মূলনীতিবিরোধী আন্দোলনের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী

১৯৫০ সালে শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের রাজপথে যে তুমুল আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল, এর আগে সে রকম দেখা যায়নি। মূলনীতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ ছিল। এর তীব্র প্রতিক্রিয়ায় স্তিমিত ভাষা আন্দোলনের পালে আবার হাওয়া লাগে। প্রতিক্রিয়া শুধু শহর ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ ছিল না, আন্দোলন প্রদেশের বড় বড় শহরে, বিশেষ করে জেলা শহরগুলোতে প্রবলভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ১৯৫০-এর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে শুরু হলেও এ আন্দোলনের তীব্রতা সভা-সমাবেশ ও মিছিলে গুরুত্ব পায় অক্টোবর মাসজুড়ে এবং নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত মহাসম্মেলনে পায় এর পরিণতি।
সে পরিণতি বাস্তবিকই ঢাকার শিক্ষিত সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রতিবাদ সুসংগঠিত করতে তৈরি হয় ভাষা আন্দোলনের মতোই সংগ্রাম কমিটি। এ আন্দোলনের রাজনৈতিক গুরুত্ব একালে অনেকে মনে রাখেননি। অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত একাধিক স্থানে অর্থাৎ পাকিস্তান অবজারভার অফিস থেকে নেতা-বিশেষের বাসভবনে একের পর এক বৈঠকে ছাত্ররাও যোগ দিয়েছে। এতে উপস্থিত দেখা গেছে মধ্যপন্থী থেকে বামপন্থী রাজনীতিক ও ছাত্র-যুব নেতাদের। তবে ৪-৫ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা বার লাইব্রেরিতে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী সম্মেলনে উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। আতাউর রহমান খানের সুদীর্ঘ বক্তৃতা সত্ত্বেও শ্রোতাদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়নি। বরং একটি ঘটনা আমাদের মতো অনেকের কাছে হয়ে ওঠে সরস অভিজ্ঞতা। বিষয়টি ছিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে নিয়ে বিতর্ক। সে বিতর্ক করাচিতে অনুষ্ঠিত সংবিধান সভায় তাঁর নীরব ভূমিকা নিয়ে। তাই হক সাহেব এ সম্মেলনে কিছু বলতে চাইলে কেউ কেউ পূর্বোক্ত প্রসঙ্গ তুলে আপত্তি জানালে সভায় গভীর অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। বিব্রত বোধ করেন সভাপতি আতাউর রহমান খান। কিছুক্ষণ টানাপোড়েনের পর অনেকে হক সাহেবের পক্ষে দাঁড়ান। এমনকি জহিরুদ্দিন সাহেব বলে ওঠেন,
‘লেট দ্য লায়ন স্পিক’। এ কথায় সবাই বেশ মজা পান। হক সাহেব তাঁর স্বভাবসুলভ ধারায় করাচিতে তাঁকে একরাশ আঙুর খাওয়ানোর গল্প বলে তাঁর নীরবতার কারণ ব্যাখ্যা করলে উপস্থিত সবার সশব্দ হাসিতে মেঘ কেটে যায়। হক সাহেব রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে রীতিমতো জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেন। এমনই হক সাহেবের রাজনীতি। আমার বিশ্বাস, মূলনীতি কমিটির প্রস্তাববিরোধী আন্দোলন একুশের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছিল। যেমন করেছিল দ্বিতীয় ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর লাগাতার ভাষাবিষয়ক কার্যক্রম। এ কমিটি গঠিত হয় ১১ মার্চ পালন উপলক্ষে ১৯৫০-এ। এর আহ্বায়ক আবদুল মতিন এমনটাই মনে করেন। তাঁর মতে, এ লড়াই তাঁকে একাই চালাতে হয়েছিল। এমনকি বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১১ এপ্রিল (১৯৫১) গণপরিষদের সদস্যদের কাছে স্মারকলিপি গণপরিষদ সদস্যদের প্রভাবিত না করলেও কিছুটা ইতিবাচক ছাপ রেখেছে সেখানকার সংবাদপত্র মহলের একাংশে। এভাবে এক একটি ঘটনা বিস্ফোরক একুশের ক্ষেত্র তৈরি করে।

No comments

Powered by Blogger.