ডেনিম রপ্তানিতে এগুচ্ছে দেশ

ডেনিম বা জিন্স পণ্যে বাংলাদেশ এখন বড় ‘সম্ভাবনার’ খাতে পরিণত হয়েছে। বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মার্কেটে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে। ইউরোপের ২৮ দেশে  ডেনিম রপ্তানিতে চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশই এখন শীর্ষ প্রধান রপ্তানিকারক দেশ। দ্বিতীয় তুরস্ক, তৃতীয় পাকিস্তান ও চতুর্থ চীন। ইইউতে ডেনিমের গত বছরের বাজার ছিল ৪৮৩ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় বাজার বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ।
যার বেশিরভাগ হিস্যা এখন বাংলাদেশের দখলে। পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) কমিশনের পরিসংখ্যান বিভাগ ইউরোস্ট্যাটের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, ডেনিম ফ্যাব্রিক্সের প্রচুর অর্ডার পাচ্ছে বাংলাদেশ। চীন এসব ডেনিম ফ্যাব্রিক্স রপ্তানি করা থেকে সরে আসায় বাংলাদেশ এ অর্ডার পাচ্ছে বলে মনে করেন তারা। এ ছাড়া ঠিকমতো কাজ করতে পারলে বাংলাদেশ খুব সহজেই ডেনিম পণ্যের উৎসস্থলে পরিণত হবে।
তথ্যমতে, ২০১৬ সালে ইইউতে ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন শীর্ষে। আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। মোট ১২৯ কোটি ডলারের ডেনিম রপ্তানি হয়েছে। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১১৮ কোটি ডলার। অন্যদিকে চীন ইইউতে ডেনিম রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থান হারিয়েছে। দেশটি ডেনিম রপ্তানিতে চতুর্থ অবস্থানে নেমে গেছে। ইইউতে দেশটির ডেনিম রপ্তানি কমেছে আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২১ শতাংশ।
চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসেবে ডেনিম পণ্য রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তুরস্ক। তারা এ পর্যন্ত রপ্তানি করেছে ৫৫১.১৪ মিলিয়ন ডলারের ডেনিম। গত বছরের তুলনায় দেশটির প্রবৃদ্ধি ৫.২৮ শতাংশ।
অন্যদিকে একক প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম রপ্তানিতে এখনো চীনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখনো তৃতীয়। যুক্তরাষ্ট্রে ডেনিম রপ্তানিতে শীর্ষ স্থান অক্ষুণ্ন আছে চীনের। তবে, আলোচ্য বছরে চীনেরও রপ্তানি কমেছে ৩৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে মেক্সিকো। গত বছর প্রায় ৫৬ কোটি ডলারের ডেনিম রপ্তানি করেছে দেশটি। চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটেক্সা) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও জুলাইয়ের মধ্যে ডেনিম পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ৩৯২.৭১ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবার বাংলাদেশের আয়ের পরিমাণ বেড়েছে ৬.৬১ শতাংশ। তবে, মার্কিন বাজারে শীর্ষ রপ্তানিকারক চীনের এবার রপ্তানি ৩.০৩ শতাংশ কমেছে। তাদের এবারের রপ্তানি আয় ৮৮৫.৮২ মিলিয়ন ডলার। যা গত বছরে ছিল ৯১৩.৫৯ মিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপারেল মার্কেটে বাংলাদেশের যেসব ডেনিম বেশি যাচ্ছে সেগুলো হলো- ব্লু ডেনিম ট্রাউজার্স ডব্লিউজি, ব্লু ডেনিম ট্রাউজার্স এমবি, ব্লু ডেনিম স্কার্ট, ব্লু ডেনিম জ্যাকেট, ব্লু ডেনিম স্যুট টাইপের কোট এমবি, প্লে স্যুট ও সানস্যুট।
সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, বাংলাদেশি ডেনিম পণ্যের চাহিদা বিশ্বে দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে এই ইন্ডাস্ট্রিকে আরো উদ্ভাবনী হতে হবে। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে ডিজাইনের ক্ষেত্রে আরো ভ্যারিয়েশন আনার পাশাপাশি আমাদের প্রোডাক্টগুলোর দাম বাড়াতে হবে। 
ডেনিম রপ্তানি কেন বাড়ছে: জানা গেছে, আমদানি পর্যায়ে সময় ব্যয় না হওয়ায় রপ্তানিতে লিডটাইম (রপ্তানি আদেশ পাওয়ার পর ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছানোর সময়) কম লাগছে। ফলে ডেনিম রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ তুলনামূলক বেশি। ডেনিমের দামও তুলনামূলক বেশি। এ ছাড়া সমপ্রতি পাট থেকে ডেনিম কাপড় তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পাট ও তুলার মিশ্রণে তৈরি করা সুতা থেকে বানানো হবে ডেনিম।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসেবে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩২টি ডেনিম মিল রয়েছে। এগুলোর বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪৪২ মিলিয়ন মিটার। এসব মিলে কাজ করেন ২০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে আরো ১০টি নতুন ডেনিম মিল কোম্পানি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে ডেনিমের চাহিদা ১২০ কোটি গজে পৌঁছবে।
সম্প্রতি ঢাকায় দু’দিনের ডেনিম প্রদর্শনী হয়ে গেলো। বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ডেনিমকে জনপ্রিয় করতে নিরলস কাজ করছে ডেনিম এক্সপার্টের এমডি মোস্তাফিজ উদ্দিন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা শীতপ্রধান দেশ। ওইসব দেশে ডেনিমের চাহিদাই বেশি। তবে সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা বিশ্বব্যাপী জানান দিতে আন্তর্জাতিক মানের ব্র্যান্ডিং কর্মসূচি প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই গত কয়েক বছর ধরে ঢাকায় আন্তর্জাতিক মানের ডেনিম প্রদর্শনী করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশের সক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারছেন ক্রেতারা। ঢাকার ডেনিম প্রদর্শনী এখন ডেনিমের সবচেয়ে বড় বিশ্ব আসর।
যত চ্যালেঞ্জ: ডেনিমের কাপড় তৈরি করতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কাজ চলাকালে লোডশেডিং হলে ডেনিম কাপড়ের মান নিয়ন্ত্রণ কষ্টকর। এ ছাড়া, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়লে নতুন করে বিনিয়োগ করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ ছাড়া কাপড়ের জন্য বাইরের উৎসের ওপর নির্ভরশীল না হওয়াটাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখনো প্রায় ৬০ শতাংশ ডেনিম কাপড় আমদানি করতে হয়। সেজন্য আমাদের গবেষণা, উন্নয়ন এবং উদ্ভাবনের ওপর আরো জোর দিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

No comments

Powered by Blogger.