আশ্রয় শিবিরে যৌন নির্যাতন সহ নানা হয়রানির শিকার রোহিঙ্গা শিশুরা

নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে কাজ করছে রোহিঙ্গা শিশুরা। তা সত্ত্বেও তাদেরকে প্রহারের শিকার হতে হয়। কখনো কখনো তাদের ওপর চালানো হয় যৌন নির্যাতন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম এমন তথ্যপ্রমাণ হাতে পেয়েছে। কক্সবাজারের কুতুপালং থেকে এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এতে বলা হয়েছে, রয়টার্সের নিরপেক্ষ রিপোর্টগুলো একত্রিত করেও এ প্রমাণ মিলেছে।
বাংলাদেশে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শিশুদের বেপথে পরিচালনা করা ও পাচার বিষয়ে অনুসন্ধান করে আইওএম। তাদের এ তদন্তকে ‘এক্সক্লুসিভ বেসিস’ বা নির্ভরযোগ্য ভিত্তি হিসেবে দেখে রয়টার্স। এতে দেখা গেছে, ১১ বছর বয়সী রোহিঙ্গা মেয়েদের বিয়ে দেয়া হচ্ছে। মিয়ানমারে নৃশংসতার শিকার হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে কমপক্ষে ৬ লাখ রোহিঙ্গা। এর মধ্যে সাড়ে চার লাখই শিশু। মোট রোহিঙ্গার শতকরা ৫৫ ভাগই তারা। এসব শিশু বসবাস করছে নাজুক আশ্রয় শিবিরে। তাদের দিকে চোখ পড়েছে অসাধু চক্রের। কক্সবাজারের এএসপি আফজুরুল হক টুটুল বলেছেন, শিশুরা যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে তা ঠেকাতে বসানো হয়েছে ১১টি চেকপয়েন্ট। যদি দেখা যায় কেউ রোহিঙ্গা শিশুদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিককে শাস্তি দেয়া হবে। আই্ওএম রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলোতে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলেছে। দীর্ঘদিন এখানে আছেন এবং সম্প্রতি যারা এসেছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে তারা। আলাদাভাবে তাদের সাক্ষাতকার নিয়েছে রয়টার্স। তাতে দেখা গেছে, আশ্রয় শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শিশুরা ভাল নেই। আইওএম বলছে, রোহিঙ্গা শিশুদের টার্গেট করছে লেবার এজেন্ট বা শ্রমে নিয়োজিত করানোর দালাল। তারা এসব শিশুকে উৎসাহিত করছে। এক্ষেত্রে তারা বেছে নিচ্ছে শিশুদের পিতামাতাকে। দুর্ভোগে পড়ে এমনিতেই তারা বিপর্যস্ত। তার ওপর অর্থের লোভ দেখানো হয় তাদেরকে। ফলে ওইসব পিতামাতা সহজেই সন্তানকে কাজ করার অনুমতি দেন অথবা বাধ্য করেন। তৃতীয় শ্রেণির পর পড়াশোনার সুযোগ খুবই সীমিত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ৭ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ছেলে ও মেয়ে শিশুরা আশ্রয় শিবিরের বাইরে গিয়ে কাজ করছে। ছেলে শিশুরা কাজ করছে বিভিন্ন কৃষিকাজে, খামারে, অবকাঠামো খাতে, মাছ ধরা বোটে, চায়ের দোকানে আবার কখনো রিক্সা চালাচ্ছে। অন্যদিকে মেয়ে শিশুরা গৃহকর্মে অথবা পরিবারের সন্তানদের দেখাশোনার কাজ করছে। তারা পার্শ্ববর্তী কক্সবাজর, চট্টগ্রামে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে এসব কাজ করছে। এক রোহিঙ্গা দম্পতি স্বীকার করেছেন। বলেছেন, তাদের ১৪ বছর বয়সী মেয়ে কাজ করছিল চট্টগ্রামে এক বাসায়। এক পর্যায়ে সে ওই বাসা থেকে পালিয়ে যায়। ফিরে আসে আশ্রয় শিবিরে। তখন তার হাঁটার শক্তি ছিল না। ওই শিশুটির মা বলেছেন, তার মেয়েকে নিয়োগকারীর পরিবার শারীরিক নির্যাতন করেছে। যৌন নির্যাতন করেছে। ওই পরিবারের পুরুষ সদস্যটি ছিল মাদকাসক্ত। রাতের বেলা সে ওই রোহিঙ্গা বালিকার বেডরুমে প্রবেশ করতো। তাকে ধর্ষণ করতো। ৬ থেকে ৭ বার সে এ কাজ করেছে। ‘এর বিনিময়ে ওই নিয়োগকারীরা আমাদেরকে কোন অর্থ দেয় নি। কিচ্ছুই না’। তবে তার এ দাবিকে যাচাই করা যায় নি। তবে এ ঘটনা অন্য ঘটনাগুলোর মতোই, যা রেকর্ড করেছে আইওএম। যাদের সঙ্গে কথা বলে আইওএম ও রয়টার্স তাদের তথ্য উপস্থাপন করেছে, তাদের বেশির ভাগই বলেছেন, রোহিঙ্গা নারীরা এক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হন। তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়। তাদেরকে যারা ধর্ষণ করে তাদেরকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। রয়টার্স লিখেছে, তারা অনুসন্ধানে দেখতে পেয়েছে রোহিঙ্গা শিশুরা কর্দমাক্ত রাস্তাঘাটে উদ্দেশ্যহীনভাবে একা একা ঘোরাঘুরি করছে। বসে আছে তাঁবুর বাইরে। রাস্তার পাশে ভিক্ষা করছে বহু শিশু। জাতিসংঘ এজেন্সিগুলো এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর জন্য কাজ করে ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ। তারা এ মাসে বলেছে, নিঃসঙ্গ ২৪৬২ টি শিশুকে তারা সনাক্ত করেছে। এসব শিশু আশ্রয় শিবির থেকে আদালাত। তাদের দাবি, এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি হতে পারে। শিশুদেরকে কাজে পাঠিয়েছে এমন সাতটি পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতকার নিয়েছে রয়টার্স। তারা সবাই বলেছেন, ভয়াবহ অমানবিক অবস্থায় তাদের সন্তানদের কাজ করতে হয়। বেতন দেয়া হয় অকল্পনীয়ভাবে কম। শিকার হতে হয় নির্যাতনের। এমনই একটি রোহিঙ্গা শিশুর নাম মুহাম্মদ জুবায়ের। তার পরনে ময়লাযুক্ত ফুটবলের একটি টিÑশার্ট। তাকে দেখে মনে হয় বয়স ১২ বছর। তবে তার মা বলেছেন, তার বয়স ১৪ বছর। জুবায়ের বলেছে, তাকে দিনে আড়াইশ টাকা বেতন দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু সড়ক নির্মাণের একটি কাজে এ প্রস্তাবে ৩৮ দিন কাজ করানোর পর তাকে দেয়া হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা। জুবায়ের ও তার পরিবার থাকেন কুতুপাংয়ের একটি শিবিরে। সে আরো বলেছে, তাকে রাস্তার মেরামত কাজে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। এ সময় তাকে মারাত্মকভাবে খারাপ খারাপ গালি শুনতে হয়েছে তার নিয়োগকর্তার মুখ থেকে। এক পর্যায়ে সে বেশি অর্থ দাবি করে। ফলে এমন নির্যাতন বাড়তে থাকে। তাকে কাজ থেকে চলে যেতে বলা হয়। তবে তাকে কারা কাজ দিয়েছিল তা জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর এক মাসের জন্য একটি চায়ের দোকানে কাজ নেয় জুবায়ের। সেখানে দু’শিফটে কাজ করতে হয় তাকে। ভোর ৬টা থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত চলে কাজ। মাঝখানে বিকালে চার ঘন্টার বিরতি। তবে তাকে দোকান ছেড়ে যেতে দেয়া হতো না। তাকে দিনে মাত্র একবার তার পিতামাতার সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হতো। জুবায়ের বলে, সেখানেও আমাকে বেতন দেয়া হয় নি। তাই আমি পালিয়ে চলে এসেছি। আমি ভয়ে ছিলাম। মনে করেছিলাম আমার মালিক লোকজন নিয়ে এখানে আশ্রয় শিবিরে চলে আসবে এবং আমাকে আবার নিয়ে যাবে। ওদিকে বেশির ভাগ পিতামাতাই তাদের মেয়ে শিশুদের আগেভাগে বিয়ে করতে বাথ্য করে। তারা মনে করে এতে মেয়ের সুরক্ষা হয়। আর্থিক স্থিতিশীলতা আসে সংসারে। আইওএম দেখতে পেয়েছে, এমন বিবাহের শিকার কনেদের অনেকের বয়স ১১ বছর। তবে এ বয়সেই তাদের অনেকে স্বামীর সংসারে গিয়েছে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে। দ্বিতীয় স্ত্রীকে আবার খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া হয়। তাদেরকে অর্থকড়ি না দিয়ে পরিত্যক্ত ফেলে রাখা হয়। আইওএমের পাচার বিরোধী বিশেষজ্ঞ কাতিরইয়ানা আরদানিয়ান বলেছেন, আশ্রয় শিবিরগুলোতে শোষণ, নিষ্পেষণ একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্য মেকানিজম যতটা দ্রুত না পারে তার চেয়ে দ্রুত এ পরিস্থিতির ব্যবহার করে পাচারকারীরা।

No comments

Powered by Blogger.