ভাস্কর চলে গেছে, ভাস্কর্যটি সংরক্ষণ করলেই চলবে

আমার এই কলামটি শিল্পী ও ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করছি। গত ২০ মে রাত ১১.৪৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার অমর কীর্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কলা ভবনের সামনের ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ১০ মে থেকে তিনি ছিলেন লাইফ সাপোর্টে। শেষ পর্যন্ত তার কিডনি অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আমার এক অকৃত্রিম সুহৃদ। ষাটের দশকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। বয়সে বড় হলেও তিনি লেখাপড়ায় আমার পেছনে ছিলেন। আমি যখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন তিনি আর্ট ইন্সটিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আমরা তখন অনেকেই প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সঙ্গে আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্রদের এক রকম সখ্য গড়ে উঠত। আর্ট ইন্সটিটিউটের ছাত্ররা ছাত্র ইউনিয়নের জন্য চমৎকার পোস্টার এঁকে দিত। আবদুল্লাহ খালিদ এরকম এক ডজন পোস্টার রোল করা অবস্থায় আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এভাবেই তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দু’জন দুই বিভাগের শিক্ষক। বিভাগ ভিন্ন হলেও আমাদের মধ্যে চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। আবদুল্লাহ খালিদ প্রায়ই আমার বাসায় আসতেন। তার শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি অত্যন্ত উষ্ণ হৃদয়ের মানুষ ছিলেন।
কখনও কখনও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তেন। খাঁটি শিল্পী মনের অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি কখনও টাকা-পয়সা জমানোর কথা ভাবতেন না। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এজন্য প্রচণ্ড দুঃখবোধও ছিল তার। অপরাজেয় বাংলা গড়তে গিয়ে তিনি ভাস্কর্যে এক নতুন মাধ্যমের সূচনা করেন। চিরাচরিত নিয়ম ছিল পাথর কেটে ভাস্কর্যের রূপ দেয়া। কিন্তু অপরাজেয় বাংলার জন্য তিনি ব্যবহার করেছিলেন সিমেন্ট ও কংক্রিট। হাতুড়ি ও ছেনি দিয়ে কংক্রিটের পাথরতুল্য স্তূপকে কেটে কেটে তিনি তার স্বপ্নের অপরাজেয় বাংলাকে মূর্ত করে তুলেছিলেন। তার এ ভাস্কর্যটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বলতে গেলে এটি হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রতীক। ক্যালেন্ডার, গ্রন্থ, এমনকি বিজ্ঞাপনেও এর ছবি ব্যবহৃত হয়েছে বহুবার। অনাগত দিনগুলোতেও এর ব্যবহার অব্যাহত থাকবে। কী গভীর যত্ন ও আবেগ দিয়ে এ ভাস্কর্যটি তিনি গড়ে তুলেছিলেন তা বোঝা যায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার দেয়া একটি সাক্ষাৎকার থেকে। তিলে তিলে হাতুড়ি দিয়ে ছেনিতে আঘাত করতে গিয়ে তার হাত রক্তাক্ত হতো। মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিতে পারেননি বলে তার গভীর দুঃখবোধ ছিল। তিনি বললেন, বুকের রক্ত ঢেলে দিতে না পারলেও তার দুঃখের কিছু উপশম হতো রক্তাক্ত দুটি হাত দেখে। ভাস্কর্য নির্মাণের পেছনে শুধু শিল্পীর কল্পনা কিংবা স্বপ্ন থাকে না, তারও অধিক থাকে অপরিসীম কষ্ট স্বীকারের বেদনা। আবদুল্লাহ খালিদ শুধু ভাস্কর হিসেবেই তার অবদান রেখে যাননি, অনেক পেইন্টিংও করেছেন। তার পেইন্টিংগুলোতে রঙের অপূর্ব ছটা থাকত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুষ্পের আদলে রঙের অপূর্ব মিশ্রণ ঘটাতেন। এরকম একটি পেইন্টিং তিনি আমাকে ফ্রেমে বাঁধাই করে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। এর জন্য একটি পয়সাও নেননি। সাধারণ শিল্পীরা এরকম একটি পেইন্টিংয়ের জন্য লাখ টাকাও দাবি করে বসেন। জানি না তার হৃদয়ে আমার জন্য কেমন আসন সংরক্ষিত ছিল যে,
শুধু স্মৃতি হিসেবে রাখার জন্যই তিনি এটি আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। অপরাজেয় বাংলার প্রতি অবহেলা দেখে তিনি দুঃখবোধ করতেন। কারণ এ ধরনের ভাস্কর্য কয়েক বছর পর পর সংস্কার করে সংরক্ষণ করতে হয়। আজ থেকে ১০-১১ বছর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে এর সংস্কারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ কাজেও তার কোনো ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি ছিল না। শুধু অপরাজেয় বাংলা নয়, আরও বেশ ক’টি ভাস্কর্য তার হাতে গড়া। এর একটি হল ডলফিন। আজ ভাবি, আবদুল্লাহ খালিদ আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য ভিন্ন জগতে চলে যাওয়ার পর অপরাজেয় বাংলার রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি কোন শিল্পী করবেন? ভবিষ্যতের দিনগুলোতে এটির রক্ষণাবেক্ষণ কতটুকু তার ভাবনা ও কল্পনাকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবে? আবদুল্লাহ খালিদ তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক পেয়েছিলেন। তিনি যদি আরও বড় কোনো স্বীকৃতি পেতেন, তাও তার জন্য বাড়তি কিছু হতো না। কর্মজীবনে আমি তাকে যতটুকু দেখেছি তাতেই বুঝতে পেরেছি আত্মবিক্রয়ের মতো হীন কোনো মানসিকতায় তিনি ভুগতেন না। বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারার কোনো একটির কাছে ঘেঁষার কোনো প্রবণতাই তার মধ্যে ছিল না। তিনি যদি বিশেষ একটি ধারার সঙ্গে যুক্ত হতেন, তাহলে হয়তো তাকে নিয়ে অনেক মাতামাতি হতো। কিন্তু মাতামাতির ঊর্ধ্বে থাকাটাই তিনি পছন্দ করতেন। তার সবচেয়ে প্রশংসনীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যটি হল দেশপ্রেম। যে দেশটি আমাদের পানিবঞ্চিত করে রেখেছে, সেই দেশের প্রতি তার ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। তাই বলে তিনি কখনও প্রকাশ্য সভায় এ ক্ষোভের অভিব্যক্তি ঘটাননি। তার একান্ত ভাবনাগুলো প্রকাশ পেত অন্তরঙ্গ আলাপের মুহূর্তে। গ্রিসের মহাকবি হোমার ছিলেন চারণ কবি। দুঃখ-দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে তার দিন কেটেছে। গান গেয়ে, কবিতা আবৃত্তি করে তিনি ক্ষুধার অন্ন জোগাড় করতেন। নগররাষ্ট্রে বিভক্ত গ্রিসের বিভিন্ন অংশে তিনি ভিক্ষা করে বেড়াতেন। তার মৃত্যুর পর ৭টি নগররাষ্ট্র একবাক্যে দাবি করল হোমার তাদেরই নাগরিক। এ জন্য এক ইংরেজ কবি হোমারের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন, Seven countries claimed the poet, dead/ Through which the poet begged his bread. এ যেন ‘জীবনে যারে দিলে না মালা, মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল’। দুনিয়ার সব দেশের কাব্যভাবনার মধ্যে এক ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ কবিতা হল Emotion Recollected in Tranquility. আবেগ যখন স্মৃতি হয়ে ধরা দেয়, তখন তাই হয়ে ওঠে কবিতা।
এমনকি সুকান্ত যখন কবিতাকে ছুটি দিতে চান, তখনও তার মধ্যে কাজ করে বাস্তবতার নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতার স্মৃতি। আবদুল্লাহ খালিদ যাপিত জীবনে একেবারেই স্বীকৃতি পাননি এমন নয়। তবে সেই স্বীকৃতি অনেকটা মনে হয়েছে ভুল করে দেয়া। তার মধ্যে কতটুকু আন্তরিকতা ও মমতা ছিল বলা কঠিন। জাতি বেঁচে থাকে তার স্মৃতিতে। একটি জাতি তার ঐতিহ্য, বীর পুরুষদের গর্বিত গাথা, তার অর্জন, তার সৃজনশীলতা, সভ্যতায় তার অবদান, তার জীবনযাত্রা, তার গভীর ও ব্যাপকভাবে বাঁচার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকে। যে বাংলাদেশ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত গর্ব করি, ডি এল রায়ের গানের মধ্য দিয়ে আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের প্রয়াস পাই, সেই বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে আমরা কতটুকু আমাদের গৌরবমণ্ডিত স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখতে পারছি? শুধু ইতিহাসের কথা বলে এসব স্মৃতিকে ধরে রাখা যায় না। আমাদের সন্তানেরা ইতিহাসের যে অতি সামান্য অংশ পাঠ করে, সে তো পরীক্ষা পাসের জন্য। এর মধ্যে কতটুকু দেশাত্মবোধ আছে সে প্রশ্ন তোলা হলে অবান্তর কিছু হবে না। আমরা কিছু মানুষ কদাচিৎ যখন মিলিত হওয়ার সুযোগ পাই, তখন দেশের প্রসঙ্গ এসে যায়। একটি বামপন্থী দলের নেতা আমার সঙ্গে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমাকে কিছু কথা বলেছিলেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে একটি বিষয় চালু রয়েছে। এ কোর্সের উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের দেশ সম্পর্কে জানার জন্য কৌতূহলী করে তোলা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়টির কর্তৃপক্ষ একজন জ্ঞানী রাজনৈতিক নেতাকে এ কোর্স পড়ানোর জন্য বেছে নেয়। কারণ হল তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কোর্সের বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হবেন। তার সেই সক্ষমতা আছে বলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি সবিস্তারেই ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাহিনী শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে উপস্থাপন করেছিলেন। শিক্ষার্থীরা কেমন শিখল তা যাচাই করার জন্য একদিন তিনি প্রশ্ন করলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কী হয়েছিল? শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই জবাব দিয়েছিল, সেদিন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান থেকে এসে বাঙালিদের ওপর গুলি চালিয়েছিল! এ জবাব শোনার পর তার মনে হয়েছিল, ধরণী তুমি দ্বিধা হও।
এভাবে জাতির ভবিষ্যৎ যাদের ওপর অর্পিত হবে, তারা যদি স্মৃতি বিভ্রমের শিকার হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতেই হয়। কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা প্রচণ্ড এক অ্যামনেশিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছি। আমাদের জাতীয়তাবোধ এ অ্যামনেশিয়ার বলির শিকার হতে যাচ্ছে। তার চেয়ে সর্বনাশা হল ইতিহাসকে আমরা মনসই করে ভাবতে চাই। এর বড় প্রমাণ হল, একশ’ নব্বই বছরের ইংরেজ শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে আমরা যে স্বাধীনতার পথে বিশাল এক পরিক্রমা সমাপ্ত করেছিলাম, তা ভুলে যাওয়াটাই আমরা শ্রেয় বোধ করি। এভাবে একে একে সব কিছু ভুলে যেতে বসলে একটি পৃথক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে গর্ব করাও আমরা ভুলে যাই কিনা কে জানে! শিল্পী আবদুল্লাহ খালিদ পরম সাধনা, যত্ন ও কষ্টের মধ্য দিয়ে অপরাজেয় বাংলার মতো যে ভাস্কর্যটি গড়ে তুলেছেন তার অন্তর্নিহিত তাগিদ এসেছিল জাতি হিসেবে আমরা যেন বিস্মৃতির কবলে না পড়ি। আবদুল্লাহ খালিদের বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে, যদি তিনি পরপার থেকে দেখতে পান আমরা তাকে ভুলে গেলেও তার মহৎ কর্মের তাৎপর্যটি ভুলে যাইনি। সে জন্যই আজ বেশি করে ভাবতে হবে কী করে বিস্মৃতির বেড়াজাল ছিন্ন করে জাতি হিসেবে আমাদের স্মৃতিকে চিরঅম্লান রাখতে পারব। ব্যক্তিগতভাবে আমার সামান্য চাওয়া আছে। অপরাজেয় বাংলাকে কেউ যেন পোস্টার ও লিখনের জঞ্জাল দিয়ে ঢেকে না দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন সঠিক সময়ান্তরে এর সংরক্ষণ কার্যক্রম মূল চেতনার সঙ্গে সাজুয্য রক্ষা করে অব্যাহত রাখে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.