ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে দরকার সচেতনতা by ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

রোগ হিসেবে যার বয়স হাজার বছরের, প্রসার প্রতিপতিত্বে গজেন্দ্রগামী, আহ্বায়ক অনেক অসংক্রামকের, মহামারী আকারে যার বিস্তার বীভৎসতায় ভাবিয়ে তুলছে পুরো বিশ্বকেÑ তাকে চিনতে জানতে, নিয়ন্ত্রণে, প্রতিরোধের নাকি এখনই সময়। সেই মহাসর্বনেশে শত্রুরূপী রোগটির নাম ডায়াবেটিস। যুগে যুগে দেশে দেশে তার হরেক নাম- মধুমেহ, বহুমূত্র, ডায়াবেটিস মেলিশাস, এন্ডোক্রাইন ও মেটাবলিক ডিসঅর্ডারস। গোটাবিশ্বে এখন প্রতি আট সেকেন্ডে একজন করে ডায়াবেটিক রোগী মারা যাচ্ছেন; এই ভয়াবহ সংবাদ ভাবিয়ে তুলছে পুরো বিশ্বকেই। নীরব ঘাতক স্বভাবের রোগটি এমনিতে দেহে বহু ব্যাধির (চোখ, হার্ট, কিডনিসহ মূল্যবান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যাপক ক্ষতিসাধনে সক্ষম) আহ্বায়ক। রোগটির অব্যাহত অগ্রাভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে যথাসচেতন করে তুলতেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, সমিতির প্রতিষ্ঠা দিবসকে (২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬) ‘ডায়াবেটিক সচেতনতা দিবস’ হিসেবে পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বস্তুত বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণে পুরো বিশ্বে সবাই উঠেপড়ে লাগলেও এবং গুটিবসন্ত, কলেরা, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো মহামারী নির্মূলে সফল হতে সক্ষম হলেও মানুষের সুন্দর সাবলীল জীবনযাপনের পথে নীরবে তার সর্বকর্মক্ষমতাহরণকারী অ-সংক্রামক ব্যাধি ডায়াবেটিসের বিস্তার রোধে ও নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি সচেতনতার পরিহার্যতা এবং এর জন্য সুপরিকল্পিত সার্বজনীন উদ্যোগ গ্রহণে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। যথা- মনোযোগ ও চেতনার চৌহদ্দিতে আনা অত্যন্ত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সমস্যা ও সীমাবদ্ধতাগুলোর প্রতি বিশ্বদৃষ্টি আকর্ষণ এবং সব সরকার ও জনগণের তরফে সংহত ও সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) জাতিসঙ্ঘকে প্রস্তাব গ্রহণের আহ্বান জানায়। মূলত ডায়াবেটিক সমিতির হয়ে বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে এবং যৌক্তিকতার প্রচারণা-প্রয়াসে ১৪ নভেম্বরকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে জাতিসঙ্ঘ ২০০৭ সালে ৬১/২২৫ নং প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। সেই থেকে জাতিসঙ্ঘের সব সদস্য দেশে, বিশ্ব ডায়াবেটিক ফেডারেশনের দুই শতাধিক সদস্য সংগঠনে, বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সংস্থা কোম্পানি পেশাজীবী সংগঠন এবং ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস নানা প্রাসঙ্গিক প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে।
২০০৭ সালে জাতিসঙ্ঘের গৃহীত প্রস্তাবের সাথে সাথে নীল সার্কেল লোগোটিও নির্বাচিত হয়। নীল বৃত্ত জীবন ও স্বাস্থ্যের ধনাত্মক প্রতীক, নীলাকাশ সব জাতিকে সঙ্ঘবদ্ধ করেছে এবং এ কারণে জাতিসঙ্ঘের পতাকার রঙও নীল। নীল বৃত্ত বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ ও জয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রতীক। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে ফ্রেডারিক ব্যান্টিং এবং চার্লস বেস্ট কর্তৃক ইনসুলিনের আবিষ্কার এক যুগান্তকারী অগ্রগতি। এ জন্য ব্যান্টিং চিকিৎসায় নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯২৩ সালে। বলাবাহুল্য, ১৪ নভেম্বর তার জন্মদিবসকেই তার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনার্থে বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস হিসেবে গৃহীত হয়েছে। ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০১৪-২০১৯) মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘ডায়াবেটিস রোগকে জানা এবং নিয়ন্ত্রণ’। এটি ক. ডায়াবেটিক রোগীদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন; খ. বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারেেক এই রোগ নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধমূলক উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি মোকাবেলা; গ. স্বাস্থ্যকর্মী পেশাজীবী সম্প্রদায়কে অধিকতর গবেষণা ও বাস্তব কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগে যতœশীল হওয়া এবং ঘ. সাধারণ জনগণকে ডায়াবেটিসের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে কিভাবে এর থেকে দূরে থাকা বা প্রতিরোধ করা সম্ভব, সে সম্পর্কে সচেতন হওয়ার তাগিদ দেয়া। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে ব্যক্তির সজ্ঞান ও আন্তরিক আগ্রহ আবশ্যক। তবে তাকে উদ্বুদ্ধকরণ, সার্বিক সহায়তা প্রদান, চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি এবং উপায়-উপকরণ সরবরাহ তথা পরিবেশ নির্মাণে অবিসংবাদিত ভূমিকা রয়েছে সরকার ও সমাজের। সুস্থ জনশক্তি বা নাগরিকের সুস্বাস্থ্য সব রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার অন্যতম অবলম্বন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা মতে- নগরায়ন, ওয়েস্টার্ন ফুড আর সার্বিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এই রোগের বিস্তারকে করছে বেগবান। বিশ্ব রোগ নিরাময় কেন্দ্রের মতে, এই শতকের মাঝামাঝি পৌঁছার আগেই এটি মানবভাগ্যে মারাত্মক মহামারী রূপে উদ্ভাসিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ডায়াবেটিক তথ্য নিকাশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, খোদ যুক্তরাষ্ট্র্রেই এই ঘাতকব্যাধি বছরে ১৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিসাধন করে জাতীয় অর্থনীতির। রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে, বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে আর পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখন বা অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সবারই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো ইত্যাদি হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে (রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের) ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না-গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন, তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
অত্যধিক চিন্তাভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বৃদ্ধি পাওয়া এ রোগ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারের : ক. ইনসুলিন নির্ভরশীল এবং খ. ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইসনুলিন থাকে। তবে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এ সব রোগীর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়। ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণ মতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সবক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা অর্থাৎ কাজেকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায়, শৃঙ্খলা মেনে চলা খুব দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয় এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্বন্ধে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সাথে, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সাথে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন, তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব ক’টি দেশই এক থেকে পাঁচ দশক ধরে স্বাধীনতা ভোগ করে এলেও দেশগুলো আজো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মূল (স্থূল) জাতীয় উৎপাদনের (Gross National Product) স্বল্পতা, অক্ষরজ্ঞানের নিম্নহার, অনুন্নত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, অপর্যাপ্ত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ব্যাপক অপুষ্টি, উচ্চজন্ম ও শিশু মৃত্যুর হার এবং পৌনঃপুনিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে চলছে। এত সব সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধি দমনের সাথে সাথে এই অঞ্চলের অধিবাসীদের আয়ুষ্কাল ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পক্ষান্তরে, বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যথা-ডায়াবেটিস মেলাইটাস, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদির প্রকোপ বেড়েছে। ডায়াবেটিক মেলাইটাস সংক্রামক রোগ না হওয়ার কারণে এখনো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশের স্বাস্থ্য কার্যক্রমের অগ্রাধিকার তালিকায় সংক্রামক রোগের তুলনায় এর স্থান অনেক নিচে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও তাদের আঞ্চলিক অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। সুতরাং ডায়াবেটিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা কর্মসূচি এসব দেশে সন্তোষজনকভাবে গড়ে উঠেনি। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা করা হয় ঠিকই; কিন্তু রোগীকে ইনসুলিন দেয়া হয় কেবল হাসপাতালে ভর্তি হলেই। বহির্বিভাগের রোগীকে কখনই ইনসুলিন দেয়া হয় না। দেশের ৮৫ শতাংশ অধিবাসী যে পল্লী অঞ্চলে বাস করেন, সেখানে ইনসুলিন পাওয়া যায় না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ডায়াবেটিসের মতো আজীবন রোগের ক্ষেত্রে যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন এসব উন্নয়নশীল দেশে সে সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতনতাও নেই। যেসব হাসপাতালে ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হয়, সেখানেও এসব রোগীর কোনো নথি কিংবা তালিকা রক্ষা করা হয় না। এমনকি কোনো কেন্দ্রীয় নিবন্ধনও নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিদ্যমান ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় সর্বপক্ষে ও সর্বক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ ও প্রয়াস আরো জোরদার করা জরুরি।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সাবেক চিফ কো-অর্ডিনেটর

No comments

Powered by Blogger.