ভাষণটি ছিল বাংলার মানুষের হৃদয়ের অনুরণন by নূরে আলম সিদ্দিকী

১৯৭১-এর ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিপূর্ণ  প্রতীতি ও প্রত্যয় সৃষ্টির লক্ষ্যে সমস্ত জাতীয় চেতনাকে এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ ও অঙ্গীকারবদ্ধ করেছিল। ভাষণটি গোটা জাতিকে এমনভাবে উদ্বেলিত করেছিল যে, পৃথিবীর কোনো একক বক্তৃতায় এরূপ দৃষ্টান্ত আদৌ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেকেই আবেগাপ্লুত হৃদয়ে, অভিভূত চিত্তে ভাষণটিকে গ্যাটিসবার্গে আব্রাহাম লিঙ্কনের বক্তৃতার সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আমি এই তুলনাটি করতে নারাজ। কারণ দুটি বক্তৃতার প্রেক্ষাপট এবং আঙ্গিক ছিল ভিন্নতর। গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত আমেরিকার গৌরবদীপ্ত মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিঙ্কন ওই ভাষণটি দিয়েছিলেন। সামাজিক দুর্যোগের মেঘ সরে গিয়ে যখন আমেরিকার পূর্ব দিগন্তে হাস্যোজ্জ্বল সূর্য উদ্ভাসিত তখন আমেরিকার বিজয়ী নেতা সারা বিশ্বের জন্য জগৎখ্যাত ভাষণটি দেন। কিন্তু ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপটটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলার দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ ছিল ঘন কালো মেঘে ঢাকা। একদিকে নিদারুণ অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে বুকভরা প্রত্যাশা। স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস ও আকাঙ্ক্ষা তখন পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করার জন্য উদগ্রীব। বাংলার মানুষের এই প্রত্যাশাকে সামনে রেখেই ৭ই মার্চের ভাষণটি প্রদত্ত। এখানে অবশ্যই উল্লেখ্য যে, হরতাল, অসহযোগ, অবরোধের মধ্য দিয়ে অহিংস ধারাকে অব্যাহত রেখে চলছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। এর আগে ৩রা মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস ও সুশৃঙ্খলভাবে এবং নাশকতার সম্পর্কে সতর্ক থেকে আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানান।
জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীই স্বাধীনতার প্রত্যয়ে সুদৃঢ় থাকলেও মূল রাজনীতির স্রোতধারায় তিনটি অভিমত তখনো কমবেশি সক্রিয় ছিল। আওয়ামী লীগের রক্ষণশীল একটি ভাগ তখনো ধারণা পোষণ করতেন, ২৩ বছর পর সরকার গঠনের সুযোগ যখন পেয়েছি তখন সরকার গঠনের পর সমস্ত শোষণের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নিয়ে ওদেরকে আমরা নিজেরাই ‘খোদা হাফেজ’ দিয়ে দেব। হয়তো তাদের জন্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ছিল, ১৯৫৪ সালে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। (অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না)। আরেক দল যারা কোনো অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক ধারার আন্দোলনের সফলতার সৈকতে পৌঁছাতে পারে এই চেতনাটিতে বিশ্বাস করতেন না, বরং ’৭০-এর নির্বাচনের ম্যান্ডেট আদায়ের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চকিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলতেন। বলতেন, ‘ভোটের কথা বলে যারা, ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা’, ‘বাংলার অপর নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, ‘মুক্তির একই পথ, সশস্ত্র বিপ্লব’, ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘নির্বাচন নির্বাচন, প্রহসন, প্রহসন’। তারা চেয়েছিলেন, ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধু একতরফাভাবে জনগণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা করলেন না। তিনি প্রখর থেকে প্রখরতর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে চারটি শর্ত দিলেন সরকারকে। তৃতীয়ত ছিলাম আমরা। যারা বন্দুকের নলকে শক্তির উৎস হিসেবে কোনোদিনই বিশ্বাস করিনি। আমরা আমাদের শক্তির উৎস হিসেবে পেন্টাগন, ক্রেমলিন অথবা দিল্লির দুর্গকে কোনোদিনই ভাবিনি। মানুষের সমর্থনই আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের মূল শক্তি মনে করেছি। মানুষের বুক-নিসৃত আশীর্বাদই আমাদের ’৭০-এর নির্বাচনের সপক্ষে ম্যান্ডেট এনে দিতে পারবে- এই প্রত্যয়ে উজ্জীবিত ছিলাম। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আমাদের বিশ্বাসটি স্বগৌরবে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তিনটি শক্তিকেই অত্যন্ত সুকৌশলে পোষ মানিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও আমাদের বিশ্বাস ও প্রতীতির প্রতি তার আস্থা নিরঙ্কুশ ছিল। তার সমস্ত সত্তায় বাংলার মানুষের হৃদয়ের অনুরণন অনুরণিত হতো। তাই তো তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে বলতে পারলেন- ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই’। এ কারণেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে সব ষড়যন্ত্রের জালকে ছিন্ন করে তিনি বাংলার মানুষকে একটি অদৃশ্য ঐক্যের রাখি বন্ধনে বাঁধতে পারলেন। ৭ই মার্চের ভাষণে তার অকুতোভয় চিত্ত বজ্রনির্ঘোষে ঘোষণা দিল, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। তবুও বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতার অপবাদ থেকে নিজেকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তিনি নিরাপদ রাখলেন। কৌশলী শব্দ প্রয়োগে বলতে পারলেন- আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা কর। তিনি আরো বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ভাষণটি শুধু সাধারণ বাঙালিদেরই নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও এমনভাবে উজ্জীবিত করেছিল যে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশ না নেয়া মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও বঙ্গবন্ধুর ওপর অকৃত্রিম আস্থা রাখলেন। তিনি ১১ই মার্চ পল্টন ময়দানে এবং ১৭ই মার্চ রংপুরের জনসভায় বললেন, ‘আমার মজিবরকে অবিশ্বাস করিও না। তাহার নেতৃত্বেই দেশ ও জাতি মুক্ত হইবে’। এনডিএফ-এর নেতা মরহুম নুরুল আমীন সাহেব ১০ তারিখের গোলটেবিল অস্বীকার করে বললেন, শর্তহীনভাবে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন।
৭ই মার্চের ভাষণের বিশ্লেষণে আমার প্রত্যয়দীপ্ত বিশ্বাসটিকে উন্মোচিত করার জন্য আমি একটি তথ্য উপস্থাপন করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার জনাকীর্ণ এক সম্মেলনে একজন বিদেশি সাংবাদিক (সম্ভবত, মার্ক টালি) প্রশ্ন করলেন, আপনাদের নেতা, যাকে আপনারা জাতির পিতা ঘোষণা করেছেন, তিনি ৭ই মার্চের ভাষণে যে চারটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন সেই চারটি প্রস্তাব পরিপূর্ণ মেনে নিলেও পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকে থাকে। বাংলাদেশ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পেলেও স্বাধীনতা তো অর্জিত হয় না। আপনারা তো স্বাধীনতার সুস্পষ্ট প্রত্যয় ও প্রতীতি ঘোষণা করে আন্দোলন করছেন। যদি ইয়াহিয়া খান চারটি প্রস্তাবই পরিপূর্ণভাবে মেনে নেন তখন আপনাদের অবস্থান কি হবে? আপনারা কি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অমান্য করে স্বাধীনতার দাবি অব্যাহত রাখবেন? নাকি আন্দোলনের গতি স্তিমিত করে দেবেন। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তরফ থেকে আমি উত্তর দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, অপেক্ষায় থাকুন। ইতিহাস প্রমাণ করবে। ভয়ভীতি, নির্যাতন, নিগ্রহের আতঙ্ক অথবা কোনো প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা ৭ই মার্চের প্রদত্ত স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান থেকে বঙ্গবন্ধুকে একবিন্দু নড়াতে পারবে না। আমরা যে কর্মসূচি পালন করেছি, করছি এবং আগামীতেও করব সেটি তারই নির্দেশে। আমরা তারই চিন্তায় শানিত, তারই চেতনার উত্তরাধিকারী। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে তিনি অনন্য সাধারণ; মানুষ ও জনগণের নাড়ির স্পন্দন তিনি বুঝতে পারেন। তার আঙ্গিকেই তিনি কর্মসূচি দেবেন। ৭ই মার্চেও ঘোষণাটি সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিন্তা-চেতনা, প্রত্যাশা ও প্রত্যয়ের অভিব্যক্তি। এই স্বাধীনতা ও মুক্তির আন্দোলনে যেকোনো সশস্ত্র আক্রমণকে আমরা মোকাবিলা করব তারই নির্দেশে, ইঙ্গিতে এবং নেতৃত্বকে অনুসরণ করে।
নতুন প্রজন্ম আমাকে প্রশ্ন করতে পারে, সেই সশস্ত্র সংগ্রামে তো আপনারা যেতে বাধ্য হলেন, তাহলে ৭ই মার্চ  থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দিলেন কেন? ঐতিহাসিক বাস্তবতার আঙ্গিকে আমি পুনরায় উল্লেখ করতে চাই, পাকিস্তানের বর্বরোচিত সামরিক জান্তার শক্তির উৎস ছিল অস্ত্র ও অর্থ। তাদের চলার পথের বাহন ছিল ষড়যন্ত্র। আর আমাদের শক্তির উৎস ছিল বাংলার জনগণ। তারা অস্ত্র আনছে, সংগঠিত হচ্ছে, চট্টগ্রামে অস্ত্র খালাস হচ্ছে। জয়দেবপুরে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। কিন্তু আমরা আস্তে আস্তে একেকটি অবরোধ, অসহযোগ, হরতালের কর্মসূচি দিয়ে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় জনগণকে সংগঠিত করতে পেরেছিলাম বলেই ২৫শে মার্চের পৈশাচিক আক্রমণে মানুষ অকুতোভয়ে একযোগে মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহস পেয়েছিল। বাঙালি জাতির সর্বস্তরের মানুষ- ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, জনতা, সৈনিক, পুলিশ রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে গিয়ে একটি মিলনের মোহনায় একত্রিত হতে পেরেছিল। ফলে এই নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষ আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার মতো বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু তার অবর্তমানেই প্রজ্বলিত করতে পেরেছিলেন মুক্তিকামী জনতার ঐক্যের দাবানল। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে কোনো অপপ্রচারই সেই ঐক্যে চির ধরাতে পারেনি। বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। এটাই ছিল আমাদের জনশক্তিকে উজ্জীবিত করার সফলতা।
লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা

No comments

Powered by Blogger.