তাঁর বিপ্লবের রেশ রয়ে যাবে

ফিদেল কাস্ত্রো
যে মানুষটি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ৫০ বছর ধরে বিশ্বদরবারে পদচারণ করেছেন, সেই মানুষটি পৃথিবী ত্যাগ করার আগে কিউবার জন্য একদিকে বিনা মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যদিকে খাদ্য ঘাটতি রেখে গেলেন। কিন্তু কিউবায় তাঁর নামে একটি রাস্তাও নেই। এমনকি দেশটিতে তাঁর ভাস্কর্যও নেই, যদিও সে রকম স্বীকৃতির প্রয়োজন তাঁর নেই। শিশুরা লাল স্কার্ফ পরে নিখরচার স্কুলে যাচ্ছে, নড়বড়ে বাড়ির সামনে মানুষকে রেশনে টয়লেট পেপার দেওয়া হচ্ছে, পেনশনধারীদের বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে, একঘেয়ে রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় ভর্তি সংবাদপত্র—এসব দেখেই বোঝা যায়, মানুষটি ছিলেন। ইতিহাসবিদেরা হয়তো আগামী দিনগুলোতে বিতর্ক করবেন, কাস্ত্রো কী রেশ রেখে গেলেন। কিন্তু তাঁর বিপ্লবের সফলতা ও ব্যর্থতাগুলো কিউবার সমাজে একদম দৃশ্যমান।
সাম্প্রতিক সময়ের সংস্কার সত্ত্বেও ৫০ বছর ধরে দেশটিতে যে ‘ফিদেলবাদ’ চলেছে, তার দৃষ্টান্ত পরিষ্কার। বিশ্লেষক ও দ্য কিউবা ওয়ার্সের লেখক ড্যান এরিকসন বলেছেন, ‘ফিদেল যখন ১৯৫৯ সালে ক্ষমতায় এলেন, তখন খুব কম মানুষই ধারণা করতে পেরেছিলেন, তিনি এভাবে কিউবার সমাজের খোলনলচে বদলে দিতে পারবেন। সারা বিশ্বের এ রকম অনুসারী তৈরি করতে পারবেন।’ কিন্তু ফিদেলের শাসনের সবচেয়ে নেতিবাচক দিক হলো, তিনি দেশে সম্পদের স্বল্পতা রেখে গেছেন। কিউবার আমজনতাকে একদিকে যেমন পরিবহন, গৃহায়ণ ও খাদ্যস্বল্পতায় ভুগতে হয়, তেমনি সাবান, বই ও জামাকাপড়ের উচ্চ মূল্যের জন্যও সমস্যায় পড়তে হয়। ২০০৮ সালে রাউল কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসার পরও এসব সমস্যা রয়ে গেছে। তখন থেকে কিউবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন শুরু করে। তারা ছোট ব্যবসায় উৎসাহ দেওয়া শুরু করলেও দেশটির অর্থনীতির সিংহভাগ এখনো রাষ্ট্রের হাতে রয়ে গেছে, যেখানে গড় মাসিক মজুরি ১৫ ডলারের নিচে। এতে অনেকেই পার্শ্ব উপার্জন করতে বাধ্য হয়েছেন। যে যেভাবে পারছেন, সেভাবেই বাড়তি আয়ের চেষ্টা করছেন, অনেক নারী বেশ্যাবৃত্তি করছেন, অনেকেই আবার স্বল্পমাত্রায় হলেও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। আর যাঁদের ভাগ্য ভালো, তাঁরা পর্যটকদের কাছ থেকে হার্ড কারেন্সি পাচ্ছেন, আবার অনেকেই ফ্লোরিডায় বসবাসরত আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ডলার পাচ্ছেন। নতুন বুদ্ধি বের করতে কিউবার মানুষেরা খুবই পারদর্শী। তাঁরা ছোট পুঁজি নিয়ে সম্মানের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারেন। কিন্তু তাঁরা পরিস্থিতিটা আরও আয়াসসাধ্য করতে চান। ২০ বছরের তরুণ মিগুয়েল আমাদের বলেছিলেন, ‘আমরা ভালো জিনিস কিনতে চাই, আপনারা যেমন নিজেদের দেশে কেনেন।’
কাস্ত্রো মনে করতেন, কিউবার মানুষের এই দুঃখ-কষ্টের কারণ হচ্ছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। দীর্ঘদিনের এই শত্রুতামূলক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। তবে অধিকাংশ বিশ্লেষক ও কিউবার বিপুল মানুষ মনে করেন, জোড়াতালি লাগানো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ অধিকতর বিপর্যয় বয়ে এনেছে। তবে দেশটিতে সর্বজনীন ও নিখরচার শিক্ষা থাকার কারণে তার সাক্ষরতা বিশ্বমানের, মানুষের গড় আয়ুও অনেক। কমানদান্তে এটা নিশ্চিত করেছেন যে, রাষ্ট্র যেন সবচেয়ে গরিব মানুষটির কাছেও যেতে পারে, লাতিন আমেরিকার অনেক দেশই যা করতে পারেনি। জীবনের শেষ দশকটি তিনি একরকম লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও কাস্ত্রো মানুষের হৃদয়ে ও মনে স্থান করে নিয়েছেন। শেষ দিকে তিনি ক্রমাগত অশক্ত হয়েছেন। এ সময়টা তিনি মূলত বাগান করেছেন। এ ছাড়া যখন তাঁর মৃত্যুর গুজব রটেছে, তখন তিনি রাষ্ট্রীয় পত্রিকা গ্রানমার নতুন সংখ্যা হাতে নিয়ে ছবি তুলেছেন। মাঝেমধ্যে কলাম লিখেছেন তিনি, এমনকি কখনো কখনো কিউবার বাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কঠোর সমালোচনাও করেছেন। কিন্তু ফিদেলের প্রভাব যে কমে আসছিল, তা দৃশ্যমান ছিল। হাভানাভিত্তিক এক কূটনীতিক বলেছেন, ‘ফিদেল বহুদিন ধরে একজন প্রভাবশালী চরিত্র ছিলেন, কিন্তু রাউল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।’ ফিদেলের মৃত্যুর যত না রাজনৈতিক তাৎপর্য, তার চেয়ে প্রতীকী তাৎপর্য বেশি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘তাঁর উপস্থিতি কি সংস্কারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, সম্ভবত। তরুণদের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর দেশটিতে বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন আসবে না। তবে রাউলের মৃত্যু আরও তাৎপর্যময় হতে পারে। কারণ, তিনি সংস্কারের পথে হাঁটছেন। মনে রাখা দরকার, কিউবায় িকন্তু সংস্কার শুরু হয়ে গেছে। ২০১০ সালে রাউল অর্থনীতির যে আধুনিকায়ন পরিকল্পনা হাতে নেন, তার ফলে ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারায়। এর সঙ্গে ছোট ব্যবসা যেমন পারিবারিক রেস্তোরাঁ ও পারিবারিক হোটেলের অনুমতি দেওয়া হয়। কৃষকদের বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তাঁদের প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। সরকার বিদেশ ভ্রমণের ওপর কড়াকড়ি শিথিল করেছে,
বেতনের সীমা বাড়িয়েছে; একই সঙ্গে গাড়ি বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে বিদেশি সহযোগীদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য জোন গড়ে তুলেছে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে কূটনীতিতে, সরকার যেমন একদিকে ভ্যাটিকানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তি করেছে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, এই দেশটি ফিদেল কাস্ত্রোর হাতে গড়ে ওঠা। রেভল্যুশন স্কয়ারের মার্বেল পাথরের সিঁড়িতে পা রাখুন বা ফিদেল যেখানে দাঁড়িয়ে লাখ লাখ মানুষের সামনে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন সেখানে দাঁড়ান, দেখবেন, বিপ্লব এই দেশটাকে কতটা বদলে দিয়েছে। তবে বিপ্লবের পর ফিদেল সারা পৃথিবীতে জনপ্রিয়তা পেলেও নিজ দেশে সরকার পরিচালনা শুরু করার পর তিনি অতটা জনপ্রিয় ছিলেন না। সম্পদ আত্তীকরণ, ধর্মীয় বিধিনিষেধ, সন্দেহভাজন শত্রুদের ওপর হামলে পড়া—এসব কারণে অনেকেই তাঁকে ঘৃণা করত, বিশেষ করে আগের মধ্যবিত্ত শ্রেণি। দেশটিতে পরিবর্তন আসছে, তা ঠিক। কিন্তু কিউবা এখনো ভেনেজুয়েলারই কাছাকাছি থাকবে, যুক্তরাষ্ট্রের নয়। কিন্তু এটাও পরিষ্কার, সে ফিদেলের জমানা থেকে বেরিয়ে আসছে, ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। এমন একসময় ছিল, যখন দেশটির মানুষ রাস্তায় গোপনে সালভাদর আয়েন্দের উদ্ধৃতিসংবলিত ফলক লাগিয়েছিল: ‘তরুণ বয়সে কেউ বিপ্লবী হবে না, তা হতে পারে না। ব্যাপারটা জৈবিক, তরুণ বয়সে বিপ্লবী হতেই হবে।’ কথা হচ্ছে, সেই সময় কিন্তু আর নেই।   ব্রিটেনের দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানথেকে নেওয়া।
রোরি ক্যারল: দ্য গার্ডিয়ান-এর লস অ্যাঞ্জেলেসভিত্তিক পশ্চিম উপকূলের প্রতিনিধি।
জোনাথন ওয়াটস: দ্য গার্ডিয়ান-এর লাতিন আমেরিকা প্রতিনিধি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।

No comments

Powered by Blogger.