেলোয়ারের নামে করা হোক। জায়গাটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে পড়েছে। মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে ইব্রাহিম সেলিমের কন্যা ডরোথি একাধিকবার আবেদন করেছেন। কিন্তু কোনো জবাব মেলেনি। সেলিম-দেলোয়ার দিবসে তাঁদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ছাড়া কোনো সংগঠনকে কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। তাঁদের সহযাত্রীদের অনেকে এখন সরকার ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তাঁদের কাছেও কি শহীদ সেলিম-দেলোয়ারের কোনো মূল্য নেই? যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা পড়াশোনা করতেন, সেই বিশ্ববিদ্যায়ও তো স্মৃতি রক্ষায় কিছু করতে পারে। তাঁদের নামে কোনো পাঠাগার, মিলনায়তন কিংবা হলেরও নামকরণ হতে পারে। এর মাধ্যমে শুধু শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে না, কী কারণে তাঁরা জীবন দিয়েছেন, সেই ইতিহাসও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানো হবে। ডরোথির মা নাসিমা জাহানও ছিলেন অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। সেলিম মারা যাওয়ার পর আর্থিক অনটনের কারণে তাঁর পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে যায় এবং মা-বাবার কাছে চলে যান। তিনি পিতৃহারা শিশুসন্তানকে অনেক কষ্টে মানুষ করলেও ঠিকমতো পড়াশোনা করাতে পারেননি। নবম শ্রেণির পর ডরোথির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে এখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন। এটুকুই কি একজন শহীদ-কন্যার প্রাপ্য ছিল? মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে শহীদেরা এখন আর স্মরণীয় মানুষ নন, ক্ষমতার সিঁড়ি। শহীদ সেলিমের কন্যা ডরোথির আক্ষেপ, সমাজ তাঁর বাবাকে ভুলে গেছে। তিনি চান তরুণ প্রজন্ম জানুক, কেন তাঁর বাবা এবং তাঁর সহযাত্রীরা জীবন দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.