পাহাড়ের কোল ছাড়তে পারছে না ঝুঁকিতে থাকা মানুষ

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বাস করছেন অর্ধ লাধিক মানুষ। এরই মধ্যে গত ১০ বছরে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে নিহত হয়েছেন নারী ও শিশুসহ তিন শতাধিক মানুষ। কিন্তু স্থায়ী পুনর্বাসনের অভাবে মৃত্যুঝুঁকি নিয়েও পাহাড়ের কোল ছাড়ছেন না সেখানে বসতি স্থাপনকারীরা। জানা গেছে, অন্যত্র গিয়ে বসবাসের কোনো জায়গা না থাকার কারণেই মূলত তারা পাহাড়ের কোলে ঝুঁকি নিয়ে হলেও বসবাস করছেন। সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা না থাকায় তাদের অন্যত্র সরানো যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। তবে চট্টগ্রাম সিটি কনপোরেশন তাদের মালিকানাধীন টাইগারপাস পাহাড়ের কোলে বসবাসকারী প্রায় ২০০ পরিবারকে স্লাম অ্যাপার্টমেন্টে পুনর্বাসনের মাধ্যমে সরিয়ে নেয়া উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে। নগরীর কৈবল্যধাম, বাটালিহিল, এ কে খান, মতিঝর্না, আরেফিননগর, রৌফাবাদ, আমিন কলোনি, বনপাহাড়, টাইগারপাস পাহাড়, কুসুমবাগ পোড়া কলোনি, ফিরোজশাহ পাহাড়, ক্যান্টনমেন্টসংলগ্ন লেবুবাগান পাহাড়সহ বিস্তীর্ণ পাহাড়ের কোলে অর্ধলাধিক মানুষ বাস করে। বাংলাদেশ রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ওয়াসা, গণপূর্ত বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এসব পাহাড়ের মালিক। ইতোমধ্যে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাসকারীদের সরিয়ে নিতে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি কাজ করলেও তা মূলত তেমন কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না। জেলা প্রশাসনের প থেকে অভিযান চালানো হলেও অভিযানের পর আবারো সেখানে বসবাসকারীরা ফিরে যান। মূলত কোনো স্থানে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসন করা না হলে এই মৃত্যুর মিছিল যেন থামানো যাবে না। জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী ১৩টি পাহাড়কে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেখানে প্রায় দেড় হাজার পরিবার মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে। গত মঙ্গলবারের পাহাড়ধসে নিহতরা ছাড়াও গত ১০ বছরে দুই শতাধিক মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে পাহাড়ধসে। এর আগে সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটে চট্টগ্রাম সেনা নিবাসের দুধুরে লেবুবাগান পাহাড়ে ২০০৭ সালের ১১ জুন ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনায়।
২০১১ সালের ১ জুলাই নগরীর বাটালিহিলে পাহাড়ের মাটি কেড়ে নেয় ১৭ বনি আদমের জীবন। ২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর চার স্থানে পাহাড়ধসে ২৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইস্পাহানি মোড় এলাকায় ও ২৯ জুলাই লালখান বাজার ট্যাংকির পাহাড় এলাকায় পাহাড়ধসে তিনজনের মৃত্যু ঘটে। ২০১৪ সালের নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ধসে তিনজনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালে লালখান বাজার ও বায়েজিদ এলাকায় দেয়াল চাপায় এবং পাহাড়ধসে মা-মেয়েসহ ছয়জনের করুণ মৃত্যু ঘটে। প্রতি বছরই পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে জীবনহানির ঘটনা ঘটে। জীবনহানির বাইরে সম্পদহানিও ঘটছে প্রতিনিয়ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাহাড়ের মাটিচাপায় মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে পাহাড়কে যথাসম্ভব বসতিমুক্ত রাখা, পাহাড় কর্তন রোধে জোরদার মনিটরিং, পাহাড় কাটার শাস্তির বিধানে কঠোরতা, পাহাড়ের ভারসাম্য অুণœ রাখতে নিয়মিত পরিচর্যা, পাহাড়ের আশপাশে আর যেন বসতি কিংবা স্থাপনা গড়তে না পারে সে বিষয়কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া এবং পুনর্বাসনের মাধ্যমে এসব এরিয়ায় অবস্থানরতদের সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দিকে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে তেমন কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেই এমন অভিযোগ উঠেছে। ২০০৭ সালে পাহাড়ধসে ১২৭ জনের প্রাণহানির ঘটনায় উচ্চমতাসম্পন্ন একটি কমিটি করা হয়েছিল। ওই কমিটি পাহাড়ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করে ৩৬টি সুপারিশ দিয়েছিল। কিন্তু সেসব সুপারিশ কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকল, বাস্তবায়ন হয়নি ১০ বছরেও। ওই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা নিলে হয়তো সোমবার মধ্যরাত ও মঙ্গলবার ভোরে চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে পাহাড়ধসে মৃত্যুর মিছিল কিছুটা হলেও থামানো যেত। ওই কমিটি কর্তৃক পাহাড়ধসের অন্যতম কারণের মধ্যে ভারী বর্ষণ, চট্টগ্রামের পাহাড়ে বালুর আধিক্য, গাছ কেটে ভারসাম্য নষ্ট করা, পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস গড়ে তোলা, পাহাড় থেকে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখা অন্যতম। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের বক্তব্য : চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের প থেকে বলা হয়েছেÑ বিগত দুই দিন ধরে ভারী বর্ষণে চট্টগ্রাম জেলার রাউজান, রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলার ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ধস হয়েছে। জেলা প্রশাসন ভারী বর্ষণের আবহাওয়ার পূর্বাভাস পেয়েই চট্টগ্রাম মহানগরীর এবং উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাসরত লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে ক্রমাগতভাবে ব্যাপক মাইকিং করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ ছাড়া স্থানীয় ক্যাবল টিভি চ্যানেলে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে আহ্বান জানানো হয়। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)’গণদের সমন্বয়ে গঠিত ২ টিম চট্টগ্রাম মহানগরীর মতিঝর্না, এ কে খান ও বায়েজিদ এলাকাসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি বসতি থেকে দেড় শতাধিক পরিবার বা ৭৫০ জনকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। উপজেলাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, রাঙ্গুনিয়ায় ৫৮০টি পরিবারের ২০০০ জন, চন্দনাইশে ৫০টি পরিবারের ২৫০ জনসহ মোট প্রায় তিন হাজার জনকে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় ও এর আশপাশ থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। বান্দরবান সংবাদদাতা জানান, বান্দরবান শহরের কাছে লেমুঝিড়ি আমতল ঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে মাটিচাপা পড়া মা-মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার দুপুরে সেনাবাহিনী, দমকল বাহিনী ও স্থানীয় লোকজন তল্লাশি চালিয়ে লাশ দু’টি উদ্ধার করেন। মঙ্গলবার ভোরে প্রবল বৃষ্টির সময় লেমুঝিড়ি আমতল ঘোনা এলাকায় পাহাড়ধসে কৃষক মো: আজিজুর রহমানের স্ত্রী কামরুন্নাহার বেগম (৪০) ও তার সাত বছরের মেয়ে সুখিয়া বেগম মাটিচাপা পড়ে। দুই দিন তল্লাশির পর গতকাল লাশ দু’টি উদ্ধার করা হয়। বান্দরবান দমকল বাহিনীর স্টেশন অফিসার তরিকুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার ভোর থেকেই তল্লাশি চালানো হয়। পরে বুধবার সকালে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অনেক মাটি সরিয়ে লাশ দু’টি উদ্ধার করা হয়। এ দিকে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুপুরে বান্দরবানের পাহাড়ধসে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরে তিনি শহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। জেলা পুলিশের পক্ষ হতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি না হওয়ায় বান্দরবানের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। নি¤œাঞ্চল থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। শহরের ১২টি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে লোকজন তাদের বসতবাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। তবে বসতঘরগুলো কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাকখালী নদীর পানি কমতে থাকায় জেলা সদরের সাথে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ চালু হয়েছে। এ ছাড়া রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানছি উপজেলার সাথেও সড়ক যোগাযোগ চালু হয়েছে। তবে এসব এলাকায় এখনো বিদ্যুৎ নেই। বান্দরবানের আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সেনাবাহিনী, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও খিচুড়ি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে ২০ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য, মঙ্গলবার ভোরে প্রবল বর্ষণের সময় বান্দরবানে তিন স্থানে পাহাড়ধসে একই পরিবারের তিন শিশুসহ ছয়জন নিহত হয়।
লক্ষীছড়ি (খাগড়াছড়ি) সংবাদদাতা জানান, টানা বর্ষণে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার দুর্গম বর্মাছড়ি ইউনিয়নে মঙ্গলবার পাহাড়ধসে এক নারীসহ দু’জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। লক্ষ্মীছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র চাকমা এ প্রতিনিধিকে বলেন, বর্মাছড়ি ইউনিয়নের ফুত্যাছড়া পাড়ার প্রাণকৃত্য চাকমার ছেলে পরিমল চাকমা (৩০) পাহাড়ধসে মাটিচাপায় নিহত হন। একই পরিবারের শিশু ও নারীসহ সাতাত্বক আহত হন। ঘটনাটি মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ঘটলেও ছড়া ও খাল পানিতে ভরে হয়ে যাওয়ায় তাদেরকে হাসপাতালে আনা সম্ভব হয়নি। বুধবার সকালে তাদের লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। লক্ষ্মীছড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতরা হলেন, মধ্যম বর্মাছড়ি পাড়ার সজিব চাকমার স্ত্রী রজমালা চাকমা (২৪), তার ৯ বছরের মেয়ে পার্কি চাকমা ও ৬ বছরের শিশু তুষি চাকমা। সড়ক যোগাযোগ না থাকায় মারাত্মক আহত অবস্থায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন একই গ্রামের ধনঞ্জয় চাকমা (৬৫), তার স্ত্রী তিতুর বালা চাকমা (৫৫), মেয়ে সাবেত্রী চাকমা (৪০) ও সাবেত্রীর ছেলে এপিন চাকমা। তাদেরকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই পরিবারের একমাত্র সুস্থ সদস্য সজিব চাকমা বলেন, আমি এখন নিরুপায়, বাড়ির সবাই পাহাড়ের মাটিচাপা পড়ে আহত হয়েছে। আহত আরো দুজনের নাম জানা যায়নি। এ দিকে বর্মাছড়ির কালুখালী সীমান্তে হলুদ্যা পাড়ার বড়ইতলী এলাকার পতুল্যা চাকমার স্ত্রী কালেন্দ্রী চাকমা (৪৫) মাটিচাপায় নিহত ও পতুল্যা চাকমা আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ ইকবাল বলেন, পাহাড়ধসে দুজন নিহত হবার খবর তিনি শুনেছেন। ঘটনাস্থল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে। দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি বলে তিনি জানান। তবে অপর একটি সূত্রে জানা গেছে, এ দুর্ঘটনা কাউখালী উপজেলায় ঘটেছে। লক্ষ্মীছড়ি থানার অফিসার ইনচার্জ আরিফ ইকবাল পাহাড়ধসের ঘটনায় মৃত্যুর খবর শুনেছেন বলে জানান। কক্সবাজার (দক্ষিণ) সংবাদদাতা জানান, কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড় ধ্বসে বাবা-মেয়ে নিহত হয়েছে। গতকাল ভোরে উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের সাতঘরিয়াপাড়ার মোহাম্মদ সেলিমের বসতবাড়ির ওপর পাহাড় ধসে পড়লে ঘুমন্ত অবস্থায় গৃহকর্তা সেলিম ও তার শিশুকন্যা তিশামণির মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা পাহাড়ের মাটি সরিয়ে বাবা-মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছেন। হোয়াইক্যং মডেল ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, ভোররাতে ভারী বর্ষণ ও বজ্রপাতের সময় পাহাড়ের অংশবিশেষ ধসে সেলিমের বসতবাড়ির একটি অংশের ওপর পড়ে। এতে সেলিম ও তার শিশুকন্যা তিশামণি নিহত হয়েছে। স্থানীয় লোকজন মাটি সরিয়ে বাবা-মেয়েকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করেছেন।

No comments

Powered by Blogger.