ট্রাম্প জমানায় মার্কিন অর্থনীতি

নভেম্বর ৮, ২০১৬। বিকালের দিকে টিভি পর্দায় ভেসে উঠল গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের জয়ের চিত্র। আর সেই সঙ্গে শুরু হল শেয়ার মার্কেটে ভবিষ্যৎ-সূচকের দরপতন। বিনিয়োগকারীদের মাথায় হাত। প্রমাদ গুনলেন তারা, আর ভাবলেন ট্রাম্প বিজয়ী হওয়ায় তাদের পুঁজির বুঝি বারোটা বাজল! মজার ব্যাপার হল, এর দু-একদিন পরই চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়ে ট্রাম্প এমন এক বক্তব্য দিলেন, যার ফলে রীতিমতো গা ঝাড়া দিয়ে উঠল পুঁজিবাজার। তার সেই বক্তব্যে ছিল আমেরিকার ধুঁকতে থাকা অবকাঠামো খাতে আরও বেশি সরকারি বিনিয়োগের প্রতিশ্র“তি, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সরকারের আরও উদারীকরণ এবং শিথিল নিয়ন্ত্রণের আভাস। শেয়ার মার্কেট ওই ইঙ্গিতগুলোই পছন্দ করে। এরপর ২০১৭-র জানুয়ারি মাসে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেয়ার মার্কেটের সেই তেজি ভাব এখনও বিদ্যমান। আর তাই প্রেসিডেন্ট হিসেবে এক বছর পূর্তি উদযাপনকালে তিনি বেশ দম্ভ করেই বলেছেন তার অর্থনৈতিক নীতির সাফল্যের কথা। যদিও সেগুলোকে কেবল ফাঁকা রাজনৈতিক বুলি বলেও উড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকেই। সেসব নিয়ে আলোচনার আগে বরং বলা যাক গত এক বছরে ট্রাম্প আসলেই কতটা অর্জন করেছেন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে। ওবামা তার উত্তরসূরি বুশের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভের পর প্রথম বছরে কাটিয়েছিলেন এক টালমাটাল সময়। বুশ আমলের অর্থনৈতিক মন্দার প্রাদুর্ভাবে তার প্রথম বছরে বেকারত্বের হার গিয়ে ঠেকেছিল প্রায় দশ শতাংশে। যদিও সময়োপযোগী নানা সিদ্ধান্ত দ্রুত গ্রহণের মাধ্যমে মার্কিন অর্থনীতিকে খাদের কিনারা থেকে টেনে এনেছিলেন তিনি। সেদিক দিয়ে ট্রাম্পকে বলা চলে কিছুটা ভাগ্যবান। ট্রাম্পের ক্ষমতায় আরোহণের সময়ে ছিল ওবামার রেখে যাওয়া চাঙ্গা অর্থনীতির ছাপ আর নিু বেকারত্ব। তবে অনেকে সে সময়ে ভেবেছিলেন, নানামুখী ভুল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ট্রাম্প সেই অবস্থার বারোটা বাজিয়ে ফেলবেন অচিরেই, হয়তো সহসাই যুদ্ধ বেধে যাবে আমেরিকার সঙ্গে শত্র“ দেশের। বাস্তবে গত এক বছরে দেখা গেল কিছুটা বিপরীত চিত্র। এটা ঠিক যে, সূচনালগ্নে ভাগ্য তার সহায় ছিল। সার্বিক বিশ্ব অর্থনীতি তখন রমরমা, ডলারের দাম চড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সুদের হার কম। তবে সেসব তাকে শুরুতে সাহায্য করলেও এটা স্বীকার করতেই হয়, গত এক বছরের অর্থনৈতিক সাফল্য সম্ভব হয়েছে মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের নেয়া বিভিন্ন বাণিজ্যবান্ধব নীতির কারণে। সাফল্য বলতে, গত বছর পুরোটাতেই জিডিপির হার ছিল ৩ শতাংশের মতো। সার্বিক বেকারত্বের হার এ মুহূর্তে ৪.১ শতাংশের কাছাকাছি, যা কিনা গত ১৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সারা দেশে পাইকারি বাজারে বেচাকেনার হার বেড়েছে। ওদিকে পুঁজিবাজারের সূচক ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। প্রায় পঁচিশ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কল-কারখানাগুলোয় শ্রমিক নিয়োগের হার বেড়েছে, যা শ্রমিক শ্রেণীকে কিছুটা হলেও লাভবান করেছে। বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা যাচ্ছিল, এ খাতটিতে শ্রমিক নিয়োগের হার কম ছিল, যেহেতু কারখানাগুলো চলে যাচ্ছিল আমেরিকার বাইরের দেশগুলোতে। গত বছর ট্রাম্পের অন্যতম সাফল্য ছিল তার প্রস্তাবিত আয়কর আইনকে সংসদে পাস করিয়ে আনা। বলা হয়, আশির দশকের পর এই প্রথম বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হল কর-পরিকাঠামোতে। এ আইনের মাধ্যমে বাণিজ্যিক করকে এক লাফে ৩৫ শতাংশ থেকে টেনে নামিয়ে আনা হয় ২১ শতাংশে। শুধু তা-ই নয়, বিদেশের ব্যাংকগুলোতে রক্ষিত মার্কিন কোম্পানিগুলোর সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এখন থেকে এই ২১ শতাংশ কর প্রযোজ্য হবে। এর ফলে পুঁজিবাজারে নতুন আশা ও উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো বলছে, কর থেকে বেঁচে যাওয়া অর্থ এখন তারা পুনরায় বিনিয়োগ করতে পারবে। যে কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি দেয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে আয়ারল্যান্ড কিংবা কেম্যান আইল্যান্ডের মতো স্বল্প করের দেশে সম্পদ লুকিয়েছে, তাদের অনেকেই সেই সম্পদ আমেরিকায় এনে পুনঃবিনিয়োগে ইচ্ছুক। প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপল ইতিমধ্যে তেমন একটি ঘোষণা দিয়েছে। ডিসেম্বরে কর আইন পাসের পর জানুয়ারিতে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ সম্ভাবনাময় কোম্পানি ত্রৈমাসিক আয় প্রতিবেদনে ভবিষ্যতে আরও আয়ের আশা করছে, এই নব কর আইনের সুবিধা নিয়ে। তবে ট্রাম্পের কর আইন নিয়ে নিন্দুকরাও সোচ্চার। তারা বলছেন, আইনে কর রেয়াতের ফলে অতিরিক্ত চাপ পড়বে সরকারি কোষাগারে। আগামী দশ-পনেরো বছরে যা গিয়ে ঠেকবে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলারে। ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য সেটি হয়তো এক বিরাট বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দেবে। আরও বলা হচ্ছে, এই রেয়াতের সুবিধাভোগী হবে মূলত উচ্চবিত্তরা, মধ্যবিত্তদের ওপর করের বোঝা আরও বাড়বে। এসব সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়ে আরেক পক্ষ বলছে, কর রেয়াতের ফলে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত উদ্দীপনা, তাতে সাধারণ মানুষের ব্যয়প্রবণতা এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে, ফলে সরকারি কোষাগারের ক্ষতি পুষিয়ে যাবে, সার্বিকভাবে লাভবান হবে সর্বস্তরের মানুষই। তবে সেটা সত্যি ঘটবে কিনা, এ মুহূর্তে সুনির্দিষ্টভাবে বলা মুশকিল। ট্রাম্পের নিন্দুকরা আরও বলছেন, অর্থনীতির এত-এত সাফল্যের দাবি করাটা ট্রাম্পের আত্মম্ভরিতা। তিনি তো ওবামার তৈরি করা মসৃণ পথেই হাঁটছেন কেবল! স্থিতিশীল বিশ্ববাজার আর আগের বছরের তুলনায় তেলের চড়া দাম তাকে আরও কিছুটা সহায়তা করেছে হয়তো। তবে সেখানেও কথা আছে। শুধু আগের জমানার নীতির ওপর ভর করে চললেই যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে, তেমন নয়। বিনিয়োগকারীরা বুঝতে চায় বর্তমান সরকারের মতিগতি, ভবিষ্যৎ পথরেখা। সেখানে আস্থা পেলে তবেই তারা এগিয়ে আসে নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগে। একই কথা প্রযোজ্য সাধারণ মানুষের ব্যয়প্রবণতার ক্ষেত্রেও। মানুষ যখন মন্দা আঁচ করতে পারে, তখন তারা আরও বেশি সঞ্চয়মুখী হয়; অন্যথায় তারা ব্যক্তিগত খরচের পরিমাণ বাড়ায়, যা পরিণামে বাজার অর্থনীতির চাকাকে আরও বেগবান করে। বলতে গেলে তেমনটাই এই মুহূর্তে ঘটে চলেছে মার্কিন অর্থনীতিতে। আর তাই ধারণা করা যায়, যদি বিশ্ববাজারে কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা না ঘটে, তবে এই তেজিভাব ২০১৮ সালজুড়েই বলবৎ থাকবে।
সঞ্জয় দে : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক

No comments

Powered by Blogger.