আল-জাজিরা বন্ধের চেষ্টা কেন?

ইসরায়েলি সরকার যে জেরুজালেমে আল-জাজিরার কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করছে তাতে বোঝা যায়, সমালোচনামূলক গণমাধ্যমের ক্ষমতা ও ভূমিকায় সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেটা শুধু ইসরায়েল অধিকৃত ফিলিস্তিনে নয়, আরব বিশ্ব ও উত্তর আফ্রিকাতেও ব্যাপারটা ঘটতে পারে। ইসরায়েলের এই উদ্যোগ কিছুটা উদ্ভট। কারণ, আল-জাজিরা ও ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিনের একটা মিথোজীবিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে, যদিও মাঝেমধ্যে তাদের মধ্যে নানা কিছু নিয়ে লেগে যেত। আল-জাজিরা ইসরায়েলের দখলদারি ও নীতির কঠোর সমালোচনা করলেও দেশটি এই চ্যানেলের সংবাদ পরিবেশনে নানা সহযোগিতা করেছে। কয়েক বছর ধরে বারবার অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েল চ্যানেলটির ব্যুরো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। কিন্তু এতে আল-জাজিরার সংবাদ পরিবেশন এবং কর্মী ও প্রদায়ক-লেখকদের থামানো যায়নি। সরকারের তথ্য কার্যালয়ের মতো আল-জাজিরার কার্যালয়ও বছরের পর বছর ধরে একই জায়গায় রয়েছে, অন্যান্য গণমাধ্যমের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। কথা হচ্ছে ইসরায়েলে আল-জাজিরার পক্ষ থেকে প্রেস পাস পাওয়ার জন্য আবেদন করলে কখনোই তেমন সমস্যা হয়নি, তুলনামূলকভাবে মার্কিন গণমাধ্যমের হয়ে প্রেস পাস চাইতে গেলে বরং বেশি ঝামেলা হয়েছে। বস্তুত কখনো কখনো মনে হয়েছে, আল-জাজিরার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাটা ইসরায়েলি গণমাধ্যমের জন্য গর্বের ব্যাপার ছিল। এতে উভয় পক্ষেরই লাভ হয়েছে। ইসরায়েলের বেলায় হয়েছে কী, মূল আল-জাজিরা নেটওয়ার্কের কল্যাণে দেশটি আরব বিশ্বের জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বস্তুত, আল-জাজিরা প্রতিবেদনের মাধ্যমে ইসরায়েলি কর্মকর্তা এবং সাধারণ জনগণকে নির্বিঘ্নে বহির্বিশ্বের কাছে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েলি সরকারি কর্মকর্তা ও ভাষ্যকারদের সঙ্গে আল-জাজিরার সংস্রবের কারণে আরব দুনিয়ায় ইসরায়েল সম্পর্কে যে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তা সম্প্রসারণের সুযোগ পেয়ে যায় নেটওয়ার্কটি। একই সঙ্গে টিভির পর্দায় তারা ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। দখলদারিজনিত ব্যাপক সহিংসতার সময় ইসরায়েল যখন আল-জাজিরাকে সে দেশে কাজ করতে দিল, তাহলে এখন কেন তারা মনে করছে যে জেরুজালেমে আল-জাজিরার উপস্থিতি নিষিদ্ধ করতে হবে? ব্যাপারটা হলো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিষয়ক দুটি তদন্ত হচ্ছে, যেটাকে কিছু গণমাধ্যম সবচেয়ে গুরুতর ‘রাজনৈতিক সংকট’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে। মানুষের দৃষ্টি সেখান থেকে ঘুরিয়ে দিতেই ইসরায়েল এই কাণ্ড করেছে। সম্ভবত নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা ও জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে সহজ বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে আল-জাজিরাকে। অথবা এটাও হতে পারে যে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত আল-জাজিরার বিরদ্ধে যে প্রচারণা শুরু করেছে, ইসরায়েল নিজেও সেই প্রচারণায় যোগ দিচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে যে ইসরায়েলের গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারছেন, কিছু কিছু আরব দেশ কাতার ও আল-জাজিরার বিরুদ্ধে যে আক্রমণ শুরু করেছে, তা আরব বিশ্বের গণপরিসরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সে কারণে ইসরায়েল নিজের মতো করে বিকৃতভাবে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করছে। আরবের সরকারি গণমাধ্যমগুলোতে ইতিবাচক প্রচারণা পাওয়াই তার লক্ষ্য। ইসরায়েলের যোগাযোগমন্ত্রী আইয়ুব কারা এর যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় অভিযোগ তুলেছেন, আল-জাজিরার কারণে ‘ইসরায়েলের সেরা সন্তানদের জীবনহানি ঘটেছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমরা যখন দেখছি, এসব দেশ এটা সত্য বলে ধরে নিয়েছে যে আল-জাজিরা আইএস, হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরানের ক্রীড়নক, যেটা আমরা মনে করি না, সে ক্ষেত্রে এখানে হাস্যকর কিছু ঘটছে।’ আল-জাজিরার কারণে ইসরায়েলি সেনারা মারা পড়ছে, এই অভিযোগের অসাড়তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। ইসরায়েল কীভাবে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আরব নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর জোটের মধ্যে নিজেকে স্থাপন করছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। আবার এমনও হতে পারে যে ইসরায়েলি সরকার আরব দেশের সঙ্গে এতটা ভালো ও খোলামেলা সম্পর্ক তৈরি করেছে যে তার আর আল-জাজিরার দর্শকদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সম্ভবত ইসরায়েলি সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে আরবদের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগের দরকার নেই। কারণ, তীব্র উদারনীতিবাদ, সেন্সরশিপ ও উপদলীয় রাজনীতির উত্থানে এ-জাতীয় নীতি অনর্থক হয়ে পড়েছে। ওদিকে আরবের গণপরিসরে মানুষের মনোভাব বদলে গেছে। অর্থাৎ অনেক আরব নাগরিকই এখন ইসরায়েল ও দখলদারি নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে কারণে আল-জাজিরা ইসরায়েলি নাগরিকদের যে প্রচারণা দিত, সেটাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। আরও একটি সম্ভাবনা আছে, সেটা হলো আল-জাজিরা আগের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে দখলদারির বিরুদ্ধে যে বয়কট ডাইভেস্টমেন্ট স্যাংশনস আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তার কারণ হচ্ছে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারি তীব্র হওয়া—এই মর্মে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে, তার বড় ভূমিকা রয়েছে। আল-জাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ান-এর মতো আর কোনো সংবাদমাধ্যম দখলদারির বাস্তবতা বিশ্বদরবারে এতটা তুলে ধরতে পারেনি। অর্থাৎ আল-জাজিরার প্রচারণার কারণে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে, সে কারণেই হয়তো তাকে নিষিদ্ধের চেষ্টা চলছে। কারণ, তারা গাজার ওপর সর্বাত্মক হামলা চালালে বা পশ্চিম তীরের ভূমি দখল করলে আল-জাজিরাতেই খবর আসে। কিন্তু এই সমালোচনা তারা আর সহ্য করতে পারছে না। ইসরায়েলের নীতি পরিবর্তনের কারণ যা-ই হোক না কেন, আল-জাজিরাকে জেরুজালেম থেকে চলে যেতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, ইসরায়েলের কৌশলগতহিসাব-নিকাশে পরিবর্তন এসেছে। এটা শুধু গণমাধ্যমের স্বাধীনতারই ব্যাপার নয়, উদ্বেগের আরও গুরুতর কারণ হচ্ছে, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ লেগে যেতে পারে।
আল-জাজিরা অনলাইন থেকে নেওয়া, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
মার্ক লে ভাইন: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ইতিহাসের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.