সরকারের ভুলে রাজপথে সরব বিএনপি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হঠাৎ পুলিশি তল্লাশির ঘটনায় অনেকটাই চাপের মুখে শাসক দল আওয়ামী লীগ। ঘটনার পর এ ইস্যুতে প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত তারা। কার কথায়, কী কারণে হঠাৎ এ ধরনের বিতর্কিত তল্লাশি এবং এ থেকে প্রাপ্তিটা কী- এ প্রশ্ন খোদ শাসক দলটির ভেতরেও ঘুরপাক খাচ্ছে। দেশ-বিদেশেও সরকারের এ ভূমিকা নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন তারা। বিএনপিও এ ইস্যুকে পুঁজি করে রাজনীতির মাঠ গরম করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, সরকারের এক ভুলকে কাজে লাগিয়ে রোববার দেশজুড়ে মাঠে নামার সুযোগ পেয়ে যায় বিএনপি। এভাবে তারা নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে পেরেছে। মাঠের রাজনীতিতে অনেকদিন নিষ্ক্রিয় থাকা দলটি এ ইস্যুতে বেশ খানিকটা সক্রিয় হতে পেরেছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক নানা প্রেক্ষাপট বিচেনায় তারা মনে করেন, এরকম আরও ভুলের কারণে ডিসেম্বর নাগাদ বিএনপিকে রাজপথে নতুন রূপে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। প্রসঙ্গত শনিবার অনেকটা আকস্মিকভাবেই বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে তল্লাশি অভিযান চালায় পুলিশ। কিন্তু সাতসকালে দেড় ঘণ্টার এ অভিযান শেষে খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের। হঠাৎ এই তল্লাশি অভিযান সাধারণ মানুষের অনেকেই ভালোভাবে নেয়নি। যদিও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে এ অভিযান চালানো হয়। এদিকে এ ধরনের অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
সূত্র জানায়, সরকারের ভেতরে-বাইরেও এর কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকে এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। কেননা পুুলিশের যে অভিযানে সরকার রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাকে খাটো করে দেখতে চান না তারা। এ প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দেশের একজন শীর্ষ নেত্রীর কার্যালয়ে এ ধরনের তল্লাশির বিষয়টি দুঃখজনক। এ ঘটনায় জনমনে একটি ধারণা স্পষ্ট হয়েছে, আর তা হল- আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। তা না হলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত তাদের জন্যই আত্মঘাতী হবে।’ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এ ধরনের তল্লাশি স্রেফ হয়রানির উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক। সরকার আসলে তল্লাশির নামে বিএনপিকে ভয় দেখাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকারকে একটি মহল ভুল পরামর্শ দিয়ে এসব কাজ করাচ্ছে। অতি উৎসাহী এ চক্রটি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য যথেষ্ট। আর বিএনপির শুধু বিক্ষোভ মিছিল করে প্রতিবাদ নয়, এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার রাস্তায় বের হয়ে আসা উচিত।’ জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘একটি রাজনৈতিক দল, যার প্রধান তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তার কার্যালয়ে এভাবে তল্লাশি চালানো কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। এর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থা আরও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, সরকার ও প্রশাসনের ভেতরে থাকা অতি উৎসাহীদের কাজ এটা। এ চক্রটি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে কাজ করছে। আমার মনে হয়, এরা বিএনপির হাতে আন্দোলনের ইস্যু তুলে দিতেই এ কাজ করেছে। বিএনপিও এ ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে মাঠ গরম করবে।’ বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা হলেও তারা এ ইস্যুতে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
রোববার এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। অন্য কোনো নেতা এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি নন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একটি শরিক দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা এ দেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় অপারেশন ক্লিনহার্টের অজুহাতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির কার্যালয়েও তল্লাশি চালানো হয়েছিল।’ বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের একাধিক নেতার মতে, হঠাৎ এ তল্লাশির মাধ্যমে সরকার একটি বার্তা দিতে চেয়েছে। তা হল- তারা বিএনপিকে কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। তবে বিএনপি এতে মোটেও ভীত নয়। বরং এর প্রতিবাদে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী রাস্তায় নেমে নিজেদের শানিত করার সুযোগ পেয়েছেন। নাম প্রকাশ না করে তিনি যুগান্তরকে আরও বলেন, ’৯০-এর আন্দোলনে জনগণ বিএনপিকে যেভাবে রাজপথে দেখেছে আবারও সেভাবে দেখবে। গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে তাদের দল ডিসেম্বর নাগাদ রাজপথে শক্ত পাহারা বসাবে। সে জনস্রোত কেউ রুখতে পারবে না। জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, সরকারের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে- তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। আগামী নির্বাচনে সুষ্ঠু পরিবেশ নষ্ট করতেই এ ধরনের তল্লাশি। তিনি আরও বলেন, বিএনপি যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগোচ্ছে, সরকার সেটাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। ড. খন্দকার মোশাররফ বলেন, বিএনপির চেয়ারপারসনকে চাপে রাখা এবং নেতাকর্মীদের হতাশ করার জন্য এটি সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক পদক্ষেপ। তারা বিএনপির ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু ফল উল্টো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.