শফিক রেহমান গ্রেপ্তার, পাঁচ দিনের রিমান্ডে

সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গতকাল ঢাকা
মহানগর হাকিম আদালতে নেওয়া হয়
বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল আটটার দিকে রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের বাসা থেকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তাঁকে আটক করে নিয়ে যায়। পরে গত বছরের পল্টন থানার একটি হত্যা পরিকল্পনার মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে এবং তাঁর তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনায় পুলিশ গত বছরের আগস্টে পল্টন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। পরে তা মামলায় রূপান্তরিত হয়। সেই মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। প্রসঙ্গত, জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা হয়েছিল নিউইয়র্কে। সেখানে এই মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। মামলার রায়ে সেখানকার বিএনপি নেতার ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারের ৪২ মাসের কারাদণ্ড হয়। এ ছাড়া ঘুষ লেনদেনের জন্য এক এফবিআই এজেন্টের বন্ধুর ৩০ মাসের কারাদণ্ড হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনায় শফিক রেহমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের কললিস্ট চেক করে এ ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত তাঁদের সঙ্গে শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানের ফোনে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল শফিক রেহমানকে নিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর তাঁকে আটকের কথা স্বীকার করে পুলিশ। দুপুরে শফিক রেহমানকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চায় পল্টন থানার পুলিশ। বিচারক মাজহারুল ইসলাম পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। শফিক রেহমানের স্ত্রী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ডেমক্রেসিওয়াচের নির্বাহী পরিচালক তালেয়া রেহমান সাংবাদিকদের বলেন, ডিবির তিনজন সদস্য বৈশাখী টেলিভিশনের সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বাসায় আসেন। এত সকালে সাংবাদিকদের বাসায় আসার খবর শুনে তাঁর একটু সন্দেহ হয়েছিল। শফিক রেহমানের বাসার তত্ত্বাবধানকারী আবদুল মতিন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সকাল ছয়টার দিকে বাসার মূল গেটে প্রথমে দুজন ধাক্কা দেন। তারপর আরেকজন আসেন। তাঁরা একটি টিভি চ্যানেল থেকে এসেছেন বলে জানান। তাঁরা বলেন, ওই টিভিতে শফিক রেহমানের অনুষ্ঠান আছে। তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছেন। মতিন বাসার পেছনে তিনতলা ভবনের নিচতলায় তিনজনকে বসান। তিনতলায় থাকা শফিক রেহমানকে বিষয়টি জানানো হলে তিনি তাঁদের নাশতা দিতে বলেন। তাঁরা তিনজন নাশতা খান। শফিক রেহমানের নামতে দেরি হলে সকাল আটটার দিকে তাঁরা বাসার বাবুর্চি আলীকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে ওপরে যেতে বলেন। আলী উঠতে থাকলে ওই তিনজনও পিছু পিছু দোতলা পর্যন্ত উঠে যান। এ সময় শফিক রেহমান নিচে নামছিলেন। আবদুল মতিন বলেন, শফিক রেহমান দোতলায় নামার পর ওই তিনজন ডিবি থেকে এসেছেন জানিয়ে তাঁকে নিচে নামিয়ে আনেন। এ সময় বাবুর্চি আলী ও তিনি বাধা দিতে গেলে তাঁরা ডিবি পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘তুই আসবি না’। এরপর বাসার সামনে দাঁড়ানো মাইক্রোবাসে করে সকাল আটটার দিকে শফিক রেহমানকে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ডিবি কার্যালয়ের পরিচয় দিয়ে শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমানের কাছে একটি ফোন আসে। তালেয়া রেহমান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, শফিক রেহমানের জন্য নাশতা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ ডিবি কার্যালয় থেকে চেয়ে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো পাঠানো হয়েছে। তিনি কোলেস্টরেল আধিক্যজনিত সমস্যা ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। দুপুর ১২টার দিকে তালেয়া রেহমান মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে যান। শফিক রেহমানের যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে। তাঁর স্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, ডিবি পুলিশের গ্রেপ্তারের বিষয়টি ঢাকায় ব্রিটিশ দূতাবাসকে জানানো হয়েছে। ‘শফিক রেহমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে’: মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার মো. মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা পরিকল্পনা মামলা তদন্ত করছে ডিবি। এতে শফিক রেহমানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এ কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে, দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে । মারুফ হোসেন বলেন, শফিক রেহমান ২০১৩ সালে একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। তখনই জয়কে অপহরণ ও হত্যার পরিকল্পনা করা হয় বলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানতে পেরেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোজাম্মেল হক সাক্ষ্য গ্রহণের একপর্যায়ে এ ঘটনায় শফিক রেহমানের সম্পৃক্ততা পেয়েছেন। তাই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য: তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গতকাল রাতে বিবিসি বাংলাকে বলেন, সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রে ফাঁস হলে সেই মামলায় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন রকম তদন্ত হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কিছু তথ্য আছে। এত দিন বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা করেছে, পুরো বিষয়টা খতিয়ে দেখেছে। সেই মামলার সঙ্গে শফিক রেহমানের সম্পর্ক আছে মনে করেই কর্তৃপক্ষ তাঁকে আদালতে পেশ করেছে। প্রাথমিক অভিযোগকারী নাম না দিলেও তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তের মধ্য দিয়ে বহু অজানা তথ্য পান এবং তার ভিত্তিতে অনেক দোষী ব্যক্তি সামনে চলে আসে বলে মন্তব্য করেন তথ্যমন্ত্রী। এ ঘটনায় সরকারের বিরুদ্ধে ভিন্নমত দমনের অভিযোগ উঠবে কি না, প্রশ্ন করা হলে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে যদি ভিন্নমত দমনের নীতি থাকত এবং পত্রপত্রিকা সরকারের সমালোচনামুখর না হতো, তাহলে আপনার অভিযোগ আমি গ্রহণ করতাম। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক এবং প্রিন্ট মাধ্যম সরকারের সমালোচনায় মুখর এবং হাসিমুখে আমরা তা সহ্য করছি।’ সাংবাদিক শওকত মাহমুদ ও আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘদিন আটক রাখা প্রসঙ্গে হাসানুল হক ইনু বলেন ‘এটা গণমাধ্যমের সমালোচনা করার অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ না। এটা ব্যক্তির অপরাধজনিত ঘটনা।’শফিক রেহমান দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার সাবেক প্রকাশক ও সম্পাদক। বর্তমানে তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক মৌচাকে ঢিল বের হচ্ছে। তিনি বিএনপির কূটনৈতিক বিভাগের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বশেষ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলনে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি।খালেদা জিয়ার বিবৃতি: শফিক রেহমানের গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অবৈধ’ সরকার জনগণের বিরুদ্ধে এখন যুদ্ধ শুরু করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে সাজানো মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সম্পাদকদেরও গ্রেপ্তার এবং নির্যাতন করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, শফিক রেহমান সত্য উচ্চারণে অবিচল ও সাহসী এক কলমযোদ্ধা। সে কারণে তাঁকে কবজা করতে না পেরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এটি সরকারের চরম স্বেচ্ছাচারিতারই বহিঃপ্রকাশ। শফিক রেহমানকে আটকের খবর পেয়ে তাঁর ইস্কাটনের বাড়িতে যান বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। পরে নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুমকি দিয়ে বলেন, ‘টিভির নাম দিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন এভাবে তুলে নিয়ে যাবে। এটা কোন দেশ!’ রিজভী বলেন, ‘দেশের বিশিষ্ট গুণীজনদের যদি এই পরিণতি হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? আমরা এই গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ ও ধিক্কার জানাচ্ছি।’ ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থানরত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘শফিক রেহমান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক, তাঁর বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। তাঁকে গোয়েন্দা পুলিশের লোকজন সাদাপোশাকে তুলে নিয়ে গেছে। এ ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত এ দেশে কথা বলার স্বাধীনতা নেই, লেখার স্বাধীনতা নেই।’ সাংবাদিক নেতাদের নিন্দা: শফিক রেহমানকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্ট (বিএফইউজে)-এর একাংশ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, এর মধ্য দিয়ে ভিন্নমতের প্রতি সরকারের অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পেয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.