ট্রাম্পের উত্থানের পেছনে

দুই বছর আগে যা মনে হতো অকল্পনীয়, দেড় বছর আগে যা মনে হয়েছিল অসম্ভব, এক বছর আগে যাকে বলা হয়েছিল অচিরেই মিলিয়ে যাওয়ার মতো সাময়িক আলোচনার বিষয়, এখন সেটি হচ্ছে বাস্তবতা। এই বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে কার্যত মনোনীত হয়েছেন দলের বাইরে থেকে আসা কোটিপতি আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৮ থেকে ২১ জুলাই অনুষ্ঠেয় দলের সম্মেলনে তিনিই যে আনুষ্ঠানিকভাবে মনোনীত হবেন তা নিয়ে সংশয়ের কারণ নেই। কেননা, দলের মনোনয়নের জন্য প্রয়োজনীয় ১ হাজার ২৩৭ জন ডেলিগেটের চেয়েও বেশি ডেলিগেটের সমর্থন তাঁর পক্ষে আছে; জুন মাসে পাঁচটি অঙ্গরাজ্যে বাকি যে ৩৩৪ জন ডেলিগেট নির্বাচিত হবেন, তাঁদের সমর্থনের সবটা না হলেও সিংহভাগ তাঁর পক্ষেই যাবে। কেননা, তাঁর আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
এত দিন যাঁরা ‘ঠেকাও ট্রাম্প’ বলে হুংকার দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করছিলেন, তাঁরা এখন রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। ট্রাম্পের এককালীন প্রতিদ্বন্দ্বীরা এখন তাঁর প্রতি মৌন বা সরব সমর্থন দিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন। একপর্যায়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে তাঁর মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দলে বড় ধরনের বিভক্তি আসবে, সেই আশঙ্কাও কার্যত তিরোহিত হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। তার অর্থ অবশ্য এটা নয় যে প্রার্থী হিসেবে তিনি দলের সবার পছন্দের ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন; এ-ও নয় যে তিনি তাঁর কট্টর অবস্থান থেকে সরে এসেছেন।
অভিবাসী, হিস্পানিক ও মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং নারীদের ব্যাপারে ট্রাম্পের দেওয়া বক্তব্য ও তাঁর মনোভঙ্গি যে অবমাননাকর এবং তাঁর সঙ্গে যে দেশের এক বড় অংশের নাগরিকেরা একমত নন, সেই বিষয়ে রিপাবলিকান দলের নেতারা অবহিত। এসব বিষয় যে নির্বাচনে তাঁদের দলের জন্য বোঝা হয়ে উঠতে পারে, সেই বিষয়েও তঁাদের একাংশের উপলব্ধি আছে। যে কারণে দলের শীর্ষ নেতাদের একটা বড় অংশ চাইছিলেন না ট্রাম্প মনোনয়ন পান। কিন্তু দলের তৃণমূলে ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন এবং সব ধরনের বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তিনি এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ট্রাম্পের এই নাটকীয় উত্থানের কারণ কী? দায়িত্বশীল আচরণে অনীহ এবং উপর্যুপরি ব্যত্যয় ঘটানো একজন ব্যক্তি যে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হলেন, সেটা কী করে সম্ভব হলো? তার কারণ অংশত নিহিত আছে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে, আর অংশত আছে রিপাবলিকান দলের নেতাদের অপরিণামদর্শী আশু সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কৌশলের মধ্যে। প্রথমটিকে আমি বহিঃস্থ কারণ বলে মনে করি, আর দ্বিতীয়টিকে আমার মনে হয় আগুন নিয়ে খেলার পরিণতি। ২০০৮ সালে যে মন্দা দেখা দিয়েছিল তা কাটিয়ে গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়েছে এবং ইউরোপের অনেক দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি বেশি। বেকারত্বের হার কমেছে, কর্মসংস্থানের হারও সন্তোষজনক। কিন্তু অতীতের বিভিন্ন প্রশাসনের অনুসৃত নীতিমালা ও বিশ্বজুড়ে নিও-লিবারেল অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফল হিসেবে গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে।
নিও-লিবারেল অর্থনৈতিক আদর্শ গুটিকয় মানুষ এবং করপোরেশনের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনলেও দেশে দেশে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যুক্তরাষ্ট্রের গরিব মানুষের জন্যও তা সমানভাবে সত্য। অনেকের হয়তো মনে থাকবে যে সেই বৈষম্যের প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই ২০১১ সালে তৈরি হয়েছিল ‘অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট’ বা ‘৯৯ শতাংশ’ আন্দোলন। যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রবণতা সত্ত্বেও দেশের গরিব মানুষের একাংশ এখনো এর সুবিধা পায়নি। তাদের অনেকেই এই মন্দার আগে থেকেই ছিল ‘ভালনারেবল’। পরে এই মন্দা এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার শ্লথ প্রক্রিয়া তাদের ঠেলে দিয়েছে একেবারে প্রান্তসীমায়। এ অবস্থা মোকাবিলায় ওবামা প্রশাসনের অনেক পদক্ষেপ কার্যকর করা যায়নি ২০১০ সাল থেকে আইনসভা বা কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে। তারা আশু রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশায় ওবামার কার্যক্রমকে ঠেকাতে গিয়ে কংগ্রেসকে এক নিষ্ক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। গত কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র যেসব বাণিজ্যিক চুক্তি করেছে, তাতে অনেক কাজ, বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অনেক কাজ দেশের বাইরে চলে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনও এর কারণ। এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে একধরনের আপাতদৃষ্টে ‘বিদেশিভীতি’ রয়েছে বলেই মনে হয়।
তাদের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে জনতাত্ত্বিক পরিবর্তন হচ্ছে তাতে শ্বেতাঙ্গরা একসময় সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে এবং সেই বহুত্ববাদী সমাজে ‘তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি’ হারিয়ে যাবে। গত কয়েক দশকে বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমেছে। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের একসময়ের পররাষ্ট্রনীতির আগ্রাসী বৈশিষ্ট্য যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, তেমনি ওবামা প্রশাসন তা করতে ততটা আগ্রহী ছিল না। পরিবর্তিত বাস্তবতা বুঝতে অপারগ বা অনীহ মার্কিন নাগরিকদের একাংশ মনে করে যে প্রশাসন স্বেচ্ছায় দেশের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতিকে দুর্বল করে ফেলেছে। রিপাবলিকান দলের সদস্য ও সমর্থকদের বড় অংশ এ জন্য একাধারে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন এবং রিপাবলিকান দলের নেতাদের দায়ী করে। আর এই অংশের প্রত্যাশা ছিল এমন এক প্রার্থী, যিনি তাদের এই মনোভঙ্গিকে কোনো রকম রাখঢাক না করে তুলে ধরবেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প দলের এই অংশের কাছেই তাঁর আবেদন তৈরি করতে চেষ্টা করেছেন এবং তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। এখানে মনে রাখা দরকার, রিপাবলিকান দলের সবাই এমন মনে করেন বিষয়টি তা নয়। রিপাবলিকান দলের যে সদস্যরা ট্রাম্পকে তাঁদের পছন্দ বলে বেছে নিয়েছেন, তাঁরা শুধু ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়তে পারেন—এমন একজন প্রার্থী বেছে নিয়েছেন তা-ই নয়, তাঁরা একই সঙ্গে রিপাবলিকান দলের নেতাদের বিরুদ্ধে তাঁদের বিদ্রোহের জানান দিয়েছেন।
তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন যে রিপাবলিকান দলের এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে তাঁরা একমত নন এবং যতই দলের নেতারা ট্রাম্পকে ঠেকাতে চেয়েছেন তৃণমূলের সমর্থকেরা ততই ট্রাম্পের পক্ষেই ঝুঁকেছেন। গত কয়েক মাসে রিপাবলিকান দলের নেতারা যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মনোনয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নিকট অতীতে তাঁদের বক্তব্য এবং কার্যক্রমই যে ট্রাম্পের উত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে, সেটা বোঝা দরকার। ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের একাংশের ধারণা হয়েছিল যে তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জন ম্যাককেইন যথেষ্ট রক্ষণশীল নন, ফলে তাঁরা বিস্ময়করভাবে রক্ষণশীলদের প্রতিনিধি হিসেবে আলাস্কার গভর্নর এবং প্রায় অপরিচিত সারাহ পেলিনকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেন। ওবামা জন্মসূত্রে মার্কিন নন, তিনি ধর্মবিশ্বাসে মুসলিম—এজাতীয় ভিত্তিহীন অপপ্রচারের ব্যাপারে দলের নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দলে অতিমাত্রার রক্ষণশীল ও কট্টর দক্ষিণপন্থী ব্যক্তিদের শক্তি জুগিয়েছে। এই ধারার অংশীদারেরাই ২০০৯ সালের গ্রীষ্মকালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রস্তাবিত স্বাস্থ্যবিমা সংস্কারের বিরুদ্ধে রিপাবলিকান দলের ভেতরে সবচেয়ে সরব এবং সক্রিয় ছিলেন। তাঁরা সেই সময়েই ‘টি-পার্টি’ বলে নিজেদের সংগঠিত করেন এবং দলের প্রবণতাকে আরও দক্ষিণে ঠেলে দেন। এই গোষ্ঠীটি দলের প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং ২০১০ সালে প্রতিনিধি পরিষদ এবং সিনেটের নির্বাচনে তাদের পছন্দের অনেক ব্যক্তির মনোনয়ন দেওয়াতে সক্ষম হয়। সেই নির্বাচনে রিপাবলিকান দল আশাতীত সাফল্য লাভ করে—আইনসভার দুই কক্ষই তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। দলের নেতারা বিজয়ের আনন্দে সম্ভবত এটা বিস্মৃত হন যে এতে করে দলের ওপরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণই কেবল দুর্বল হচ্ছে তা নয়, দল আদর্শিকভাবেও কট্টর দক্ষিণপন্থী পথে চলতে শুরু করেছে। ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় দলের পছন্দের প্রার্থী মিট রমনি অনেক কষ্টে মনোনয়ন পেলেন বটে; কিন্তু বড় আকারের পরাজয় বরণ করলেন। সেই সময়ে দলের প্রতিষ্ঠিত নেতাদের কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হলো এবং বারবার তাঁরা বললেনও যে তাঁদের দরকার দলের ভেতরে বৈচিত্র্য আনা, সংখ্যালঘুদের কাছে আবেদন তৈরি করা,
কিছু সামাজিক বিষয়ে অন্ততপক্ষে মধ্যপন্থী অবস্থান নেওয়া। কিন্তু রক্ষণশীলদের জন্য শিক্ষা হলো তাঁদের প্রার্থীর উচিত আরও রক্ষণশীল হওয়া, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত বিষয়গুলো আরও কঠোরভাবে মোকাবিলা করা। দলের নেতারা হয় স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে এ পথেই এগোলেন। ২০১৪ সালের আইনসভার নির্বাচনের ফলাফলের সাফল্য থেকেও এটা স্পষ্ট হলো যে দলের ভেতরে কট্টরপন্থীরা অনেক শক্তিশালী। তারা যখন দলের প্রাথমিক নির্বাচনে প্রতিনিধি সভায় দলের নেতা এরিক ক্যান্টরকে সহজেই হারিয়ে দিল, তখন নেতাদের টনক নড়লেও এবং নির্বাচনের পর এটা বুঝলেও যে এই কট্টর অবস্থান দলের জন্য আদর্শিকভাবে ক্ষতির কারণ হচ্ছে দল ক্রমাগতভাবে অধিবাসী, কৃষ্ণাঙ্গ ও নারীদের সমর্থন হারাচ্ছে তাঁরা এ বিষয়ে খুব বেশি ব্যবস্থা নেননি; বরং তাঁরা ভেবেছেন যে একসময় রাশ টেনে ধরা যাবে। ইতিমধ্যে দলের তুলনামূলক উদার ও মধ্যপন্থীরা দল থেকে ছিটকে পড়েছেন। এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে দলের এস্টাবলিশমেন্ট তাঁদের নিজেদের ক্ষমতাকেই কেবল হারিয়েছেন তা নয়, কট্টরপন্থী ব্যক্তিদের বক্তব্যকেই দলের অবস্থানে পরিণত করেছেন, দলের কর্মীদের একাংশের মধ্যে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে যে তাঁদের প্রার্থীকে হতে হবে কঠোর এবং প্রচলিত রাজনীতিবিদদের মতো হিসেবি নয়। ট্রাম্প এসব প্রত্যাশা পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েই প্রার্থিতা পেয়েছেন। যে আগুন নিয়ে রিপাবলিকান দলের নেতারা খেলেছেন, একার্থে তার ফল হচ্ছে ট্রাম্পের উত্থান। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তি দেখাতে গিয়ে কট্টরপন্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার ফলে দলের ভেতরে চিড় ধরেছে, দল তার ঐতিহ্য থেকে সরে গিয়ে কট্টর দক্ষিণপন্থী দলে পরিণত হতে চলেছে। এর প্রভাবে মার্কিন সমাজে বিরাজমান বিভক্তি বেড়েছে, সমঝোতা-বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে আরও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যেসব আদর্শ, নীতি এবং প্রবণতাকে প্রতিনিধিত্ব করেন, সেগুলোকে মার্কিন নাগরিকদের অধিকাংশ সমর্থন করেন কি না, তার উত্তরের জন্য আমাদের নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আগামীকাল: হিলারির মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.