বিপ্লবীর বিদায়

হাভানায় মে দিবসের র‍্যালিতে দেশের পতাকা হাতে
কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো, ২০০২ সালে। এএফপি
গত এপ্রিলে হাভানায় কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে দেওয়া শেষ ভাষণে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘শিগগিরই নব্বইতে পড়ব...অন্য সবার কাতারে মিশে যাব, একে একে আমাদের সবারই পালা আসে।’ নব্বই পূরণ করেই বিদায় নিলেন ফিদেল কাস্ত্র —কিউবান বিপ্লবের নেতা। তবে অন্য সবার কাতারে মিশে যাওয়া তাঁর হবে না। কমিউনিস্ট বিপ্লবের এক দীর্ঘ সোনালি অতীতের প্রতীক হয়ে থাকবেন তিনি ইতিহাসের পাতায়। আমেরিকার সীমানার ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সেটা পাঁচ দশক ধরে টিকিয়ে রাখতে পারার সামর্থ্য বহু দেশের জনপ্রিয় পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে। কিউবার স্থানীয় সময় গত শুক্রবার রাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা এক বার্তায় ছোট ভাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো ঘোষণা করেন ফিদেল কাস্ত্রোর মৃত্যুসংবাদ। তিনি জানান, স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১০টায় (বাংলাদেশ সময় শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা) জীবনাবসান হয়েছে এই বিপ্লবী নেতার। শনিবার আরও পরে কোনো এক সময় তাঁর দাহ হওয়ার কথা। ফিদেলের নিজের দাবি, ৬৩৪ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে তাঁকে।
কখনো আততায়ী পাঠিয়ে, কখনো খাবারে বিষ প্রয়োগ করে। সবগুলোর পেছনে পরাক্রমশালী ও শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর কারসাজি বলে অভিযোগ ছিল তাঁর। সিআইএ দু-একটি হত্যাচেষ্টার কথা পরবর্তীকালে স্বীকারও করেছে। অতিসাবধানী চলাফেরা বাঁচিয়ে দিয়েছে ফিদেলকে। ১৯৫৯ সালে যে গেরিলা অভিযানে কিউবার মার্কিন মদদপুষ্ট বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো, সেই গেরিলা দলে তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন আর্জেন্টিনার আরেক বিপ্লবী চে গুয়েভারা। এরপর ৪৯ বছর ধরে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কিউবা শাসন করেছেন তিনি। মৃত্যুর পর প্রচারিত সংবাদে তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি শাসকদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনকালের একটা বড় অংশই ছিল নাটকীয়তায় ভরা। ঠান্ডা যুদ্ধের উত্তেজনা, পারমাণবিক যুদ্ধে পুরো বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উৎকণ্ঠা আর দেশে দেশে বামপন্থী আন্দোলনের বিস্তৃতির পটভূমিতে ফিদেল কাস্ত্রো যে কিউবা গড়ে তুলেছিলেন, সেটা একটানা মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধে জর্জরিত হয়েছে। তবু কাস্ত্রো সবার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন, তা সারা বিশ্বে প্রশংসিত। আবার তাঁর কঠোর হাতে দেশ শাসনের সমালোচনাও আছে। বলা হয়, বিরুদ্ধমতের প্রতি তিনি অসহিষ্ণু ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের দীর্ঘ সময় টিকে থাকা কতটা সম্ভব হবে, এ নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ ছিল। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রো যে টিকে থেকেছেন, এর পেছনে বিপ্লবী জেদ আর সাহসের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করেছে তাঁর সহজাত রণকৌশল প্রতিভা। বেশ কয়েকটি উৎখাত চেষ্টা দমন করতে হয়েছে তাঁকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ১৯৬১ সালে বে অব পিগসে কিউবার নির্বাসিত লোকজনকে দিয়ে সিআইএর মদদপুষ্ট সামরিক অভিযান। কাস্ত্রো সে যুদ্ধে টিকে যান। ১৯৬২ সালে কিউবায় সোভিয়েত ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১৩ দিনের যে টানাপোড়েন দেখা দেয়, সেটা ঠান্ডা যুদ্ধের দুই শিবিরের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ প্রায় বাধিয়ে দিয়েছিল। তবে কাস্ত্রোর কিউবা শুধু টিকে থেকেছে তা-ই নয়, বেশ কয়েকটি দেশে বামপন্থী বিপ্লবে শক্তি ও সহযোগিতাও জুগিয়েছে। ক্যারিবিয়ান দ্বীপদেশ গ্রানাডা, আফ্রিকার দেশ অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, লাতিন আমেরিকার বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা ও পেরুতে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। সারা দুনিয়ার বিপ্লবীদের কিউবায় এসে বিপ্লবের প্রশিক্ষণ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। কলম্বিয়ার নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ছিলেন কাস্ত্রোর বন্ধু। ফুটবলের কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাও মুগ্ধ ভক্ত তাঁর।
১৯৯০ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা বারবার কাস্ত্রোকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন, সফর করেছেন কিউবা। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশগুলোর একটি কিউবা। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’ শোনা যায়, বঙ্গবন্ধুকে তিনি সাবধান করে দিয়েছিলেন সম্ভাব্য প্রাণনাশের হুমকির ব্যাপারে। অন্ত্রের ক্যানসারে অস্ত্রোপচারের পর ২০০৬ সালে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর রাজনীতি থেকে দূরে একপ্রকার নিভৃত জীবন যাপন করেছেন। বছরে এক কি দুবার জনসমক্ষে এসে ভাষণ দিতেন। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক নেতা মিখাইল গর্বাচেভ বলেছেন, ‘আমেরিকার কর্কশতম অবরোধের মুখে তাঁর ওপর যখন পাহাড়প্রমাণ চাপ, ফিদেল তখন বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছেন।’ রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ফিদেল ছিলেন রাশিয়ার আস্থাশীল ও আন্তরিক বন্ধু।
ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বলেছেন, সারা বিশ্বের বিপ্লবীদের উচিত কাস্ত্রোর উত্তরাধিকার বহন করা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টুইট বার্তায় লিখেছেন, বিংশ শতাব্দীতে ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বদের একজন। ভারত তার এক পরম বন্ধুকে হারাল। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, স্নায়ুযুদ্ধের একনায়ক (ফিদেল কাস্ত্রো)...তিনি বহির্বিশ্বের চাপকে কখনোই তোয়াক্কা করেননি। তবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প কিউবার নেতাকে ‘নির্মম স্বৈরশাসক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এখন কিউবার মানুষ যাতে সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার পথে এগোতে পারে, সে জন্য যা করা প্রয়োজন আমাদের প্রশাসন তা করবে।’ (প্রতিবেদন তৈরিতে রয়টার্স, এএফপি ও বিবিসি অনলাইনের সহায়তা নেওয়া হয়েছে)

No comments

Powered by Blogger.