ট্রাম্পের অভিশংসনের সম্ভাবনা কতটুকু

ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে জিতে গত ২০ জানুয়ারি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন খ্যাতনামা ব্যবসায়ী ও ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্প। দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে। এসব অভিযোগের কারণে আলোচনা-সমালোচনার পাশাপাশি তার অভিশংসনেরও দাবি ওঠে দেশটির বিভিন্ন মহল থেকে। এমনকি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণের আগেই বিরোধীদের মধ্যে ট্রাম্পের অভিশংসনের সম্ভাবনার বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল। এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি কেউ উত্থাপন না করলেও এ নিয়ে গণমাধ্যমসহ মার্কিন রাজনৈতিক মহলে জোর বিতর্ক চলছে। চলতি সপ্তাহেই মার্কিন গণমাধ্যম ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, রাশিয়া ও ট্রাম্পের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের মধ্যকার অবৈধ যোগসাজশ তদন্ত বন্ধ করতে সদ্য বরখাস্ত এফবিআই প্রধান জেমস কমিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একমত না হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করেন ট্রাম্প। এ অভিযোগের ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই অভিযোগ ওঠে, রুশ কর্মকর্তাদের কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছেন ট্রাম্প। এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের অভিশংসনের প্রবল সম্ভাবনা দেখছেন অনেকেই। তবে প্রশ্ন হচ্ছে- মার্কিন একজন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসন করা আসলে কতটা সহজ হবে? এক্ষেত্রে দেখতে হবে অতীতে ঠিক কারা অভিশংসিত হয়েছেন? প্রথমে দেখা যাক অভিশংসনের উদ্দেশ্য কী। যখন কাউকে অভিশংসন করা হয়, তখন এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া। হোক সে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বা অন্য কোনো কর্মকর্তা।
একজন প্রেসিডেন্ট বা কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে কখন অভিশংসন করা যায় তার কারণ ও নিয়মকানুন আমেরিকার সংবিধানে উল্লেখ আছে। দেশটির সংবিধানে বলা আছে, ‘একজন প্রেসিডেন্টকে দেশদ্রোহ, ঘুষ দুর্নীতি অথবা অন্য কোনো বড় অপরাধে বা অপকর্মের কারণে অভিশংসনের মাধ্যমে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে।’ এক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো অপরাধ বা অপকর্মের মধ্যে ঠিক কোন অপরাধগুলো পড়ে- সেটাই বিতর্কের বিষয়। অন্যদিকে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু হতে হবে মার্কিন কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ বা প্রতিনিধি পরিষদের মাধ্যমে এবং এক্ষেত্রে প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মাধ্যমে বিলটি পাস হতে হবে। এখানেই শেষ নয়। এরপর বিলটি কংগ্রেসের সিনেটে যাবে। তবে এখানে প্রেসিডেন্টের অভিশংসনে দুই-তৃতীয়াংশ সিনেটরের ভোট দরকার পড়বে। আর আমেরিকার ইতিহাসে অভিশংসনের ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাইলফলকে কখনই পৌঁছানো যায়নি। এবার দেখা যাক কারা প্রকৃতই অভিশংসিত হয়েছেন। আমেরিকার ইতিহাসে বেশ কয়েকবার অভিশংসন পরিস্থিতি তৈরি হলেও এ যাবত কোনো প্রেসিডেন্টই প্রকৃতপক্ষে অভিশংসিত হননি। এর মধ্যে দুইজন প্রেসিডেন্ট অভিশংসিত হতে হতেও শেষপর্যন্ত বেঁচে যান। অন্যদিকে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জেরে অভিশংসনের আগেই পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। মাত্র ২০ বছর আগে আমেরিকার ৪২তম প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রথমত শপথ ভঙ্গ ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির অপরাধে অভিশংসনের মুখে পড়েন। তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ হিসেবে হোয়াইট হাউসের ইন্টার্নি মনিকা লিউনস্কির সঙ্গে অবৈধ প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি আনা হয়। কিন্তু গ্রান্ড জুরির সামনে মনিকার সঙ্গে সম্পর্কের সত্যতা অস্বীকার করে ক্লিনটন এবং এরপর মনিকাকেও এ ব্যাপারে মিথ্যা বলার জন্য অনুরোধ করলে ক্লিনটনের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রথম অপরাধের জন্য তার অভিশংসনের পক্ষে প্রতিনিধি পরিষদের ২২৮ সদস্য ভোট দেন।
বিপক্ষে ভোট দেন ২০৬ জন। অন্যদিকে দ্বিতীয় অপরাধের পক্ষে ভোট পড়ে ২২১টি এবং বিপক্ষে পড়ে ২১২টি। অর্থাৎ কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে ক্লিনটনের অভিশংসন বিল পাস হয়। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরের এ সময়টিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্লিনটনের জনসমর্থন ছিল ৭২ শতাংশ। তবে ১৯৯৯ সালে বিলটি যখন সিনেটে যায়, তখন এটা পাস হতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিনেটরের ভোট পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে শেষপর্যন্ত অভিশংসনের হাত থেকে বেঁচে যান বিল ক্লিনটন। এ ঘটনার প্রায় ১৩০ বছর আগে প্রকৃত অর্থে যিনি অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্র– জনসন। আমেরিকার ১৭তম প্রেসিডেন্ট তিনি। তিনি ১৮৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুদ্ধমন্ত্রী এডউইন স্টানটনকে অবৈধভাবে বরখাস্তের ১১ দিন পর প্রতিনিধি পরিষদে তার বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রেসিডেন্টের নীতিগত সিদ্ধান্তে অসম্মতি প্রকাশ করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। তবে সিনেটে গিয়ে মাত্র ১ ভোটের ব্যবধানে বিলটি আটকে যায়। এদিক থেকে স্টানটনের চাকরিচ্যুতি সদ্য চাকরিচ্যুত এফবিআইর পরিচালক জেমস কমির সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে। মার্কিন গণমাধ্যমগুলোর অভিযোগ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে একমত না হওয়ায় কমিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পকে কি অভিশংসন করা যাবে? তত্ত্বগত দিক থেকে এর উত্তর হচ্ছে- হ্যাঁ, ট্রাম্পকে অভিশংসন করা যাবে। লফেয়ার ব্লগের লেখকদের মতে, মার্কিন সংবিধান সুরক্ষার যে শপথ তিনি করেছিলেন, তা ভঙ্গ করার অভিযোগে কৌশলগতভাবে তাকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে। তবে বাস্তবে অভিশংসিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। বিবিসির উত্তর আমেরিকা প্রতিবেদক অ্যান্থনি জার্চার বলেন, ‘প্রতিনিধি পরিষদ যদি ডেমোক্রেটিক পার্টির নিয়ন্ত্রণে থাকত, তাহলে ট্রাম্পের অভিশংসন সম্ভব হতো।’ আসল ব্যাপার হচ্ছে,
প্রতিনিধি পরিষদ রিপাবলিকানদের দখলে। এখানে রিপাবলিকান পার্টির ২৩৮ জন সদস্য রয়েছেন। বিপরীতে ডেমোক্রেটদের রয়েছেন ১৯৩ জন। অন্যদিকে ৫২ জন সিনেটর নিয়ে সিনেট নিয়ন্ত্রণ করছে সেই রিপাবলিকান। বর্তমানে ট্রাম্পের জনসমর্থন তলানিতে ঠেকলেও রিপাবলিকানদের বড় অংশই নিজ দলের প্রেসিডেন্টের প্রতি অনুগত। অবশ্য এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রিপাবলিকান দলের ক্রমেই ক্ষোভের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। গত সপ্তাহেই রিপাবলিকান সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কেলেঙ্কারি নিক্সনের ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। রিপাবলিকান সিনেটর সুসান কলিন্স, এমনকি সিনেট নেতা সিনেটর মিচ ম্যাককনেল ট্রাম্পের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। তবে ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনের সময় রিপাবলিকানদের প্রার্থীদের চিন্তা-ভাবনা বদলে যেতে পারে। প্রত্যেক প্রার্থী নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন করবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কি তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন? পরিশেষে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন কিভাবে অভিশংসন এড়িয়ে গেলেন? এর উত্তর হচ্ছে- স্রোত যখন উল্টো বইতে শুরু করে তখন প্রত্যেক বোধসম্পন্ন মানুষ যা করে, নিক্সনও তাই করেছিলেন। অভিশংসন এড়াতে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.