তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক চার মাসের বেশি নিখোঁজ

মো. আবদুল হান্নান
‘তোমার সন্তানদের তুমি ভালোবাসো না? ওদের জন্য হলেও তো তোমাকে বাঁচতে হবে।’ গত ৭ ডিসেম্বর নিখোঁজ হওয়ার আগে স্বামী মো. আবদুল হান্নানের সঙ্গে আফরোজা সুলতানার এই ছিল শেষ কথা। সেদিনই তেজগাঁও কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক এই সহসভাপতি নিখোঁজ হন। চার মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আবদুল হান্নানের খোঁজ মেলেনি। মন্ত্রী-দলীয় সহকর্মী-কর্মস্থল-পুলিশ—কারও কাছ থেকে স্বামীর সন্ধান পাননি আফরোজা। ৭ ডিসেম্বর আবদুল হান্নান ট্রাউজার ও ফুলশার্ট পরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। ইন্দিরা রোডে তেজগাঁও কলেজের শিক্ষকদের আবাসিক ভবনে সপরিবারে থাকতেন তিনি। স্ত্রী আফরোজাও একই কলেজের শিক্ষক। যাওয়ার আগে মুঠোফোনটি বাসায় রেখে যান আবদুল হান্নান। সকালে দুই সহকর্মী তাঁকে চন্দ্রিমা উদ্যানের দিকে যেতে দেখেছেন। এর বেশি আর কোনো তথ্য পরিবারের কাছে নেই। আবদুল হান্নান নিখোঁজ হওয়ার এক দিন পর ৮ ডিসেম্বর আফরোজা সুলতানা শেরেবাংলা নগর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। গতকাল শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডায়েরি করার পর থেকে আমিই থানায় ফোন করে খবর নিয়েছি কোনো খোঁজ আছে কি না। র্যাব-২-এ অভিযোগ করেছি। কোনো দিন পুলিশ বা র্যাবের পক্ষ থেকে কেউ এসে আমার সঙ্গে কথা বলেনি।’ তেজগাঁও কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি স্থানীয় সাংসদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আফরোজা একাধিকবার তাঁর কাছেও গেছেন বলে জানান। শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোপাল গণেশ বিশ্বাস গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো খবর নেই। তবে আমরা জেনেছি, উনি প্রায়ই এ রকম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন।’ আফরোজা যাঁদের কাছে যাচ্ছেন, তাঁরা সবাই আবদুল হান্নানের শারীরিক অসুস্থতার প্রসঙ্গ টানছেন। আফরোজা বলেন, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলায় হান্নানের মাথার সামনের দিকে একটি স্প্লিন্টার ঢুকেছিল। তবে কলেজের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে লম্বা সময় ধরে বিষণ্নতায় ভুগছিলেন তিনি। কলেজ সূত্র জানায়, ২০১১ সালে তেজগাঁও কলেজ বিজ্ঞাপন দিয়ে উপাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়। আবদুল হান্নান সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ওই পদে নিয়োগ পান। মাস দুয়েক পর কলেজের দুজন শিক্ষক ওই নিয়োগের বিরুদ্ধে মামলা করেন। একপর্যায়ে আদালত সিদ্ধান্ত দেন, পরিচালনা পর্ষদ যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা-ই চূড়ান্ত। কিন্তু আবদুল হান্নানের পরিবর্তে ওই পদে নিয়োগ পান কলেজের অধ্যক্ষের ভাই হারুন অর রশীদ। কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ ও মো. আবদুল হান্নান দুজনের বাড়িই জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে। দুজনেই সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। চার-পাঁচ দিন আগে আবদুর রশীদ তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ পেয়েছেন। তাঁর ভাই হারুন অর রশীদ সরিষাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। জানা গেছে, মো. আবদুল হান্নান দুঃখ করে অনেককেই বলেছিলেন, দল ক্ষমতায় থাকার পরও তাঁকে সরে আসতে হলো, এ বিষয়টি তিনি মানতে পারছেন না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন তিনি। সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত দীর্ঘদিন। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর সমস্যার সুরাহা হবে। দলের শীর্ষ নেতাদের কাছে বহুবার ধরনাও দিয়েছেন। এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘উপাধ্যক্ষ পদ নিয়ে আবদুল হান্নানের কোনো ক্ষোভ ছিল না। মামলা-মোকদ্দমা ছিল। সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। আমার ভাই উপাধ্যক্ষ হয়েছে, কারণ সে মেধাবী, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।’ তবে আফরোজা সুলতানার দাবি, তাঁর স্বামী এত অসুস্থ ছিলেন না যে হারিয়ে যাবেন। তিনি নিয়মিত আত্মীয়স্বজন, কলেজের সহকর্মী, দলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। অনেক সাংসদের ফোন নম্বরও তাঁর মুখস্থ ছিল। প্রতিদিন কমপক্ষে দুবার মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন আবদুল হান্নান। এমনকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচিতদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল।

No comments

Powered by Blogger.