চট্টগ্রামে উড়াল সড়ক কাজে লাগছে না!

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক ফাঁকা, অথচ নিচে গাড়ির জট।
গতকাল বিকেল সাড়ে চারটায় বহদ্দারহাট প্রান্ত থেকে তোলা
চট্টগ্রাম নগরের যানজট নিরসনে গত আড়াই বছরে দুটি উড়ালসড়ক চালু হয়েছে। নির্মাণকাজ চলছে একটির। কাজ শুরু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে আরও একটির। উড়ালসড়কের ওপর নির্ভরতা এবং এর কার্যকারিতা ও সুফল নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। চট্টগ্রামের সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীরা ২০১৪ সালের ১২ জুন বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচল করা গাড়ির সংখ্যা পরিমাপ করেন। ওই দিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ১ হাজার ১৯২টি গাড়ি এই উড়ালসড়ক দিয়ে ওঠানামা করে। এর মধ্যে বাস, ট্রাক ও মিনিবাস ছিল ৩৮৮টি। একই দিন সকাল ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত উড়ালসড়কে ওঠানামা করে ৩১০টি গাড়ি। এর মধ্যে বাস, ট্রাক ও মিনিবাসের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫টি। বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক দিয়ে চলাচল করা গাড়ির সংখ্যা একেবারেই কম বলে মন্তব্য করেছেন সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের প্রধান আলী আশরাফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি উড়ালসড়ক কার্যকর হতে হলে ঘণ্টায় অন্তত সাড়ে আট হাজার গাড়ি চলাচল করা প্রয়োজন। কিন্তু বহদ্দারহাট উড়ালসড়কে তা দেখা যায়নি। বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়। এর নির্মাণ ব্যয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। চার লেনের এই উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৩৩১ কিলোমিটার ও প্রস্থ ১৪ মিটার। এই উড়ালসড়ক দিয়ে মুরাদপুর থেকে শাহ আমানত সেতু এলাকায় যাওয়া-আসা করা যায়। এই উড়ালসড়ক ব্যবহার করে বহদ্দারহাট থেকে আরাকান সড়কে গাড়ি নামার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সেখানে নতুন একটি র্যাম্প (শুধু নামার পথ) করার উদ্যোগ নিয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের জন্য উড়ালসড়কের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে মত দিয়েছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। তাঁর দাবি, যেসব উড়ালসড়ক নির্মিত হচ্ছে তাতে কিছুসংখ্যক মানুষ সুবিধা পাবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক করা হলে নগরের যানজট অনেকাংশেই কমে যাবে। এর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করার প্রয়োজন নেই। শুধু দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা। অবশ্য প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়ার বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরে ব্যক্তিগত ও গণপরিবহনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। আবার ধীরগতির যানবাহনের (বিশেষ করে রিকশা) কারণে সড়কের অন্য গাড়ির চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এসব কারণে উড়ালসড়কের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উড়ালসড়ক দিয়ে ধীরগতির যানবাহন চলাচল করতে পারে না। ৩ এপ্রিল কদমতলী উড়ালসড়ক দিয়ে ওঠা-নামা করা গাড়ির সংখ্যা পরিমাপ করে সিডিএ। ওই দিন সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় ৮ হাজার ৯১৪টি গাড়ি উড়ালসড়ক ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ, প্রতি ঘণ্টায় গাড়ি চলেছে ৭৪২টি। চলতি বছরের ৩০ জানুয়ারি কদমতলী উড়ালসড়ক উদ্বোধন করা হয়। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪৩ কোটি টাকা। দুই লেনের এই উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার। বটতলী রেলওয়ে স্টেশনের সামনে থেকে শুরু হওয়া এই উড়ালসড়ক শেষ হয়েছে দেওয়ানহাটের বায়তুশ শরফ মাদ্রাসার সামনে। এই উড়ালসড়ক ব্যবহার করলে এখন আর কদমতলী রেলক্রসিংয়ে যানজটে আটকা পড়তে হয় না। তবে এই উড়ালসড়ক দিয়ে কদমতলী থেকে টাইগারপাস যাওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম দাবি করেন, পরামর্শকদের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা যাচাই করে পরিকল্পিতভাবে উড়ালসড়ক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মুরাদপুর-লালখান বাজার ও লালখান বাজার-বিমানবন্দর উড়ালসড়ক নির্মিত হলে নগরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। সিডিএ ও সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জরিপ বলছে, বেশির ভাগ গণপরিবহন এই দুটি উড়ালসড়ক ব্যবহার করতে চায় না। এর কারণ হিসেবে চালকেরা বলছেন, উড়ালসড়ক দিয়ে গাড়ি চললে যাত্রী কম পাওয়া যায়। এ জন্য তাঁরা নিচ দিয়ে গাড়ি চালান। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যে উড়ালসড়কগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তা গণপরিবহনের কোনো কাজে আসে না। যদি প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে গাড়ি ওঠা-নামার ব্যবস্থা রাখা হয়, তাহলে উড়ালসড়ক ব্যবহার করা সম্ভব হবে। গত শনিবার রাতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্র আয়োজিত আলোচনা সভায় চট্টগ্রামের উন্নয়নে উড়ালসড়কের কার্যকারিতা নিয়ে তুমুল বিতণ্ডায় জড়ান গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এবং সাংসদ আফছারুল আমীন। সভায় চারজন বিশেষজ্ঞ অপরিকল্পিতভাবে উড়ালসড়ক নির্মাণের সমালোচনা করেন। মন্ত্রীও তাঁর বক্তব্যে বলেন, উড়ালসড়কগুলোতে গাড়ি ওঠে না। এগুলো রেখে লাভ নেই।
কদমতলী উড়ালসড়কের নিচে গাড়ি চলছে। গতকাল
বেলা তিনটায় কদমতলী প্রান্ত থেকে তোলা
২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর মুরাদপুর-লালখান বাজার উড়ালসড়কের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। ব্যয় হচ্ছে ৪৬২ কোটি টাকা। এই উড়ালসড়কটি সম্প্রসারণ করে বিমানবন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সিডিএ। এতে ব্যয় হবে ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। চুয়েটের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কে প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন ধরনের ৫৪ হাজার ৮৯৫টি গাড়ি চলাচল করে। ২০৪৯ সালে এর পরিমাণ হতে পারে ২ লাখ ২৯ হাজার ২৪২টি। বহদ্দারহাট ও কদমতলী উড়ালসড়কে পর্যাপ্ত যানবাহন না চলার বিষয়ে অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, গাড়ি ওঠা-নামার পথ (র্যাম্প) না থাকায় বহদ্দারহাট উড়ালসড়ক একটি বিচ্ছিন্ন উড়ালসড়কে পরিণত হয়েছে। আর কদমতলীতে গাড়ির পরিমাণ কম কেন এটি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। তবে মুরাদপুর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত উড়ালসড়কে বিভিন্ন মোড়ে গাড়ি ওঠা-নামার পথ থাকায় এটি অনেক বেশি কার্যকর হবে। উড়ালসড়কের কার্যকারিতা ও সুফল নিয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বিশেষজ্ঞ নই। তাই কোনো মন্তব্য করব না। তবে যেকোনো উন্নয়নমূলক কাজ পরিকল্পিতভাবে করা উচিত।’

No comments

Powered by Blogger.