অ্যাসিড–সন্ত্রাস কমলেও বিচার বিলম্বিত

দেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাস কমলেও বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। এর ফলে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হওয়া নারীরা বিষণ্ন ও হতাশ জীবন যাপন করছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ১৫ বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলায় ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, কিন্তু কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়নি। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ১১৮ জনের। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১ হাজার ৮৬৫ জন আসামি খালাস পেয়েছেন। অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের (এএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক ৪৯৪টি ঘটনায় ৪৯৬ জন অ্যাসিড-সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। এখন এই সংখ্যা কমে এসেছে। গত দুই বছরে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল ৭৪টি করে। ২০১৬ সালে অ্যাসিড হামলার সংখ্যা ৪৪। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল, অন্তত সাতটি করে। এসব ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৫০ জন। এর মধ্যে একজন নারী মারা গেছেন। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার ৩০ জন নারী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। বিচার বিলম্বিত হওয়ায় তাঁরা হতাশার কথা জানিয়েছেন। অথচ অ্যাসিড অপরাধ দমন আইন, ২০০২ অনুযায়ী ৯০ কর্মদিবসের মধ্যে মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার কথা। অ্যাসিড-সন্ত্রাসে ঝলসে যাওয়া কুমিল্লার ফারজানা আক্তার হাসপাতালে ২২ দিন মৃত্যুযন্ত্রণায় ভুগে মারা যায়। এ ঘটনায় তার বাবা দাউদকান্দি থানায় একটি মামলা করেন। প্রায় পাঁচ বছর পার হয়ে গেলেও মামলাটি এখনো চলমান। বিচারকাজ কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না।
ফারজানা যখন মারা যায়, তখন তার বয়স ছিল ১৫ বছর। তার বড় বোন মাকসুদা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোনটা সবার চোখের সামনে মারা গেল, কিন্তু বিচার পেলাম না।’ মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ফারজানা দাউদকান্দির ড. মোশাররফ হোসেন ইসলামিয়া রহমানিয়া দাখিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। পাশের গ্রাম জামালকান্দির সাদ্দাম হোসেন ও মাদ্রাসাশিক্ষক দেলোয়ার হোসেন তাকে যৌন হয়রানি করে এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। ফারজানা রাজি না হওয়ায় দেলোয়ার ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এমন কাজ করব যে নিজের চেহারা দেখতেও ভয় পাবি।’ এর কিছুদিন পরই অ্যাসিড-সন্ত্রাস চালানো হয়। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার সিলেটের শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাত বছর ধরে দৌড়াচ্ছি, খালি মামলার তারিখ দেয়। আমার ৩ লাখ টাকা এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে। তবু বিচার পাই না।’ খুলনার নাছিমা আক্তার বলেন, ‘আমার গায়ে অ্যাসিড দেওয়ার পর দুটি মামলা হয়েছিল। এরপর একটি মামলা খারিজ হয়ে যায় সাক্ষীর অভাবে। এখন এই মামলা বিলম্ব হওয়ার কারণে সাক্ষীরা আসতে চান না। সারা শরীর ঝলসানো বলে আমি সবার কাছে ঘৃণার পাত্রী।’ সরকারি হিসাব অনুযায়ী ২০০২ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনায় সারা দেশে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৮০টি। অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি দাবি করে ৮২৯টি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত মামলার সংখ্যা মাত্র ১৮৮। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, পুলিশ প্রভাবিত হয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। রাষ্ট্রের চোখে সবাই সমান হলেও কার্যক্ষেত্রে তা দেখা যায় না। অপরাধীরা চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে না। সাক্ষীদের সুরক্ষা না থাকার কারণে তাঁরা ঠিকমতো আদালতে হাজির হন না। এ কারণে বিচার বিলম্বিত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, অ্যাসিড-সন্ত্রাসের মামলাগুলোর বেশির ভাগ আসামিই খালাস পেয়ে গেছে। মাত্র ২৫ শতাংশ মামলায় অভিযুক্তদের সাজা হয়েছে। প্রতি চারজন আসামির তিনজনই খালাস পেয়েছে। অর্থাৎ, চারজন আক্রান্ত নারীর তিনজনই বিচার পাননি।
৮৮ শতাংশ অভিযুক্ত ধরা পড়েনি
২০০২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যাসিড মামলায় অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে মাত্র ১২ শতাংশ মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করা হয়। বাকি ৮৮ শতাংশ অভিযুক্ত পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৯ থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ৩৪৭টি। এসব ঘটনায় অ্যাসিডে দগ্ধ হয়েছেন ৩ হাজার ৭০৪ জন। অ্যাসিড হামলা হয়েছে ৩ হাজার ৭১২ বার। এএসএফের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ বলেন, দীর্ঘসূত্রতা ও সময়ক্ষেপণের কারণে অ্যাসিড মামলার অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি তাদের অনেকে আবার উল্টো আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারকে হুমকি দিচ্ছে। অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, হামলাকারীদের বেশির ভাগই ভুক্তভোগীর পূর্বপরিচিত, স্বামী, প্রেমিক অথবা আত্মীয়। আর নারীর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপকারী সবাই পুরুষ। তবে অ্যাসিডের সহজলভ্যতায় বর্তমানে শুধু নারীই সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছেন না, পুরুষ এমনকি ছোট শিশুর জীবনও বিপন্ন হচ্ছে। প্রেমসংক্রান্ত কারণ ছাড়িয়ে এখন শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা দেওয়া, যৌতুক ও জমি নিয়ে বিরোধ অথবা রাজনৈতিক কোন্দলের অস্ত্র হিসেবেও অ্যাসিড ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার অ্যাসিড-সন্ত্রাসের ধরনও পাল্টেছে। সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনায় দেখা গেছে, আগে আহত করে পরে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হচ্ছে। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাসিড-সংক্রান্ত মামলার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট জেলা কমিটির ও জেলার সরকারি কৌঁসুলিকে বিশেষ যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধীদের দ্রুত সাজার আওতায় আনতে এবং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে তদারকি চলছে। তিনি বলেন, অধিকসংখ্যক মামলার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা ধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তারা বলতে চাইছে, ব্যাটারির পানিকেও কেউ কেউ অ্যাসিড বলেছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষী পাওয়া যায়নি।
অ্যাসিড সহজলভ্য
দেশের কিছু এলাকায় এখনো চাইলেই অ্যাসিড সংগ্রহ করা যায়। মূলত ক্ষুদ্র ব্যবহারকারীদের কাছ থেকেই অ্যাসিড সংগ্রহ করে আক্রমণকারীরা। সোনার দোকান, আসবাবপত্রের দোকান, মাইকের দোকান, ব্যাটারির দোকান থেকে অ্যাসিড সংগ্রহের নজির বেশি। এসব ব্যবহারকারীর বেশির ভাগের অ্যাসিড ব্যবহারের লাইসেন্স না থাকার অভিযোগ রয়েছে। আইন অনুযায়ী লাইসেন্সের শর্ত পালন না করে কোনো অ্যাসিড উৎপাদন, আমদানি, পরিবহন, মজুত, বিক্রয় বা ব্যবহার করলে বা দখলে রাখলে শাস্তি হিসেবে ৩ থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু দেশের বিভিন্ন এলাকায় লাইসেন্স ছাড়াই চলছে এর কেনাবেচা ও ব্যবহার।

No comments

Powered by Blogger.