বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবি মন্ত্রী–সাংসদদের

পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে অপমান করেছে বলে মন্তব্য করেছেন মন্ত্রী-সাংসদেরা। তাঁরা এ জন্য বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবি তুলেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা বলেন, একটি জাতির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনার জন্য বিশ্বব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। গতকাল রোববার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিয়ে মন্ত্রী-সাংসদেরা এ দাবি করেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবং এই মামলার আসামিদের কাছে মাফ চাইতে হবে। যদি মাফ না চান, অর্থমন্ত্রীকে বলব, তিনি যেন প্রটেস্ট নোট পাঠান।’ তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। জাসদের মইন উদ্দীন খান বাদল গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলার বাদী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুললে ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন।
পরে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। তবে এই প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে শুক্রবার কানাডার আদালত বলেছেন, এই মামলায় কোনো প্রমাণ হাজির করা হয়নি। প্রমাণ হিসেবে যেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো অনুমানভিত্তিক। কানাডার আদালতের এই রায়ের পর সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বিশ্বব‌্যাংকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। গতকাল সংসদে এই বিষয়ে অনির্ধারিত আলোচনার সূচনা করেন বিরোধী দলের সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি সরকারের কাছে পদ্মা সেতুর বিষয়ে আইনমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলার জন্য বিশ্বব্যাংককে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মাফ চাইতে হবে। তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার সময় আমি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান আইনজীবী ছিলাম। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরা নিজেরা তদন্ত করতে চাইলে দেশের সার্বভৌমত্বের কথা উল্লেখ করে তা নাকচ করে দিই। আমার সঙ্গে মিটিং করে সেই রাতেই তাঁরা বিশ্বব্যাংকের আবাসিক পরিচালকের বাসায় কার কার সঙ্গে ডিনার করেছিলেন, তার বিস্তারিত আমার কাছে আছে।’
এ সময় সাংসদেরা নাম প্রকাশ করতে বলেন। আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বলব, সবই বলব। আমার কাছে বিস্তারিত আছে। তবে এটা নাম বলার প্ল্যাটফর্ম না। দুদকের অভিযোগপত্রে আবুল হোসেনের নাম নেই কেন জানতে চেয়েছিল বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল। ঝগড়াই হয়ে গেল প্রায়। বললাম, তদন্তে যা বেরোয়, তা-ই হবে। হঠাৎ শুনলাম, কানাডায় মামলা হয়েছে।’ ওই ঘটনায় যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের মামলা করার পরামর্শ দিয়ে আনিসুল হক বলেন, আইনজীবীর কাছে গেলে তাঁরা বলে দেবেন মামলার অধিক্ষেত্র কোথায়। এখানে-ওখানে দুখানেই আছে। বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কারণে রাষ্ট্রের মর্যাদাহানি হয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা উচিত। রাষ্ট্রের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে রাষ্ট্রীয়ভাবে মামলা করতে হবে। পদ্মা সেতু প্রকল্প সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার প্রশংসা করে ধন্যবাদ প্রস্তাব গ্রহণের কথা বলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যা করেছেন, তা-ই সঠিক। পদ্মা ব্রিজ নিয়ে যাঁরা বিদেশিদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছেন, সরকারকে হেয় করেছেন, সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন, তাঁরা এ দেশের শত্রু। তাঁদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই আবুল হোসেনকে দেশপ্রেমিক বলেছিলেন। অথচ সেই সময়ে সমকাল পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করা একজন মন্ত্রীকে দেশপ্রেমিক বলা হয়েছে। জনগণ বিষয়টি ভালোভাবে নেবে না।’ কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্বব্যাংক নিজেদের কী মনে করে জানি না। আমি মনে করি, তারা এতটা শক্তিশালী নয় যে একটি স্বাধীন দেশের মানুষকে অপমান করতে পারে। কিছু লোক রিটায়ার করেন, টাকা নাড়াচাড়া করেন, নানান ধরনের কথা বলেন।
টিআইবি বলছে, বিশ্বব্যাংকের কাছে জবাবদিহি চাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা চাইব কেন? টিআইবি, আপনারা কী করছেন? আপনারা কেন চাইছেন না? লেজ যাদের সুতায় বান্ধা, তারা ওই ধরনের চ্যালেঞ্জ রাখার সাহস রাখে না।’ মতিয়া চৌধুরী আরও বলেন, ‘ড. ইউনূস কলকাঠি নেড়েছেন। যে কারণে অন্যায়ভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনসহ আরও অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলো। এত গ্লানি ও কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে কেউ যদি আত্মহত্যা করত, আশ্চর্য হতাম না।’ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সাংসদ শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, রাষ্ট্র, সরকার ও আওয়ামী লীগকে হেয় করার জন্য কানাডার আদালতে মামলা হয়েছিল। এদের যারা ইন্ধন দিয়েছিল, তারা বুদ্ধিজীবী না, চুক্তিজীবী। কারণ এরা বিদেশি টাকা খেয়ে বিদেশের পক্ষে কথা বলে। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, তিনি মন্ত্রী থাকা অবস্থায় মার্কিন কূটনীতিকেরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছিলেন, ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানো হলে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে না। জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথা বলা হলো। বিশ্বব্যাংকের দেশীয় দালালদের উন্মোচন করতে হবে। একজন ড. ইউনূস বা ড. কামাল নন, এদের অনেক প্রেতাত্মা আছে। এরা দেশপ্রেমিক নয়। এদের চিহ্নিত করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে।’ সরকারি দলের সাংসদ আবদুল মান্নান বলেন, দেশের সম্মান নষ্ট করার জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিত। সংসদে পদ্মা সেতু নিয়ে এই আলোচনা চলার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন না।

No comments

Powered by Blogger.