চলতি পথে যত হয়রানির শিকার নারী by পিয়াস সরকার

কাওরান বাজারে অফিস শেষে প্রতিদিন ফার্মগেটে গিয়ে লেগুনা ধরেন অদিতি রেহেনা। কাওরান বাজার থেকে ফার্মগেট এই রাস্তাটুকু যেতে বাজে মন্তব্য শোনা নিত্যদিনের সঙ্গী তার। তিনি বলেন, প্রতিবাদ করতে করতে বিরক্ত। আর কত প্রতিবাদ করা যায়? এখন এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে ধরে নিয়েছি। আবার লক্ষ্য করি আমার সঙ্গে কোনো ছেলে থাকলে এই বাজে মন্তব্য খুব কমই শোনা যায়।
রাজধানীতে একা চলাফেরা করা নারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কর্মজীবী, শিক্ষার্থী কিংবা গৃহবধূ যারা একা চলাফেরা করেন ঢাকায় তারা প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করছেন বিভিন্ন সমস্যা।
শিক্ষার্থী সাগরিকা জাহান বলেন, একদিন ভার্সিটি থেকে বাসার ফেরার সময় বসুন্ধরা মার্কেটের সামনে সাহায্যের আবেদন করেন একজন বিদেশি। তার গন্তব্যে যাবার পথ বলে দিই। কিন্তু তারপর ঘটলো বিপত্তি। সে আমাকে তার হোটেল রুমে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করে। কথাটা শুনে আমি এতটাই স্তম্বিত হই যে সেখানে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ। আমার হচকিত ভঙ্গি আর হয়তো বিপদের আশঙ্কায় তিনি দ্রুত চলে যান। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বেশ কিছু ছেলে শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাই, কেন ঘটে এসব ঘটনা? তারা জানান, বিষয়টা মূলত মজা করার জন্য করা। আমি বা আমরা যখন বন্ধুরা একসঙ্গে থাকি তখন মেয়েদের উদ্দেশ্যে দু’একটা কথা বলে থাকি। ব্যাপারটা এমন না যে তাদের হেনস্থা করছি- তারাও মজা পাচ্ছে আমরাও মজা পাচ্ছি।  আড়ংয়ে চাকরি করেন লালমাটিয়া কলেজের শিক্ষার্থী তাসনিম আরেফিন জয়া। চাকরি শেষে মেসে ফিরতে ফিরতে রাত ১০টা বেজে যায়। তিনি বলেন, আমি রাতে একাই মেসে ফিরি। প্রায় প্রতিদিন রাস্তায় কানে আসে অনেক কথা। কথাগুলো যে আমাকে নিয়ে হচ্ছে তা বুঝতে বাকি থাকে না। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলা কথাগুলো যে সব সময় অশ্লীল হয় তা নয়। অনেক সময় তারা পোশাকের, চুলের, চোখের প্রশংসা করে। কিন্তু খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশংসাটাও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অচেনা-অজানা কয়েকটি ছেলে আমাকে দেখছে এটাই তো একটা হয়রানি। আবার অনেকে জানান যুবক বয়সী ছেলেরা বাজে মন্তব্য করে। কিন্তু তুলনামূলক বয়স্ক ব্যক্তিরা শরীর স্পর্শ করবার চেষ্টা করে বেশি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মিনতি রায় প্রতিদিন সাভার থেকে ধানমন্ডিতে আসেন। তিনি বলেন, বাসে আমার পাশের সিটে যুবক বয়সী ছেলেরা বসলে একটু দূরত্ব বজায় রেখে বসে। কিন্তু একটু বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়শই গা ঘেঁষে বসে।
বাসে যাতায়াত করা নারীদের যেন নীরবে মেনে নিতে হয় অনেক কিছু। এর মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হেলপারদের শরীরে হাত দেয়া। বাস থেকে নামার সময় এবং বাসে উঠার সময় তারা শরীরে হাত দেয়। তারা ভাব করে বাসে উঠতে কিংবা নামতে সাহায্য করছে। একবার কল্যাণপুরে তানজিল পরিবহন থেকে নামবার সময় শরীরে হাত দেয়ায় প্রতিবাদ করি হেলপারের বিরুদ্ধে। উল্টা আমাকেই সবার সামনে অপমানজনক কথা বলে সে। রাস্তায় জ্যাম হবার কারণে পুলিশ আসে। পুলিশকে বলার পর তিনি এমন একটা ভাব ধরলেন যেন খুব মজার গল্প বলছি তাকে। পুলিশ উল্টো আমাকে বোঝালেন বাসে এমন তো হতেই পারে। জনজটলায় শরীরে অচেনা হাত নিয়েও সচেতন থাকতে হয় নারীদের। ভিড় বাস কিংবা মার্কেট এসব স্থানে এসব ঘটনা ঘটে অধিক পরিমাণে। সিম্রিতি রাত্রি অধ্যয়নরত আছেন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটিতে, থাকেন ঝিগাতলায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি শ্যামলি ও আদাবরে দুটি প্রাইভেট পড়ান। তিনি বলেন, লেগুনার সিটগুলো এমন ভাবে তৈরি বসলে অন্য ব্যক্তির সঙ্গে শরীর লাগবেই। আবার এর মাঝে অনেকে চেষ্টা করেন একটু বেশি ঘেঁষে বসতে। হাত রাখার স্থানে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করতে। বাসে ভিড়ের মধ্যে অনেকে দেন ইচ্ছাকৃত ধাক্কা। সব থেকে বিব্রতকর পরিস্থিতি সম্মুখীন হতে হয় যখন স্পর্শকাতর স্থানে অন্যের শরীরের স্পর্শ অনুভব করি। প্রেস ইনস্টিটিউড অব বাংলাদেশ, পিআইবির সহকারী অধ্যাপক কামরুন নাহার রুমা বলেন, সমাজে তখনই নারী হয়রানি বন্ধ হবে যখন পুরুষরা অনুভব করবে আমি একটা নারীকে যে দৃষ্টিতে দেখছি আমার মা, বোন, স্ত্রী, প্রেমিকাকেও সেই দৃষ্টিতে দেখছে অন্য কোনো পুরুষ। এই অনুভূতি তখনই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে যখন সমাজ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। নিউ মুক্তি ক্লিনিক কল্যাণপুরের মনোরোগ বিশেষ ডা. শামসুন নাহার বলেন, সামাজিক অবক্ষয়, বন্ধুর প্ররোচনা, মাদকাসক্ত, অপসংস্কৃতি বিভিন্ন কারণে এসব ঘটনা ঘটে। ধর্মীয় শিক্ষা ও আইনের শাসনের অপ্রতুলতার কারণে এটি রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যে নারীটি হয়রানির শিকার হচ্ছেন তার মানসিকতার যেমন পরিবর্তন আসছে আবার সমাজের মানুষের প্রতি অবিশ্বাসের জায়গা তৈরি হচ্ছে। এরকমভাবে চলতে থাকার কারণে সে তার সন্তানকেও সুশিক্ষা দিতে অক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। চলতি পথে হয়রানির হিসাব করে যেমন শেষ করা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি অভিযোগের দারস্থ হন না বেশির ভাগ নারী। যারা অভিযোগ করেন তাদের সংখ্যাও নেহায়ত কম নয়। বেসরকারি সংস্থা ব্যাকের তথ্য মতে, ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তথ্যে উঠে আসে ৫ হাজার ৮২৫টি নারী নির্যাতনের শিকার। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ৫৮ শতাংশ বেড়ে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ১৯৬টি। রিপোর্টে উঠে আসে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৬২৮ জন, অন্যান্য নির্যাতনের শিকার ৮৮৮ জন। ব্যাক ও ইউএনডিপির দেশের ৪৪টি ইউনিয়নের পরিচালিত মাঠ জরিপে জানা যায়, দেশের নারীর প্রতি সহিংসতার ৬৮ শতাংশই নথিভুক্ত হয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৩ সালের প্রতিবেদনে মতে বিবাহিত নারীরা ৮৭ শতাংশই কোনো না কোনো ভাবে হয়রানির শিকার হন। ২০১৬ সালে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ পরিচালিত ‘নিরাপদ নগরী নির্ভয়ে নারী’ শীর্ষক নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা ও হয়রানি বিষয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ৮০০ নারী গবেষণাটিতে অংশ নেয়। এদের মধ্যে ৮৮ শতাংশই বলেন, তারা পথচারী, পুরুষ যাত্রী এবং ক্রেতাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন। আবার তারা জানান পুলিশের সাহায্য চাইলে সমস্যা বাড়ে। যৌন সহিংসতা এড়াতে ৬৪ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে যান না। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ৬০ ভাগ নারী রাতে ঘরের বাইরে বের হবার ক্ষেত্রে দলগতভাবে যাবার চেষ্টা করেন। নগরের ৪৭.৫ ভাগ নারী গণপরিবহন, রাস্তা কিংবা উন্মুক্ত জনবহুল এলাকায় চলাফেরা করার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। গবেষণায় অংশ নেয়া ৮১ শতাংশ নারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে সহায়তার জন্য যেতে চান না।

No comments

Powered by Blogger.