পরিবেশবান্ধব নির্মাণে জোর দেওয়ার তাগিদ

পরিবেশবান্ধব নির্মাণে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি সংস্থা ও বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেছেন, শহরকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার পাশাপাশি নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনের পরিবেশবান্ধব নকশা ও উপকরণ ব্যবহার করা এবং নির্মাণকালে বায়ু ও শব্দদূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। গতকাল রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘পরিবেশবান্ধব নির্মাণ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
তাঁরা বলেন, রাজধানীর বাতাসে উচ্চমাত্রায় ধূলিকণার অন্যতম কারণ নির্মাণকাজ চলাকালে ইট-বালু রাস্তায় ফেলে রাখা এবং খোলা ট্রাকে পরিবহন। এটা ঠেকাতে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজক প্রথম আলো। সহযোগিতা করেছে ক্রাউন সিমেন্ট ও হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচবিআরআই)। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানে এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, সাত বছর আগে মেক্সিকোতে টেকসই নির্মাণ নিয়ে একটি কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে মেক্সিকো ইশতেহার নামে একটি ঘোষণা দেওয়া হয়, তার নাম ছিল ‘ট্রিপল জিরো’ (তিন শূন্য)। এই তিন শূন্য হলো নির্মাণসামগ্রী উৎপাদনে পরিবেশদূষণ শূন্যে নামিয়ে আনা, ভবন ব্যবহারকালে দূষণ শূন্যে নামিয়ে আনা এবং ভবন ভাঙা বা পুনর্নির্মাণে দূষণ শূন্যে নামিয়ে আনা। জার্মানি হলো প্রথম দেশ, যারা আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে এটি অর্জন করতে পারবে। জামিলুর রেজা চৌধুরী আরও বলেন, মাটি পুড়িয়ে তৈরি করা ইটের বিকল্প ব্যবহার করা দরকার। তবে খেয়াল রাখতে হবে, তা যাতে টেকসই হয়। তিনি ছোট ছোট ভবনের বদলে বড় ভবন নির্মাণের তাগিদ দিয়ে বলেন, এতে আবাসন ব্যবসায়ীদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। তিনি এমন উপকরণ ব্যবহারের পরামর্শ দেন, যার মধ্য দিয়ে পানি ভূগর্ভে যেতে পারে। এমন প্রযুক্তি এসেছে বলেও তিনি জানান। প্লাস্টিকের ব্যবহার অতিমাত্রায় বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, এখন ভবনের দরজার চৌকাঠ তৈরিতেও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক পচনশীল নয়। অতিমাত্রায় প্লাস্টিক ব্যবহার ভবিষ্যতে বিপদ তৈরি করতে পারে। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) নিয়ে তিনি বলেন, এখন ড্যাপ আছে কি নেই, তা বোঝা যাচ্ছে না। নতুন করে কী হচ্ছে তা-ও জানা নেই। দেশে পরিবেশ নিয়ে অনেক আইন আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসবের প্রয়োগ হয় না। সরকারকে এ ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে। নাগরিকেরাও ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারেন। হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক ‘পরিবেশবান্ধব নির্মাণ ও বিকল্প প্রযুক্তি’ শিরোনামে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, প্রতিবছর দেশে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ইট তৈরি হয়। এতে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টন ভূমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ব্যবহার করা হয়। ইট পোড়াতে ৫০ লাখ টন কয়লা ও ৩০ লাখ টন কাঠ ব্যবহার করা হয়। এতে প্রায় দেড় কোটি টন কার্বন নিঃসরণ হয়। ইটের বিকল্প হিসেবে ফেরো সিমেন্ট, স্যান্ড সিমেন্ট, অটোক্লেভড অ্যারেটেড কংক্রিট (এসিসি), সেলুলার লাইটওয়েট কংক্রিট (সিএলসি) ইত্যাদি বিকল্প পণ্য ও প্রযুক্তি এসেছে বলে উল্লেখ করেন আবু সাদেক। তিনি দেশে এসব উপকরণ দিয়ে তৈরি কয়েকটি ভবনের ছবি দেখিয়ে বলেন, ইটের বিকল্প উপকরণের খরচও তুলনামূলক কম। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, পরিবেশবান্ধব নির্মাণকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক দিক হলো ভবনটি পরিবেশবান্ধব করে নির্মাণ করা; অন্যটি হলো নির্মাণকালে পরিবেশ রক্ষা করা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উর্বর মাটি দিয়ে তৈরি ইট ভারতে রপ্তানি হচ্ছে। ত্রিপুরার মন্ত্রীরা বলছেন,
সেখানে উপরিভাগের উর্বর মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কঠোরতা আছে। এভাবে মাটি নষ্ট করে ইট রপ্তানি বন্ধ করা দরকার। মোবাশ্বের হোসেন আরও বলেন, ঢাকায় অনেক পরিবেশবান্ধব ভবন হচ্ছে। এসব ভবনে পানির পুরোটা পুনর্ব্যবহার করা হয়। বিশেষায়িত কাচ ব্যবহার করে ভবনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা হচ্ছে। তবে এসব নিয়ে প্রচার হওয়া উচিত। পাশাপাশি কী কী পরিবেশবান্ধব উপকরণ আছে, কারা সরবরাহ করে তা নিয়েও গণমাধ্যমের উচিত প্রচারণা চালানো। গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আইনুল ফরহাদ বলেন, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো অনেক এগিয়ে গেছে। তারা এখন লিড (যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের সনদ) সনদপ্রাপ্ত কারখানা করছে। সরকারি ভবনে এখনো লিড সনদের পর্যায়ে আসেনি। তবে ঢাকায় দুটি পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণ করবেন। একটি হবে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের কার্যালয়। অন্যটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন। তিনি বলেন, আগুনে না পুড়িয়ে ইট তৈরির জন্য জাপানের সহায়তায় সরকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। এটা সফল হলে উর্বর মাটি ব্যবহার করে ইট তৈরি কমানো যাবে। নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক খুরশীদ জাবিন হোসেন ঢাকার পরিবেশ রক্ষায় এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার ঘনত্ব ঠিক করে দেওয়ার তাগিদ দেন। বাংলাদেশ প্ল্যানার্স ইনস্টিটিউটের সভাপতি এ কে এম আবুল কালাম বলেন, কতটুকু জায়গা খালি রাখা দরকার, কতটুকু সবুজ রাখা দরকার, দুই ভবনের মাঝে কত জায়গা খালি থাকবে—এসব আগে ঠিক করে সে অনুযায়ী নির্মাণ করতে হবে। শুধু ঢাকা শহর নয়,
বাংলাদেশের সব জায়গায় নির্মাণকাজ পরিবেশবান্ধব করার তাগিদ দেন ক্রাউন সিমেন্টের টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার মো. শাহ্ আলম। তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব নির্মাণের অনেক প্রযুক্তি এসেছে। সেগুলোর ব্যবহার বাড়াতে হবে। জিপিএইচ ইস্পাতের নির্বাহী পরিচালক মাদানি এম ইমতিয়াজ বলেন, কিছু নিয়ম ঠিক করে ভবন নির্মাণের অনুমোদনের সময় সেগুলো মানতে বাধ্য করা যেতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা যে হারে পরিবেশ দূষিত করছি, তাতে পরিবেশ আমাদের বেশি সময় দেবে না।’ শেলটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিক এম সেরাজ বলেন, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অপ্রতুল। সেখানকার গবেষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিতে হবে। সরকারি কাঠামোতে বেতন দিয়ে গবেষণা হয় না। পৃথিবীর কোথাও হয়নি। তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করতে হবে। তিনি পরিবেশবান্ধব নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে আইন অনেক আছে, কিন্তু সেগুলোর প্রয়োগ নেই। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আফসানা হক বলেন, প্রতিটি প্রকল্পের পরিবেশগত সমীক্ষা (ইআইএ) করা উচিত। এখন এটা শুধু বড় প্রকল্পে হচ্ছে। তিনি বলেন, এখন ঢাকা শহর ধুলায় ধূসরিত। ইআইএ থাকলে এটা কীভাবে রোধ করতে হবে তা বলা থাকত। তা মানানোও জরুরি।

No comments

Powered by Blogger.