এ যেন ‘ভৌতিক সিনেমা’

লন্ডন শহরের নর্থ কেনসিংটনে অবস্থিত ‘গ্রেনফেল টাওয়ার’ নামের একটি আবাসিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর বেঁচে যাওয়া বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। তারা জানান, পুরো ভবনই এখন আগুনের গোলা। ওই ভবনের সাত তলার বাসিন্দা পল মুনাকর কোনোভাবে ভবন থেকে বাইরে বের হয়ে আসেন। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম, তখন দেখলাম দমকলকর্মীরা ওপরে উঠছে। তারা আগুনের মধ্যে ঢুকে যেভাবে পারছে মানুষকে বের করে আনার চেষ্টা করছে।’ তিনি জানান, ভবনে যে আগুন লেগেছে, সেটা কিন্তু তিনি ফায়ার অ্যালার্মের মাধ্যমে বুঝেননি। রাস্তায় থাকা মানুষ চিৎকার করে বলছিল- ‘ঝাঁপ দিও না, ঝাঁপ দিও না’, তখন তিনি বুঝতে পারলেন যে ভবনে আগুন লেগেছে। তিনি বলেন, ‘আগুন থেকে বাঁচার জন্য কত মানুষ নিচে ঝাঁপ দিয়েছে আমি জানি না। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এটাই যে ভবনের ফায়ার অ্যালার্ম বাজেনি।’ অন্যদিকে জর্ডি মার্টিন নামে আরেকজন জানান, আগুন দেখার পর প্রথমে তিনি দৌড়ে ভবনটির কাছে গিয়ে বাসিন্দাদের বেরিয়ে আসতে বলেন। তিনি বলেন, ‘আমি একজনকে পড়ে যেতে দেখেছি, শিশু কোলে এক নারীকে দেখেছি জানালার ধারে চিৎকার করছিল...।’ মার্টিন বলেন, ‘আমি সবাইকে বাইরে বের হতে বললেও ভবনে আটকে থাকা লোকজন চিৎকার করে বলছিলেন তাদের বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। কারণ করিডোরের ভেতরের পুরোটা ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল সে সময়।’ অন্যদিকে বিবিসির সংবাদদাতা অ্যান্ডি মুর বলেন, ‘ভবন থেকে ধ্বংসাবশেষ পড়তে দেখছি। আমরা বড় বিস্ফোরণের শব্দও শুনেছি। কাচ ভাঙার শব্দও পেয়েছি।’" জর্জ ক্লার্ক নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসি রেডিও ফাইভকে জানান, ‘আমার সারা গায়ে ছাই লেগে গেছে। আগুনটা কত ভয়াবহ হতে পারে চিন্তা করুন। আমি প্রায় ১০০ মিটার দূরে এবং পুরোপুরি ছাইয়ে ঢেকে গেছি। এটা অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। আমি দেখেছি, ভবনের ওপরের দিকে কেউ টর্চ জ্বালাচ্ছিল। তারা অবশ্যই বের হতে পারেনি। হয়তো তারা বেঁচে নেই।’ ভবনের বাসিন্দা আদিব জানান, তিনি, তার তিন কন্যা ও স্ত্রী নয়তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে সক্ষম হয়েছেন। তার মতে, ‘মনে হয়েছিল এটা যেন কোনো হরর মুভি (ভৌতিক সিনেমা)। সব জায়গা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল।’ আদিব জানান, তিনি ফায়ার অ্যালার্ম শোনেননি। তার মেয়ে তাকে ঘুম থেকে জাগায়। আদিবের জন্মস্থান সিরিয়ায়। তবে ১৬ বছর ধরে তিনি ব্রিটেনে আছেন। লন্ডনের ফায়ার কমিশনার ড্যানি কটন বলেন, ‘এটা একটা নজিরবিহীন ঘটনা। আমার ২৯ বছরের ফায়ার সার্ভিসের জীবনে এই মাত্রার কোনো অগ্নিকাণ্ড দেখিনি।’
বিবিসির সাইমন লেডারমেন জানান, ভবনটি যেভাবে জ্বলছে, তা কয়েক মাইল দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লন্ডন ফায়ার ব্রিগেডের অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার ডেন ডেলি বলছেন, পরিস্থিতি ভয়াবহ। এমন জটিল পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছেন দমকলকর্মীরা। তিনি বলেন, ‘অনেক বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এটি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।’ আগুনের এ ঘটনার পর লন্ডন পাতাল রেলের হ্যামারস্মিথ এবং সিটি অ্যান্ড সার্কেল লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তারা ছাদের ওপর থেকে আলো নাড়ানো দেখেছেন। ভবনে থাকা লোকজন ছাদের ওপর থেকে টর্চের আলো দিয়ে সাহায্যও চেয়েছেন। আর্তনাদও তারা শুনতে পেয়েছেন। দ্য টেলিগ্রাফ জানায়, প্রত্যক্ষদর্শীরা এ নিয়ে টুইট করছেন। ফাবিও বেবের লিখেছেন, ভবনটির একপাশে যখন আগুন লাগে তখন অন্যপাশ থেকে সাহায্যের জন্য আর্তনাদ ভেসে আসছিল। কেউ কেউ বেডশিটে শরীর ঢেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। অন্যরা নিজেদের অবস্থান জানান দিতে টর্চ লাইট বা মোবাইল ফোনের লাইট জ্বালিয়ে অগ্নিনির্বাপণকারী বা উদ্ধারকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিলেন। চ্যানেল ফোরের অ্যামেজিং স্পেসেস অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জর্জ ক্লার্ক বলেন, আমি সাইরেনের শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হল গাড়ির হর্ন বাজছে। ঘটনাস্থল থেকে আমি প্রায় ১০০ মিটার দূরে। কিন্তু ততক্ষণে ছাইয়ে ঢাকা পড়েছি আমি। আমি দেখতে পাই, কেউ ভবনটির একদম উপরতলা থেকে টর্চ জ্বালিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। নিশ্চয় এ মানুষগুলো সেখান থেকে বেরুতে পারেনি। তাদের কী অবস্থা হয়েছে, কেউ বলতে পারছে না এ মুহূর্তে। অভিনেতা, লেখক টিম ডাউনি বসবাস করেন এই টাওয়ারটির পাশেই। তিনি বলেন, মুহূর্তেই পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। সারাটা ভবন গ্রাস করেছে আগুন। ভয়াবহভাবে পুড়ে গেছে এ ভবন। আমার জীবনে আমি এমন ঘটনা দেখিনি। চারদিকে পোড়া গন্ধ। সব কিছু পুড়ছে। আর তাপ? ধারে-কাছে ঘেঁষা যায় না।

No comments

Powered by Blogger.