এ দেশের ক্রিকেট যেখানে সুন্দর

বিপিএল খেলার জায়গা। ফিক্সিংয়ের অভিযোগগুলো সত্যি হলে ‘খেলানোর’ও। টি-টোয়েন্টির রঙিন আসর আরও একটা জিনিসেরও ক্যানভাস তৈরি করে দিয়েছে। এ যে চেহারা দেখানোরও দারুণ এক জায়গা! টুর্নামেন্টের উপযুক্ত স্লোগান হতে পারে ‘প্রচারেই প্রসার’। গ্যালারির দর্শক থেকে শুরু করে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিক, কখনো কখনো বিসিবির কর্মকর্তাদেরও এই স্লোগানে উজ্জীবিত মনে হয়।
টেলিভিশন পর্দায় পালা করে মুখটা একবার দেখাতেই হবে। কেউ আবার গ্যালারিতে লাগানো অন্যের বিলবোর্ড ঢেকে দিয়ে হলেও বিশাল ব্যানারে নিজের চেহারাটা বড় করে দেখাতে ব্যগ্র। খেলা নয়, দর্শকেরা যেন তাঁর ছবি দেখতেই এসেছেন স্টেডিয়ামে! এসব চাটুকারের তেলবাজিও হতে পারে। তবে চিন্তাগুলো খুবই শিশুতোষ। আশার কথা, মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই থাকুক, ক্রিকেটারদের মধ্যে মাঠের বাইরে এ রকম অক্রিকেটীয় কোনো প্রতিযোগিতা নেই। তাঁরা বরং অনেক সময় সৌহার্দ্যের এমন জীবন্ত ছবি তুলে ধরেন, যা ক্রিকেটকে পুঁজি করে, তারকা ক্রিকেটারদের পাশে বসিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের অপচেষ্টাকে হাস্যকর করে তোলে। কাল প্রথম ম্যাচ শেষে হওয়া সংবাদ সম্মেলনে এসেই মাশরাফি বিন মুর্তজা যেমন ঘোষণা দিলেন, ‘আজ একসঙ্গে হবে। প্রথমবারের মতো...।’ খুলনা টাইটানস অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ ততক্ষণে চেয়ারে বসে গেছেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সত্যিই তাঁর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস অধিনায়ক মাশরাফি। একটু আগেও মাঠে তাঁরা ছিলেন প্রতিপক্ষ। কিন্তু মাশরাফির ‘একসঙ্গে হবে’ ঘোষণা সংবাদ সম্মেলনে ছড়াল বন্ধুত্বের বাতাবরণ। ম্যাচে মাহমুদউল্লাহর এক ওভারে দুই ছক্কা মেরেছেন মাশরাফি। সেটি নিয়ে দুজনের সে কি রসিকতা! প্রসঙ্গটি উঠতেই মাহমুদউল্লাহ কৌতুকপ্রবণ, ‘প্র্যাকটিসেও মাশরাফি ভাই আমাকে ভালো মারেন। আজ (গতকাল) বলছিলাম, আমাকে মাইরেন না...।’ পাশ থেকে মাশরাফির প্রতিবাদ, ‘ও আমাকে যতটুকু বলছে ততটুকুই মেরেছি। ও বলেছে দুইটার বেশি মাইরেন না।’ এরপরই যেন তাঁর অনুশোচনা, ‘দলকে তো ব্যাট-ট্যাট ঘোরানো দেখাতে হয়। সেটা করতে গিয়েই ব্যাটের কানায় লেগে...।’ ছক্কা প্রসঙ্গ সংবাদ সম্মেলনে নিয়ে এল আলোচনা অনুষ্ঠানের মেজাজ। মাহমুদউল্লাহ মাশরাফির কথা থামিয়ে দিলেন, ‘আমি ওই দুইটা বলই ওনার (মাশরাফি) শক্তির জায়গায় করে ফেলেছি।
চেয়েছিলাম ওয়াইড ইয়র্কার করতে। পারিনি। উনি সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন।’ ব্যতিক্রমী সংবাদ সম্মেলনের বাকিটা দুই দলের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে হলেও মজা ছিল সেখানেও। প্রতিপক্ষের পরিকল্পনা সব সময় আগে থেকে বোঝা না গেলেও মাঠে নামলে সব দলের কাছেই আস্তে আস্তে তা পরিষ্কার হতে থাকে। কিন্তু মাশরাফি যখন বলছিলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছিলাম ১৫-১৬ ওভারের মধ্যে ম্যাচটা জিততে’ বা ‘মিটিংয়ে বলা হয়েছিল শেহজাদ-ইমরুল প্রথম থেকেই চড়াও হবে’, পাশের চেয়ারে বসে প্রতিপক্ষ অধিনায়কের মুখে নিজেদের নিয়ে রণপরিকল্পনা শোনার অভিজ্ঞতা সম্ভবত প্রথমই হলো মাহমুদউল্লাহর। বিপিএলের অনেক নেতিবাচকতার মধ্যে সৌহার্দ্যের এই খণ্ডচিত্রগুলো মন কাড়ে। এই টুর্নামেন্ট লাল-নীল-হলুদ-সবুজ অনেক রকম জার্সিই তুলে দিয়েছে ক্রিকেটারদের গায়ে। সবারই লক্ষ্য নিজের দলের জন্য ভালো খেলা। কিন্তু এসবের পরও তাঁদের গোড়া যে একই ড্রেসিংরুমের মাটিতে পোঁতা, দেশের লাল-সবুজ জার্সিতেই লেখা সবার আসল পরিচয়—সেটা মাঝে মাঝেই জানান দেয়। টস করতে গিয়ে সাকিব-মুশফিকের খুনসুটি, কখনো মাহমুদউল্লাহর পাশে মাশরাফির বসে পড়া অথবা পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান থেকে দুই দলের অধিনায়কের গলাগলি করে ফেরা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এসবই আসল সৌন্দর্য, যার প্রচারে কোনো ব্যানার লাগে না। যে সৌন্দর্য কোনো ব্যানারে ঢাকাও যায় না।

No comments

Powered by Blogger.