এ যেন এক জেগে ওঠার ঘণ্টাধ্বনি

হলি আর্টিজান বেকারি রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনায় ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২৮ ব্যক্তির মৃত্যু ও ৩২ জনের আহত হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। তবে সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা এমনই অভাবনীয়। বিগত কয়েক বছরের জঙ্গি হামলায় ব্লগার, লেখক, প্রকাশক এবং ভিন্ন জীবনপ্রণালিতে বিশ্বাসী কিছু ব্যক্তির প্রাণহানির পাশাপাশি গত ছয় মাসে অন্তত পাঁচজন ভিন্নধর্মাবলম্বী ব্যক্তি নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন এবং আরও কয়েকজন আক্রমণের শিকার হয়েও প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। এসব অপরাধের দায়ে এখনো কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি, তাদের মদদদাতাদেরও খুঁজে বের করা হয়নি। ফাহিম ও মুকুল নামক দুজন সন্দেহভাজন জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যায় জঙ্গি সম্পৃক্ততার অজুহাতে সারা দেশে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ১৩ হাজারের মতো ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারপর পুলিশের সোর্স মুছার বিরুদ্ধে মিতু হত্যার অভিযোগ উঠেছে এবং তাঁর গ্রেপ্তার নিয়ে একধরনের লুকোচুরি খেলা চলছে। সর্বশেষ দুই অভিযুক্ত হত্যাকারী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। মিতু হত্যার হুকুমদাতার পরিচয় নিয়েও এখন একধরনের ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানোর চেষ্টা চলছে। তনু হত্যাকাণ্ড নিয়েও চলছে একধরনের নাটক।
এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের ক্ষেত্রে অপারগতা ও নানা রহস্য আইন প্রয়োগকারীদের সম্পর্কে জনমনে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নাগরিকদের আস্থাহীনতা রাষ্ট্রের অকার্যকরতার লক্ষণ। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ২ জুলাইয়ের ভাষণে এসবের পেছনে বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার দেশি-বিদেশি চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন। আমাদের আশঙ্কা, এমন দুর্বলতার সুযোগে কিছু বিপথগামী তরুণ জঙ্গি তৎপরতায় সংগঠিত হচ্ছেন। জঙ্গিবাদ নির্মূল করতে হবে। নইলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, এমনকি আমাদের সবার ভবিষ্যৎ চরম ঝুঁকিতে পড়বে। জঙ্গিবাদ দমন করতে হলে ধর্মীয় উগ্রপন্থার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো দূর করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং বিবেচনা শক্তি কাজে লাগানো। প্রথমত, স্বীকার করতে হবে যে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ একটি জাতীয় সমস্যা, কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর সমস্যা নয়। জঙ্গিবাদ মানবতার শত্রু। অঙ্কুরেই এর মূলোৎপাটন করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সে জন্য বিরাজমান রাজনৈতিক বিরোধের মীমাংসা করতে হবে, কারণ জঙ্গিরা আমাদের অনৈক্য-কলহের সুযোগ নিচ্ছে।
প্রয়োজন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের একত্র হয়ে সংলাপে বসা এবং এ ব্যাপারে একটি জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়ত, শুধু বল প্রয়োগ করে জঙ্গি সমস্যার সমাধান হবে না। যুক্তরাষ্ট্র তার ‘ওয়ার অন টেরর’ কর্মসূচির মাধ্যমে বহু কোটি ডলার ব্যয় করেও এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। জঙ্গিবাদকে নির্মূল করতে হলে সুচিন্তিত কৌশল নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা জঙ্গিদের দমন করতে চাই, না রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন করতে চাই। জঙ্গি নির্মূলের নামে সরকারবিরোধীদের দমন করতে গেলে তা বুমেরাং হতে পারে। রাজনৈতিক ফায়দা অর্জনের চেষ্টা করলে সত্যিকারের অপরাধীরা পার পেয়ে যেতে পারে। পুলিশের ভাষ্যমতেই সাম্প্রতিক গণগ্রেপ্তারে যে ১৩ হাজারের মতো ব্যক্তি আটক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ১৯৪ জনের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতার অভিযোগ রয়েছে, যদিও গুলশানের হত্যাযজ্ঞের খলনায়কদের কাউকেই এ অভিযানে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাকিদের অনেকেই বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থক বলে দাবি করেছেন। কিন্তু অনেকের ধারণা, আটক ব্যক্তিদের অধিকাংশই নিরপরাধ, তাঁদের অনেককেই গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের শিকার হতে হয়েছে অথবা আগের বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। অভিযোগ আছে, সরকার গত আড়াই বছরে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির বিরুদ্ধে ২০ হাজারেরও বেশি মামলা রুজু করেছে, যাতে নামে-বেনামে আসামির সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৫ মে ২০১৬)।
এসব মামলায় বিরোধী দলের অনেক নিরপরাধ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারও কারও জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়েছে। শঙ্কার বিষয় হলো, নানা হয়রানির শিকার এসব ক্ষুব্ধ ব্যক্তির কেউ কেউ জঙ্গিদের প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে উগ্রপন্থায় যোগ দিতে পারে। হয়রানিমূলক মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষোভ ও ক্রোধের ফলে বিএনপি-জামায়াতের নেতা–কর্মীদের অন্তত কিছু অংশকে উগ্র সহিংস পন্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কি না, তাও ভেবে দেখা দরকার। শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের ও রাজনৈতিক বিরোধ মীমাংসার কার্যকর পন্থা হলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। ইতিহাসের শিক্ষা হলো যে যেসব সমাজে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা বদল হয় না, সেখানে দীর্ঘ মেয়াদে শান্তি বিরাজ করে না। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে অশান্তির বীজ আমাদের সমাজে বপন করা হয়েছে, সম্ভবত তার একটা বিষফল আজকের সহিংস উগ্রবাদের বিস্তার। যে সমাজে যুক্তিবাদীরা চুপ হয়ে যায়, সেখানে উগ্রবাদীরা তাদের স্থান দখল করে নেয়। গত বছর আমরা কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি সামাজিক দায়বদ্ধতাবোধের ভিত্তিতে সহিংসতার অবসান, রাজনৈতিক সমঝোতা ও কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলাম।
কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় আমরা হয়েছিলাম চরম আক্রোশ ও আক্রমণের শিকার। আমরা সবাই জানি, গণতান্ত্রিক অধিকারহীনতা উগ্রবাদের জন্য উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। অনৈতিকতার পরিণতি অশুভ। পাকিস্তানের ইতিহাস তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। ধর্ম ও জাতীয় সংহতির ধুয়া তুলে বাঙালিদের বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে জন্মলগ্ন থেকে যে অনৈতিক খেলার শুরু হয়েছিল তা পাকিস্তানকে শুধু ভাঙেইনি, একটি উগ্রবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আমাদের রাজনীতিবিদেরাও ক্ষমতার মোহে যেসব অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়েছেন, তার মাশুল আজ আমরা দিচ্ছি। পরিশেষে, হলি আর্টিজান বেকারির সাম্প্রতিক পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড আমাদের জন্য যেন একটি জেগে ওঠার ঘণ্টাধ্বনি। জাতি হিসেবে আমরা যদি আজ জেগে না উঠি এবং সম্মিলিতভাবে জঙ্গিবাদের কারণ চিহ্নিত করে তা দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আমরাও এক ভয়াবহ অন্ধকারের দিকে ধাবিত হব। এমনি এক চরম বিপর্যয়ের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আশা করি আমাদের নেতারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)।

No comments

Powered by Blogger.