হিলারির মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি হওয়ার কথা ছিল আকর্ষণহীন, সংক্ষিপ্ত এবং আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। বারাক ওবামার মেয়াদ শেষ হলে হিলারি ক্লিনটন দলের মনোনয়ন চাইবেন—এমন অনুমান করা হয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়ই। সেই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে হিলারিকে পরাজিত করে ওবামা বিজয়ী হন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এক মেয়াদের পর হিলারি ক্লিনটন যে আর প্রশাসনে থাকলেন না, তাকেও বিশ্লেষকেরা তাঁর প্রার্থী হওয়ার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বলেই ধরে নিয়েছিলেন। দলের নেতাদের মধ্যে তাঁর প্রতি সমর্থন, ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রার্থী না হওয়ার ইঙ্গিত, দলে অন্য কারও মনোনয়নের ব্যাপারে উৎসাহ না থাকা—এ সবই ছিল তাঁর অনুকূলে; ফলে মনে হচ্ছিল খুব সাদামাটা একটা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে হিলারি ক্লিনটন মনোনীত হবেন। কিন্তু তাঁকে যে ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি কার্যত ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যও নন, তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি ফেলে দেবেন—সেটা অনেকেই ভাবেননি, হিলারি তো ননই। অঙ্কের হিসাবে অবশ্য এখনো বলা যায় যে হিলারির মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত। কেননা, মনোনয়ন পেতে দরকার ২ হাজার ৩৮৩ জন ডেলিগেট আর হিলারির সংগ্রহে নির্বাচিত ডেলিগেট ১ হাজার ৭৬৯ জন রয়েছেন। দলের সুপার ডেলিগেটের ৫৪১ জন তাঁকে সমর্থন দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে তাঁর পক্ষে আছেন মোট ২ হাজার ৩১০ জন।
বিপরীত দিকে বার্নি স্যান্ডার্সের পক্ষে আছেন ১ হাজার ৪৯৯ জন ডেলিগেট। সুপার ডেলিগেটদের মধ্যে মাত্র ৪৩ জন তাঁকে সমর্থন দেবেন বলে হয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বা অনুমান করা হচ্ছে; ফলে মোট দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৫৪২ জন। জুন মাসে যে সাতটি অঙ্গরাজ্যে প্রাথমিক পর্যায়ের ভোট হবে, তাতে যে ৯১৩ জন ডেলিগেট রয়েছেন তার যৎকিঞ্চিৎ হিলারির পক্ষে এলেই তিনি দলের মনোনয়ন পাবেন। তা সত্ত্বেও এখন এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে ২৫ থেকে ২৮ জুলাই ফিলাডেলফিয়ায় অনুষ্ঠেয় সম্মেলনের মাধ্যমেই দলের প্রার্থী চূড়ান্ত হতে হবে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত বলা হচ্ছিল যে রিপাবলিকান পার্টির সম্মেলন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক এবং দলের বিভক্তির একটি চিত্র ফুটে উঠবে; এখন কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন যে ডেমোক্রেটিক পার্টিকেই হয়তো একটি বিভক্তিসূচক সম্মেলনের মুখোমুখি হতে হবে। বার্নি স্যান্ডার্স যখন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন, তখন অনেকেই তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কেবল এ কারণে নয় যে এতে করে ডেমোক্র্যাটদের প্রাথমিক নির্বাচনের মিডিয়া কাভারেজ দলের জন্য ইতিবাচক হবে, এ কারণেও যে স্বঘোষিত সমাজতন্ত্রী স্যান্ডার্স দলের এজেন্ডায় কিছু উদারনৈতিক বিষয় যুক্ত করতে পারবেন। হিলারি ক্লিনটনের অতীত রেকর্ড থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে তিনি দলের লিবারেলদের চেয়ে মধ্যপন্থী ও ডান-ঘেঁষাদের কাছাকাছি। ফলে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে স্যান্ডার্সের প্রচারণা তাঁকে বাধ্য করবে অন্তত কিছু বিষয়ে লিবারেল অবস্থান নিতে।
এমনকি হিলারির সমর্থকদের একাংশও এই প্রত্যাশা থেকে স্যান্ডার্সের উপস্থিতিকে ইতিবাচক ভেবেছেন। কিন্তু প্রচারণায় নামার পর স্যান্ডার্স আশাতীত সাফল্য লাভ করেন। বার্নি স্যান্ডার্সের এই উত্থানের পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে সমাজে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্য, বড় আকারের করপোরেশনগুলোর প্রতি রাজনীতিবিদদের পক্ষপাত, রাজনীতিতে লবিস্ট ও বিশেষ স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারীদের প্রভাব এবং পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের তাগিদ। এসব বিষয়ই ২০১১ সালে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। সেই আন্দোলনের শক্তি ছিলেন তরুণেরা। স্যান্ডার্স সহজেই তাঁদের মনোযোগ ও সমর্থন লাভ করতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে একধরনের উৎসাহ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হওয়ায় তিনি খুব কম সময়ের ভেতরেই হিলারির জন্য বড় রকমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি মনোনয়নের ব্যাপারেও আশাবাদী হয়ে ওঠেন। যদিও গোড়াতে হিলারি বার্নি স্যান্ডার্সকে ভেবেছিলেন স্বল্প সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে তিনি বুঝতে পারেন যে তাঁকে অনেক বিষয়েই স্যান্ডার্সের ভাষায় কথা বলতে হবে। হিলারি স্যান্ডার্সের চেয়ে বেশি ভোট পেলেও তিনি তাঁর সমর্থকদের আগ্রহ তৈরি করার ক্ষেত্রে স্যান্ডার্সের চেয়ে পিছিয়ে আছেন সেটা স্পষ্ট। হিলারির জন্য সমস্যা কেবল সেটাই নয়, সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর ব্যক্তিগত সার্ভারের মাধ্যমে সরকারি ই-মেইল প্রেরণ বিষয়ে বিচার বিভাগ ও এফবিআইয়ের তদন্ত।
যদিও তাঁর আগেও পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একই ধরনের কাজ করেছেন এবং তিনি সম্ভবত কোনো রকম আইন ভঙ্গ করেননি; তথাপি এ বিষয়টি ক্রমাগতভাবে গলার কাঁটায় রূপ নিচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে এ বিষয়ে দেওয়া তাঁর বক্তব্যের মধ্যে অসংগতি ও অস্পষ্টতা। তাঁর দেওয়া উত্তরের ধরনের কারণে হিলারি কতটা বিশ্বাসযোগ্য, সে বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। আর বাস্তবতা হলো, অতীতে যেসব পররাষ্ট্রমন্ত্রী একই কাজ করেছেন, তাঁরা কেউই তো আর প্রেসিডেন্ট হতে চাননি। হিলারির নির্বাচনী প্রচারাভিযানে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে একধরনের উৎসাহের অভাব লক্ষ করা যায় বলে গণমাধ্যমের যে খবর, সে বিষয়ে সন্দেহের কারণ নেই। কিন্তু তার কারণ বোঝা দরকার। হিলারি কয়েক দশক ধরে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছেন—ফার্স্ট লেডি হিসেবে, সিনেটর হিসেবে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে। ফলে তাঁকে অনেক কাজে যুক্ত থাকতে হয়েছে এবং এখন সেগুলো থেকে একেবারে ভিন্ন ধরনের কথা তিনি বলতে পারছেন না, তিনি প্রতিশ্রুতি দিলে এই প্রশ্ন করাই সংগত যে কেন তিনি ক্ষমতায় থাকার সময়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেননি। বাস্তববাদিতার বিচারে মাপলে হয়তো তাঁর অনেক বক্তব্যই গ্রহণযোগ্য হবে, কিন্তু নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সমর্থকেরা চান এমন কথা, যা তাঁদের শিহরিত করবে। ২০০৮ সালে হিলারি ক্লিনটন যত সহজেই পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের কথা বলতে পারতেন, ২০১৬ সালে তা বলা তাঁর পক্ষে অসম্ভবপ্রায়। তাহলে কি হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে বার্নি স্যান্ডার্সই শক্তিশালী প্রার্থী হবেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে সহজেই কিছু জনমত জরিপের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করবেন; যেখানে দেখা যায় যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে হিলারির চেয়ে স্যান্ডার্স ভালো করছেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার, নির্বাচনী যোগ্যতা বা ইলেকটেবিলিটির বিষয়টি ভোটাররা এখন যেভাবে দেখছেন, পাঁচ মাস পর সেভাবেই দেখবেন—এমন নিশ্চয়তা নেই। অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি সহজেই বদলে গেছে। তদুপরি, এখন পর্যন্ত দেখা গেছে যে ডেমোক্রেটিক পার্টির শক্ত সমর্থক জনগোষ্ঠী কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে হিলারির সমর্থন স্যান্ডার্সের চেয়ে অনেক বেশি। মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের এক বড় এলাকাতেই রক্ষণশীলরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেসব জায়গায় একজন সমাজতন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারবেন কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আমরা ধরে নিতে পারি যে এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই ডেমোক্র্যাটদের তৃণমূল ভোট দিয়েছে এবং তাদের পছন্দ হিসেবে এগিয়ে আছেন হিলারি ক্লিনটন। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে বার্নি স্যান্ডার্স দলের প্রাথমিক পর্যায়ে তরুণদের আগ্রহী করে তুলেছেন। তাঁদের বাদ দিয়ে, তাঁদের অবজ্ঞা করে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থী এগোতে পারবেন না। ফলে ২০০৮ সালের প্রাথমিকের পরে সাধারণ নির্বাচনে ওবামা ও হিলারি যেভাবে একত্রে কাজ করেছেন, সেভাবেই এবারও এ দুই প্রার্থীকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে; এর অন্যথা হলে তার ফল হবে দলের জন্য নেতিবাচক। কিন্তু গত কয়েক দিনে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে ৭ জুন ছয়টি অঙ্গরাজ্যের ফলাফলে নাটকীয় কিছু না ঘটলেও স্যান্ডার্স তাঁর প্রার্থিতা অব্যাহত রাখবেন এবং সম্মেলনে তাঁর নিষ্পত্তি করতে চাইবেন এই যুক্তিতে যে সুপার ডেলিগেটদের উচিত হবে তাঁর পক্ষে দাঁড়ানো। শুধু তা-ই নয়, তিনি মনে করেন, এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া গোড়া থেকেই তাঁর পক্ষে ছিল না। এসব ইঙ্গিতের কারণেই প্রশ্ন, ডেমোক্রেটিক পার্টিকে শেষ পর্যন্ত কি একটি বিভক্তিসূচক সম্মেলন দেখতে হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাব ৭ জুনের পরে; আর সেই উত্তর কী হবে তার বেশির ভাগ জানেন বার্নি স্যান্ডার্স। হিলারি ক্লিনটনের দায়িত্ব হচ্ছে এ অবস্থা যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে ৭ জুনের পরপরই স্যান্ডার্স এবং তাঁর সমর্থকদের দিকে তাঁর হাত প্রসারিত করা।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.