আসাম নির্বাচনে দৃষ্টির বাইরে ‘ডি–ফ্যাক্টর’ by তরুণ চক্রবর্তী

মিটিং-মিছিলে শামিল হলেও ভোটে ব্রাত্য
উত্তর-পূর্ব ভারতের আসামের বিধানসভা নির্বাচনে গৌণ হয়ে পড়েছে মানবিক ইস্যু ‘ডি-ফ্যাক্টর’। কংগ্রেস, বিজেপি তো বটেই, সংখ্যালঘুদের দল বলে পরিচিত সাদৌ আসাম সংযুক্ত গণতান্ত্রিক মোর্চা (এআইইউডিএফ) এ বিষয়ে নীরব। অথচ, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বহু মানুষই এই ‘ডি-ফ্যাক্টরের’ শিকার। ‘ডি’ মানে ডিটেনশন বা আটক। ডিটেনশন ক্যাম্প হলো ডি-ক্যাম্প। ডি-তে আবার ডাউটফুল (সন্দেহজনক) অথবা ‘ডিসপুটেডও’ হতে পারে। রাজ্যের ভোটার তালিকায় নামের পাশে ‘ডি’ মানেই কপালে অশেষ দুর্ভোগ। বিদেশি বা তথাকথিত বাংলাদেশি সন্দেহে বহু মানুষ আটক ডিটেনশন ক্যাম্পে। নামে ডিটেনশন ক্যাম্প বা আটককেন্দ্র হলে কী হবে, আসলে এটা এক ধরনের জেলখানা। আসামের কোকরাঝাড়, শিলচর, ডিব্রুগড় ও গোয়ালপাড়ায় রয়েছে ডি-ক্যাম্প। শতাধিক মানুষ এই ক্যাম্পে বন্দী, রয়েছে শিশুও। বেশির ভাগই গরিব। বিদেশি সন্দেহে আটক লোকজনের মধ্যে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। গত লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে গুঁড়িয়ে দেবেন ডি-ক্যাম্প। এখন তিনি ভারতের সর্বোচ্চ ক্ষমতায়। কিন্তু ডি-ক্যাম্পে বন্দীর সংখ্যা বাড়ছেই। তবে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন এগোয়নি। ওই বন্দীরা কেউই ভোটার নন তো!। গুয়াহাটির সাংবাদিক কুন্তল চক্রবর্তী জানালেন, ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির স্থানীয় নেত্রী তথা সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিজয়া চক্রবর্তী কোকরাঝাড় ক্যাম্পে এক শিশুর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বিজেপি জিতলেই মা-বাবার সঙ্গে ও মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াতে পারবে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র দিয়ে বহু পানি বয়ে গেলেও পরিবারটি সেই ডি-ক্যাম্পেই রয়ে গেছে। বিজয়া চক্রবর্তীর ওপরই সন্দেহ প্রকাশ করে প্রশাসন। বিজয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য পুলিশ বিষয়টি পরে সহজেই নিষ্পত্তি করে। কিন্তু গরিব সাধারণ মানুষ একবার সন্দেহের কবলে পড়লে সহজে নিস্তার নেই। এ ছাড়া আছে ডি-ভোটার। ১৯৯৮ সালে চালু হয় ভোটার তালিকায় ‘ডি’ চিহ্নিত করার কাজ। অভিযোগ আছে, কাউকে সন্দেহ হলেই তাঁর নামের পাশে লাগিয়ে দেওয়া হয় ‘ডি’ ছাপ। নিছক সন্দেহের বসেই সঙ্গে সঙ্গে খারিজ হয় তাঁর ভোটাধিকার। ট্রাইব্যুনালে গিয়ে প্রমাণ করতে হয় নিজের নাগরিকত্ব। জাল ভোটার বাদ দিতে নির্বাচন কমিশন এই ফর্মুলা বের করে। এর প্রতিবাদে আইনজীবী হাফিজ রশিদ আহমেদ চৌধুরী মামলা করেন গুয়াহাটির উচ্চ আদালতে। আদালত নির্দেশ দেন, অভিযোগের ছয় মাসের মধ্যেই তা নিষ্পত্তি করতে হবে। সত্যি না হলে ট্রাইব্যুনালকে ‘ডি’ হটাতে হবে। প্রথম আলোকে হাফিজ রশিদ বলেন, মোটেই মানা হচ্ছে না হাইকোর্টের রায়। গোটা রাজ্যে ১ লাখ ৩৭ হাজারেরও বেশ ডি-ভোটার রয়েছেন। কিছুদিন আগেও এর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজারের বেশি। ১০০টি ট্রাইব্যুনাল করায় সংখ্যাটা কিছুটা কমেছে। হাফিজ রশিদের সাফ কথা, ‘ওঁদের যেহেতু ভোটাধিকার নেই, তাই এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছেন না।’ তাঁর মতে, মুসলিমদের ভোটদানে বিরত রাখতেই এই ‘ডি’ কারসাজি বিজেপির। বিদেশি শনাক্তকরণ প্রসঙ্গে রশিদ জানান, এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল প্রায় ৮৫ হাজার মামলার নিষ্পত্তি করেছে। এর মধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। ভোটের প্রচারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল হাজারো বিষয়ে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিলেও ডি-ফ্যাক্টর বিষয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব। জানতে চাইলে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অঞ্জন দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সহানুভূতির সঙ্গে বিষয়টি দেখছি। বিজেপি আর এজিপি (অসম গণপরিষদ) মিলে বিষয়টিকে জটিল করে তুলছে।’ বিজেপির নেতা হীমন্ত বিশ্বশর্মার পাল্টা দাবি, ‘নরেন্দ্র মোদিই তো বলেছেন ডি-ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেবেন। একটু সময় দিন।’ আর এআইইউডিএফের কার্যকরী সভাপতি আদিত্য লাংথাসা সহানুভূতি জানালেন ‘ডি’র শিকার লোকজনের প্রতি।

No comments

Powered by Blogger.