নিহত ১২ আহত ৭৪ : বাঙালি পরিবার নিখোঁজ

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে একটি বহুতল ভবনে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে পুলিশ। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগুনে কমপক্ষে ৭৪ জন আহত হয়েছেন। আহতদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২০ জনের অবস্থা গুরুতর বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে শহরের পশ্চিম অঞ্চলের ল্যাটিমার রোড এলাকার গ্রেনফেল টাওয়ার নামে ওই ভবনে আগুন লাগে। আগুন লাগার সময় ২৭ তলার ওই আবাসিক ভবনের লোকজন ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। এতে বহু মানুষ ওই ভবনে আটকা পড়েন। আটকে পড়া মানুষসহ ভবনটি যে কোনো মুহূর্তে ধসে পড়তে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৯৭৪ সালে নির্মিত আবাসিক এই ভবন নটিংহিলের কাছে অবস্থিত। ভবনে ১২০টি আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে। ভবনটির ৪র্থ তলা থেকে গভীর রাতে আগুনের সূত্রপাত হয়। দ্রুত আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে।
এ সময় আবাসিক ফ্ল্যাটগুলোতে অধিকাংশ লোকজন ঘুমিয়ে ছিলেন। আগুন লাগার খবরে তারা ফ্ল্যাট থেকে বের হওয়ার জন্য দিগি¦দিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। দরজার কড়া নেড়ে এক বাসা থেকে অন্য বাসায় আগুন লাগার খবর দেন বাসিন্দারা। দ্রুত কিছু মানুষ নেমে আসতে সক্ষম হলেও অধিকাংশ লোকজন আটকা পড়েন। ডেইলি মেইলের খবরে বলা হয়েছে, আগুন লাগার পর অন্তত ৬০০ বাসিন্দা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছোটাছুটি শুরু করেন। মৃত্যু ও দগ্ধ হওয়া থেকে বাঁচতে বহু বাসিন্দা জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছেন। কেউ কেউ শিশু সন্তানদের ছুড়ে মেরেছেন। এ সময় চারদিকে শুধু আর্তনাদ ও বাঁচার আকুতি লক্ষ্য করা গেছে। ‘হেল্প হেল্প’ চিৎকারে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ৪০টি ফায়ার ইঞ্জিন নিয়ে প্রায় ২০০ দমকল কর্মী আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করেন। ঘটনাস্থলে ২০টির মতো অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। আগুন নেভাতে এখন পর্যন্ত ৪০টি ফায়ার ইঞ্জিন পাঠানো হয়েছে। আগুন লাগার ১২ ঘণ্টা পর এ রিপোর্ট লেখার সময় আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছিল। চারদিক থেকে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছিল। পুলিশ বলেছে, এখনও বহু লোক ভবনে আটকা রয়েছে। তাদের সরিয়ে নেয়ার কাজ চলছে। ভবনটিতে আগুন জ্বলছিল এবং এটি ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আগুন লাগার পর থেকে দমকল কর্মীরা বহু মানুষকে উদ্ধার করেছেন। তবে লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছেন, বহু মানুষের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক সংবাদ সম্মেলনে লন্ডন দমকল বাহিনীর কমিশনার ড্যানি কটন বলেন, এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। দমকল কর্মী হিসেবে আমার ২৯ বছরের অভিজ্ঞতায় এ ধরনের ব্যাপক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমি আর দেখিনি। আগুন লাগার কারণ উদঘাটন করা যায়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি।
মধ্যরাতের পর ভবনটিতে আগুন লাগার সময় সেখানে কয়েকশ’ মানুষ ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদেও বেশির ভাগই ঘুমাচ্ছিলেন। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমান্ডার স্টুয়ার্ট কান্ডি বলেছেন, তিনি ১২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়েছেন। কিন্তু এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত আহত ৭০ জনের বেশি মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে লন্ডন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস। এদের শহরের পাঁচটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে তারা। আহতদের অন্তত ২০ জনের অবস্থা গুরুতর। এদের মধ্যে বেশির ভাগই অগ্নিদগ্ধ, শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়াসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে দগ্ধ হয়েছেন। এদিকে বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস ৩০ জন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে পাঠানোর তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসা ছবি ও ভিডিওতে নিচ থেকে পুরো ভবনটিই জ্বলতে দেখা গেছে। বিবিসির একজন প্রতিবেদক ঘটনাস্থল থেকে জানিয়েছিলেন, জ্বলন্ত ভবনটি থেকে বিভিন্ন অংশ খুলে নিচে পড়ছে। সেখান থেকে বিস্ফোরণ আর কাচ ভাঙার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ভবনটি ভেঙে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় পুলিশ আশপাশ থেকে সবাইকে সরিয়ে দিচ্ছে। চ্যানেল ফোরের উপস্থাপক জর্জ ক্লার্ক বিবিসিকে বলেছেন, ভবনটি থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে দাঁড়ানো অবস্থাতেও তার মনে হচ্ছিল তিনি হয়তো ছাইয়ে ঢাকা পড়ে যাবেন। ক্লার্ক জানান, ভবনে আটকা পড়া একজনকে তিনি ওপর থেকে টর্চের আলো দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেও দেখেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার খবর শুনে ছয় মিনিটের মধ্যেই প্রথম অগ্নিনির্বাপক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। আগুনের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে র বাইরে চলে যাওয়ায় লন্ডনের বিভিন্ন স্থান থেকে আরও অগ্নিনির্বাপক দল যোগ দেয় আগুন নেভানোর এবং ভেতরে আটকা পড়া বাসিন্দাদের উদ্ধারে। এ সময় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আগুন থেকে বাঁচার জন্য হাত নেড়ে বাইরের সাহায্য চেয়ে ‘ হেল্প হেল্প’ বলে চিৎকার করতে থাকেন ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা। সাহায্য না পেয়ে প্রাণভয়ে জানালা দিয়ে নিচে লাফ দেন কেউ কেউ। ভবনটির চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়। আগুন যতই ওপরের দিকে উঠছিল ততই কালো ধোঁয়া আর ছাই আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। প্লাস্টিক পোড়া দুর্গন্ধ আর বিস্ফোরণের বিকট শব্দ তখন শুনতে আশপাশে থাকা লোকজন। আগুন লাগার সময় বহুতল ভবনটির মেইন গেটটি বন্ধ ছিল। বাইরে থাকা গেট ছিল আটকানো। দমকল বাহিনীর লোকজন এসে তা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে।
ভবন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে গুরুতর জখম হয়েছেন অনেকে। ৯ম তলা থেকে এক বাসিন্দা তার নবজাতককে নিচে জনতার উদ্দেশে ছুড়ে মারেন। শিশুটি প্রাণে রক্ষা পেলেও তার মায়ের অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়নি। ভবনের ১১ তলা দিয়ে উদ্ধারকারী দল প্রবেশ করে আটক পড়া লোকদের বের করে আনেন। আগুন থেকে বাঁচতে ভবনের ছাদে আশ্রয় নেন অনেকে। তাদের কেউ কেউ লাফিয়ে পড়েন। ভবন থেকে উদ্ধার করা লোকদের স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টার, চার্চ, স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সর্বস্তরের মানুষ তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। আশপাশের ভবনগুলো থেকে অনেকে কম্বল, বালিশ, পানি, শুকনো খাবার নিয়ে ছুটে এসেছেন ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে। বড় বড় সুপার স্টোরও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার পাঠিয়েছে। সরকার আশ্রয় নেয়া লোকদের দ্রুত অন্যত্র বাসা খুঁজে দিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন। লন্ডন মেয়র সাদিক খান বলেছেন, ‘ঘটনাটি ভয়াবহ’। ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। ভবনটি পশ্চিম লন্ডনের নটিংহিলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পাশে। এই এলাকা দিয়ে বেশ কয়েকটি হাইওয়ে অন্য শহরে চলে গেছে। শেফার্ড বোস হাইওয়েটির পাশ দিয়ে গেছে। ঘটনার পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই হাইওয়েগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাতাল রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি লাইন ঘটনার পর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়। ঘটনাস্থলে শতাধিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
বাঙালি পরিবার নিখোঁজ : লন্ডনে আগুন লাগা গ্রেনফেল টাওয়ারে বসবাসরত একটি বাঙালি পরিবারের খোঁজ মিলছে না। ভবনটির একটি ফ্ল্যাটে কমরু মিয়া, তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। ভবনটির ১৪২ নম্বর ফ্ল্যাটে কমরু মিয়ার পরিবার থাকে বলে তার স্বজনরা জানিয়েছেন। কমরু মিয়ার ভাতিজা ব্রিটেনের চেলসির বাসিন্দা আবদুর রহিম বুধবার গণমাধ্যমকে বলেন, আগুন লাগার পর রাতে তার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার টেলিফোনে কথা হয়েছিল। তখন তিনি বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন। আবদুর রহিম বলেন, রাত আড়াইটার দিকে তানিমার (হাসনা বেগম তানিমা) সঙ্গে কথা হয়। তার আকুতি এখনও আমার কানে ভাসে। সে বলছিল, ‘আমরা সবাই এখন বাথরুমে, আমাদের বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, দোয়া করেন আমাদের যেন কষ্টে মৃত্যু না হয়।’ ৯০ বছর বয়সী কমরু মিয়া বছরখানেক আগে সপরিবারে ওই ভবনে ওঠেন বলে জানান রহিম। কমরুর বড় ছেলে আবদুল হাকিম তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকেন। অন্য দুই ছেলে আবদুল হামিদ, আবদুুল হানিফ ও মেয়ে তানিমা বাবা-মার সঙ্গে থাকেন। তাদের কারও মোবাইল ফোনেই রাত আড়াইটার পর থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে রহিম জানান। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেই এখনও কোনো খবর পাননি বলে রহিম জানান।
লন্ডনে আগুনে হতাহতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে আবাসিক ভবনে আগুনে হতাহতের ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সুইডেনের পথে বর্তমানে লন্ডনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের কাছে পাঠানো এক বার্তায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমি গ্রিনফেল টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় গভীরভাবে দুঃখিত। ফায়ার সার্ভিসের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় এ দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস পাবে বলে আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী। তিনি আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। তিনি এই সংকটকালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তার সরকারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে সমভাবে ব্যথিত।

No comments

Powered by Blogger.