কনডেম সেলে ১১৬৪ আসামি by মহিউদ্দিন অদুল

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সাড়ে চার শতাধিক ব্যক্তির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কার্যকর হয়েছে ৪৩৩ জনের ফাঁসি। এ ছাড়া, গত জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের সব কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামি রয়েছে ১১৬৪ জন। এর মধ্যে গত ২৮শে জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিডিআর বিদ্রোহ মামলার আসামিসহ মোট ১৬৮ জন ফাঁসির আসামি ছিল। বাকিরা অন্যান্য কেন্দ্রীয় ও জেলা কারাগারে রয়েছে। কারাগারের কনডেম সেলে নিঃসঙ্গ দিন কাটছে তাদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে শীর্ষ সারিতে রয়েছে চীন, ইরান, সৌদি আরব, ইরাক, সুদান ইত্যাদি রাষ্ট্র। তবে এক এক দেশে এক একভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় শিরশ্ছেদের মাধ্যমে। কোনো কোনো দেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে বা বিষাক্ত ইনজেকশনের মাধ্যমেও তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে নির্ধারিত ফাঁসির মঞ্চে কারাবিধান অনুযায়ী কিছু নিয়মকানুন পালনের মধ্য দিয়ে জল্লাদের মাধ্যমে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করা হয়। বৃটিশ শাসনামলে সূর্যসেন ও ক্ষুদিরামসহ স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়কদের ফাঁসিতে পুরো বৃটিশ ভারতে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। পাকিস্তান আমলেও মৃত্যুদণ্ড হিসেবে ফাঁসি কার্যকর ছিলো। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের কারাগারগুলোতে বিভিন্ন অপরাধে প্রায় সাড়ে চারশ’ ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৬ সাল থেকে চার দশকে মোট ৪৩৩ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির আসামি থেকে শুরু করে শীর্ষজঙ্গি। রাজনীতিবিদ থেকে মানবতা বিরোধী অপরাধী পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের গুরুতর অপরাধী। ১৯৭৬ সালে ৩ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। বিশেষ সামরিক আদালতের রায়ে ওই বছরের ১৭ই জুলাই কর্নেল (অব.) তাহেরের ফাঁসির ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল। আর স্বাধীনতার পর ১৯৭৭ সালে সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টার অভিযোগেই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ২৪৭ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছিল। এর মধ্যে ১৮ই অক্টোবর ৩৭ জন, ২৬শে অক্টোবর ৫৬ জন, ১৮ই নভেম্বর ৩৭ জনের ফাঁসি হয়। এরপর ১৯৭৮ সালে ১৭ জন ও ১৯৭৯ সালে ১ জনের ফাঁসি হয়। পরের বছর ১৯৮০ সালের ৩রা জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কিশোরগঞ্জের চার জেলেকে হত্যার দায়ে একসঙ্গে ৪ জনের ফাঁসি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। ওই বছর আরও ৯ জনসহ মোট ১৩ জনকে ফাঁসির রশিতে ঝোলানো হয়েছিল। চট্টগ্রামে সেনা বিদ্রোহ ও সাবেক  প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যার দায়ে ১৯৮১ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর ১২ জন সেনা কর্মকর্তার ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। তাদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহসেন উদ্দিন, কর্নেল রশিদ, কর্নেল নওয়াজেশ, লে. কর্নেল দেলোয়ার হোসেন, মেজর কাজী মোমিনুল হক, মেজর গিয়াস উদ্দিন, মেজর রওশন ইয়াজদানি, মেজর মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন জামিল হক ও লে. রফিকুল হাসান উল্লেখযোগ্য। এ ফাঁসির ঘটনাও বেশ আলোচিত ছিল। ওই বছর আরও একজনসহ মোট ১৩ জনের ফাঁসি হয়েছিল। ১৯৮২ সালে ৬ এবং ১৯৮৩ সালে ৭ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। পরের বছর কারও ফাঁসি হয়নি। তবে ১৯৮৫ সালে ১৩ জন ও ১৯৮৬ সালে ২৬ জনের ফাঁসি হয়। গৃহপরিচারিকার সঙ্গে পরকীয়ার জের ধরে স্ত্রী সালেহাকে হত্যার দায়ে ১৯৮৭ সালে ধনীর দুলাল ডা. ইকবালের ফাঁসিও কম আলোচিত ছিল না। এটি বছরের একমাত্র ফাঁসি ছিল। এরপর ১৯৮৮ সালে ২ ও ১৯৯০ সালে ১ জনকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ১৯৯১ সালে কারও ফাঁসি না হলেও ১৯৯২ সালে পাঁচজনের ফাঁসি হয়। পরের ১৯৯৩ সালের ২৭শে জুলাই সাংবাদিক কন্যা শারমিন রীমাকে হত্যার দায়ে তার স্বামী মনির হোসেনের ব্যাপক আলোচিত ফাঁসিসহ আরও চারটি ফাঁসি কার্যকর হয়। ১৯৯৪ সালে কার্যকর হয় ২ জনের ফাঁসি। এরপর ১৯৯৫ এবং ৯৬ সালে কোনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। ১৯৯৭ সালে ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানসহ ২ জনকে ফাঁসি দেয়া হয়। পরের তিন বছরও কোনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। এরপর ২০০১ সালে ৩ এবং ২০০২ ও ২০০৩ সালে ২ জন করে ৪ জনের ফাঁসি হয়। ভয়াবহ খুন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজির জন্য বাংলাদেশের অপরাধীদের মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন এরশাদ শিকদার। ২০০৪ সালের ১০ই মে খুলনা কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর হয়। ওই বছরের ১লা সেপ্টেম্বর রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আব্দুস সাত্তার, ২৯শে সেপ্টেম্বর দিনাজপুর জেলা কারাগারে একই মামলার অপর আসামি পুলিশের গাড়িচালক অমৃত লাল বর্মণ এবং ২৯শে মার্চ কাশিমপুর কারাগারে জঙ্গি সদস্য আতাউর রহমান সানি ও খালেদ সাইফুল্লাহসহ ওই বছর মোট ১৩ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০০৫ সালে ৫ জন ও ২০০৬ সালে ৪ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। এরপর ব্যাপক গোপনীয়তায় ২০০৭ সালের ৩০শে মার্চ একই রাতে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে শায়খ আবদুর রহমান, ময়মনসিংহ কারাগারে সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই ও আবদুল আওয়াল, পাবনা কারাগারে খালেদ সাইফুল্লাহ, কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে আতাউর রহমান সানি ও ইফতেখার হাসান মামুনসহ ৬ শীর্ষ জঙ্গির ফাঁসি কার্যকর হয়। ২০০৮ সালে ৮ ও ২০০৯ সালে ৪ জনের ফাঁসি হয়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার পাঁচ আসামি সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা, মহিউদ্দিন আহমেদ,  সৈয়দ ফারুক রহমান, একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১০ সালের ২৮শে জানুয়ারি। ওই বছর আরও ৪ জনসহ মোট ৯ জনের ফাঁসি হয়। ২০১১ সালে ৫ ও ২০১২ সালে ১ জন ফাঁসির দড়িতে ঝুলে। ২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি হয়। ওই বছর আরও ১ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়। পরের বছর ২০১৪ সালে সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তথা বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলেও ওই বছর কোনো ফাঁসি কার্যকর হয়নি। ২০১৫ সালের ১১ই এপ্রিলে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়। একই বছরের ২২শে নভেম্বরে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ  মুজাহিদসহ ৩ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬ সালের প্রথম দু’মাসে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। 
কারা অধিদপ্তরের উপ- মহাপরিদর্শক একেএম ফজলুল হক মানবজমিনকে বলেন, গুরুতর অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ফাঁসি কারাবিধান অনুযায়ী কার্যকর হয়ে আসছে। এর মধ্যে খুনি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেনা সদস্যসহ বিভিন্ন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সমপ্রতি বেশ কয়েকজন মানবতাবিরোধী অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর হয়। এছাড়া, চাঞ্চল্যকর খুনের দায়ে মনির এবং ডা. ইকবালসহ বেশ কিছু ফাঁসিও দেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। বর্তমানে ফাঁসির দণ্ড পাওয়া আসামিদের দেশের কারাগারগুলোর কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। বিমর্ষ দিন কাটছে তাদের। তবে এর মধ্যে কারও ফাঁসি কার্যকরের আদেশ হয়েছে কিনা তা এই মুহূর্তে বলা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.