সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে চলার কথা আমাদের সংসদ তা পারছে না

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেভাবে চলার কথা আমাদের সংসদ তা পারছে না। বিভিন্ন কারণে এটি খুবই পরিষ্কার। আমাদের সংবিধানে শুধু মানুষের গণতন্ত্রের কথা বলা হয়নি, বরং প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রের কথা বিবেচনা করা হয়েছে। কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানেরই চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়নি। অকার্যকর আর অপরিপক্ব সংসদ, কেনাবেচার সংস্কৃতি প্রভৃতি কারণে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকা উচিত নয়; কারণ সেটি হলে বিচার বিভাগ অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের শিকার হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগের এ রাজনীতিকরণ আরো তীব্র আকার ধারণ করবে। বিচার বিভাগ দলীয় হাইকমান্ডের অনুগ্রহের পাত্রে পরিণত হবে। যেসব দেশে গণতন্ত্র সংহত, সংসদীয় ব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করছে; সেসব দেশেও সংসদ কর্তৃক বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ হচ্ছে এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এ প্রেক্ষিতে আমাদের দেশে বিদ্যমান অবস্থায় সংসদের হাতে এ ক্ষমতা দেয়া হবে চরম আত্মঘাতী পদক্ষেপ। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে প্রধান বিচারপতি এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে বর্তমান সরকার সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করে। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা কেন সংসদের ওপর থাকা উচিত নয়, সে বিষয়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে রায়ে। সেখানে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কোনো দল থেকে কোনো ব্যক্তি মনোনয়ন নিয়ে যদি নির্বাচনে পাস করেন এবং তিনি যদি সংসদে দলের বিরুদ্ধে ভোট দেন তাহলে তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। প্রধান বিচারপতি রায়ে লিখেছেন, সরকার তার মেয়াদ পূর্ণ করা, দলের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং রাজনৈতিক কেনাবেচা বন্ধের জন্য যে এ বিধান করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক কেনাবেচার সংস্কৃতির কারণে যেখানে একজন সংসদ সদস্যকে তার দলই বিশ্বাস করতে পারে না, সেখানে তারা কী করে বিচারপতিদের অপসারণের মতো গুরুদায়িত্ব পালন করবে? সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর আগে সংসদে সংসদ সদস্য কর্তৃক দলের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যদি কোনো সংসদ সদস্য সংসদে উপস্থিত থাকেন এবং তিনি দলীয় কোনো বিষয়ে ভোটাভুটির সময় ভোট দানে বিরত থাকেন অথবা দলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সংসদে উপস্থিত না হন তাহলে এটি ধরে নেয়া হবে যে, তিনি দলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, এ মামলায় নিযুক্ত অ্যামিকাস কিউরিদের মধ্যে একমাত্র আজমালুল হক ছাড়া বাকি সব অ্যামিকাস কিউরি এবং মামলার বাদিপক্ষের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ একমত যে, উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত করে সংবিধানের যে ষোড়শ সংশোধনী পাস হয়েছে তা অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের দিকে নিয়ে যাবে বিচার বিভাগকে। আর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিচার বিভাগের এ রাজনীতিকরণ আরো তীব্র আকার ধারণ করবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, আমাদের সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে যারা সরাসরি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত নন। এ নারী সংসদ সদস্যরাও বিচারপতিদের অপসারণের কাজে জড়িত হবেন, যা কোনোভাবেই পরিপক্ব সংসদীয় ব্যবস্থায় গ্রহণযোগ্য নয়। এরপর তিনি লিখেছেন, অন্যভাবে দেখলে এটি খুবই পরিষ্কার (ন্যাকেডলি কিয়ার) যে, সংসদীয় গণতন্ত্র যেভাবে কাজ করার কথা, আমাদের সংসদ তা করতে পারছে না। সংসদে নতুন আইন তৈরির পরিবর্তে বিভিন্ন সময়ে একের পর এক অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার দৃষ্টান্ত দিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, নির্মম সত্য হলো সংসদ তার মূল কার্যক্রম পরিচালনায় পুরোপুরি অক্ষম, অথচ তারা এখন সুপ্রিম কোর্টকে শেখাতে চায়। তিনি বলেন, সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিধান রাখার পেছনের কারণ হিসেবে যেটি প্রাধান্য পেয়েছে তা হলো সংসদের আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। আর যেহেতু আমাদের গণতন্ত্র এখনো যথেষ্ট পরিপক্ব হয়নি, তাই সংসদে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় নারীদের অংশগ্রহণ করার জন্য সরাসরি নির্বাচনের পরিবর্তে তাদের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়েছে। তারা নির্বাচিত হন অপর ৩০০ নির্বাচিত সংসদ সদস্যের মাধ্যমে। তিনি বলেন, যেসব দেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা খুবই মর্মান্তিক। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করার কথা তার পরিবর্তে ওই সব দেশে রাজনীতিকরণই বেশি হয়েছে এবং দেশে-বিদেশে তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, সংসদের সার্বভৌমত্ব বিষয়ে ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। মূলত সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদ এবং সংসদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রিসভা। যতক্ষণ পর্যন্ত দল ক্ষমতায় ততক্ষণ পর্যন্ত দলই সংসদের বেশির ভাগ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে। মন্ত্রিসভাই সংসদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। সংসদে কী আলোচনা হবে, কখন তা আলোচনা হবে, কতক্ষণ ধরে আলোচনা চলবে এবং শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত হবে সবই নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রিসভা। সংসদের সব বিলই পাস হয় মন্ত্রীদের সৌজন্যে- যাদের ওপর বিভিন্ন সঙ্ঘবদ্ধ শ্রেণী ও স্বার্থান্বেষী মহলের চাপ থাকে, যারা সংসদের মাধ্যমে অনেক কিছু প্রতিকার করতে চায়। মন্ত্রী ছাড়াও একজন সংসদ সদস্য সংসদে আইন পাসের জন্য বিল আনতে পারেন। কিন্তু সরকারের সমর্থন ছাড়া তা পাস হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সংসদের বেশির ভাগ সময় ব্যয় হয় সরকারি কার্যক্রমের মাধ্যমে। সপ্তাহে এক দিন মাত্র বরাদ্দ থাকে প্রাইভেট বিলের জন্য। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে যুক্তি পেশ করে বলেছেন, বিচারপতিদের জবাবদিহির ব্যবস্থা জনপ্রতিনিধিদের হাতে থাকা উচিত। তাদের নিজেদের জবাবদিহি নিজেদের কাছে থাকা আইনের শাসনের লঙ্ঘন। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার উদাহরণ টেনে তিনি বলেছেন, সেসব দেশের বিচারপতিরা গর্ববোধ করেন যে, তারা অন্য কারো কাছে নয় বরং জনপ্রতিনিধিদের কাছে দায়বদ্ধ। তিনি বলেছেন, বিচারপতি হতে আগ্রহী কোনো সম্ভাব্য প্রার্থী যদি নিজেকে জনপ্রতিনিধির তুলনায় অতি বড়, অতি মহান ও অতি উচ্চতর ভেবে থাকেন; তাহলে তাকে বিচার বিভাগে স্বাগত জানাই না। এমন কেউ থাকলে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। আজমালুল হকও তার সাথে সুর মিলিয়ে বলেছেন, বিচারপতিদের অপসারণের বিষয় বিচার বিভাগের হাতে ন্যস্ত থাকলে তাদের বিষয়ে জনসাধারণের যে ধারণা রয়েছে তা মুছে যাবে। তিনি লর্ড অ্যাকটনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, সর্বময় ক্ষমতা দুর্নীতিতে উদ্বুদ্ধ করে আর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়। প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন প্রশ্ন হলো ক্ষমতার চর্চা নিয়ন্ত্রণ করবে কে? লর্ড ড্যানিং বলেছেন, কাউকে না কাউকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে। চলুন আমরা বিচারপতিদের বিশ্বাস করি। অ্যাটর্নি জেনারেল খুবই নির্দয় মন্তব্য করেছেন বিচারপতিদের সম্পর্কে। যদি বিচারপতিদের প্রতি তার বা সরকারের আস্থা না থাকে তাহলে আমি বলব তিনি (অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম) ভ্রান্ত (রং)। অ্যাটর্নি জেনারেলের উচিত তার মক্কেলকে (সরকার) এ কথা বলা যে, সরকারের মনোভাব যদি এই হয় যে, বিচারপতিরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নন তাহলে দেশে বিশ্বাস করার মতো আর কেউ নেই। অধিকন্তু আমরা যদি অ্যাটর্নি জেনারেলের যুক্তি মেনে নেই তাহলে বলতে হয় বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের সংবিধান বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষেত্রে সংসদের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে ভুল করেছে। এ ছাড়া আজমালুল হকও বিচারপতি ও উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সম্পর্কে নির্দয় ও ক্ষতিকর মন্তব্য করেছেন। লিখিত আর্গুমেন্টে তিনি বলেছেন, যেহেতু এ মামলায় বিচার বিভাগের স্বার্থ জড়িত রয়েছে তাই খুবই সতর্কতার সাথে এর সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, তার (আজমালুল হক) এ মন্তব্যে আমরা হতবাক ও বিস্মিত। তার মতো একজন সিনিয়র আইনজীবী যদি বিচার বিভাগ সম্পর্কে এ ধারণা পোষণ করেন, তাহলে আমরা বলব- উই ফিল স্যরি ফর হিম। প্রধান বিচারপতি এরপর বলেন, বিচারপতিদের যদি কোনো বিষয়ে কোনো স্বার্থ থাকে তাহলে সংবিধান থেকে ৭ (২), ২৬, ৯৪ (৪), ১০২ ও ১১৬ ক ধারা মুছে ফেলা উচিত। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, বরং রাজনৈতিক সরকারের স্বার্থ রয়েছে বিবদমান অনেক বিষয়ে। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, সংবিধান অনুযায়ী উচ্চ আদালত নির্বাহী ও আইন বিভাগ থেকে আলাদা এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন। সংবিধান ও আইনানুযায়ী বিচারপতিরা তাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতা প্রয়োগে বিবেক ছাড়া কারো কাছে দায়বদ্ধ নন। এরপর বিচারপতি, বিচারকদের দায়-দায়িত্ব, জবাবদিহিতা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন- আইন, সংবিধান ও জনগণের কাছে তারা দায়বদ্ধ হতে পারেন। আর জনসাধারণ ও গণমাধ্যম বিচার বিভাগের সমালোচনা করতে পারে। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, নির্বাহী বিভাগের অনেকের বিরুদ্ধে এবং অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধেও মামলা রয়েছে। বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে থাকলে এসব মামলা নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হতে পারে না। তা ছাড়া কোনো সংসদ সদস্য নির্বাচনে কারচুপি বা যেকোনো অনিয়মের অভিযোগের মামলাও নিষ্পন্ন করতে হয় হাইকোর্টে। এ অবস্থায় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করার উদ্যোগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার শামিল। তিনি বলেন, একমাত্র জনগণই হলো সার্বভৌম এবং সংবিধানই হলো সর্বোচ্চ। অন্য সব প্রতিষ্ঠান সংবিধানে বর্ণিত বিষয়াবলি বাস্তবায়নের হাতিয়ার বা সংস্থা মাত্র। আমাদের সংবিধানে শুধু মানুষের গণতন্ত্রের কথা বলা হয়নি, বরং প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্রের কথা বিবেচনা করা হয়েছে। কোনো অফিস বা প্রতিষ্ঠানেরই চূড়ান্ত কর্তৃত্ব বা নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নেই। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, সংসদকে সার্বভৌম দাবি করা হলে তা হবে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আইনের সাথে সরাসরি সাংঘার্ষিক এবং এ আদালত এর সাথে একমত পোষণ করছে।

No comments

Powered by Blogger.