সাত খুনের মামলার বিচার গোপনে?

নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুন মামলার বিচার কি গোপনে হচ্ছে? আদালতকক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার পর এ প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল সোমবার এই মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর আগে আসামিপক্ষের আইনজীবীর সঙ্গে একজোট হয়ে আদালতকক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেন সরকারি কৌঁসুলি (পিপি)।
সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেছেন, একমাত্র ক্যামেরা ট্রায়াল (গোপনে বিচার) হলে আদালত সাংবাদিকদের বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেছেন, আদালত থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার ক্ষমতা পিপির নেই।
নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় ২০১৪ সালে দুটি মামলা হয়েছিল। একটির বাদী নিহত আইনজীবী চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেনের আদালতে গতকাল বিজয় কুমার পালের জবানবন্দির মধ্য দিয়ে ওই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
গতকাল সকাল নয়টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সাত খুন মামলার ২৩ জন আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। সকাল সোয়া ১০টার দিকে আসামি সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ, আরিফ হোসেন, এম এম রানাসহ সব আসামিকে আদালতকক্ষে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়া হয়। এ সময় পর্যন্ত সাংবাদিকেরা আদালতকক্ষে ছিলেন। এ মামলার অপর ১২ আসামি পলাতক।
সাড়ে ১০টার দিকে মামলার কার্যক্রম শুরুর কিছুক্ষণ আগে আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা আদালতকক্ষে উপস্থিত সাংবাদিকদের বের হয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তাঁর কথা শুনে কোনো সাংবাদিক বের হননি। পরে পিপি এস এম ওয়াজেদ আলী বলেন, সাক্ষ্য গ্রহণের কার্যক্রম চলাকালে বাদী, আসামি ও আইনজীবী ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না বলে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। এর পরপরই সাংবাদিকদের বের করে দেয় পুলিশ। তাৎক্ষণিকভাবে সাংবাদিকেরা এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেও তাঁরা বের হয়ে যেতে বাধ্য হন।
এরপর বিচারক আসন গ্রহণ করেন। বেলা দেড়টা পর্যন্ত বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণের পুরোটা সময় সাংবাদিকেরা আদালতকক্ষের বাইরে ছিলেন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হলেও মামলা-সংশ্লিষ্ট নন এমন আইনজীবীরা এবং নূর হোসেনের বড় ভাই নূর উদ্দিন আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
আদালতকক্ষ থেকে পিপি সাংবাদিকদের বের করে দিতে পারেন কি না, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা পিপি বলতে পারেন না। পিপির এ ক্ষমতা নেই। এটা বলতে পারেন কোর্ট। কোর্ট যদি মনে করেন ক্যামেরা ট্রায়াল হবে, তাহলে বলতে পারেন।’ তিনি এ বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে জানান।
যোগাযোগ করা হলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, ‘এটা খুব অদ্ভুত ঘটনা। সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার অধিকার পিপির নেই। সাক্ষ্য গ্রহণের সময় সাংবাদিকেরা থাকতে পারবেন কি না, সেটা ঠিক করতে পারেন একমাত্র বিচারক। সাধারণত সাক্ষীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ক্যামেরা ট্রায়াল হয়। কিন্তু সে আদেশ বিচারককে দিতে হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী আরও বলেন, সর্বোচ্চ আদালতে প্রতিদিন প্রধান বিচারপতি কী কথা বলছেন না বলছেন, সেটা মুহূর্তের মধ্যে রিপোর্ট হয়ে যাচ্ছে। কই কেউ তো সাংবাদিকদের বাধা দিচ্ছে না।
ক্যামেরা ট্রায়াল হলো বিচারের একটি বিশেষ পদ্ধতি, যেখানে বিচারক, রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের সুনির্দিষ্ট আইনজীবী এবং আসামি ছাড়া আর কেউ আদালতকক্ষে উপস্থিত থাকতে পারেন না।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী শাহদীন মালিক পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেন, পিপি বলার কে? পিপি কেন এ ধরনের কথা বললেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এ ধরনের মামলায় সাংবাদিকদের দায়িত্বপালনে কোনো বাধা নেই। চাইলে বিচারক বিশেষ কোনো যুক্তি থেকে এটা বলতে পারেন।
রাতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে পিপি ওয়াজেদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ভুল-বোঝাবুঝি হচ্ছে। বিচারকের নির্দেশে আমি আদালতকক্ষে শৃঙ্খলা রাখার জন্য আইনজীবী বাদে বাকিদের কিছুক্ষণের জন্য বাইরে থাকতে বলেছিলাম।’ তিনি দাবি করেন, নূর হোসেনের বড় ভাইকে িতনি চেনেন না। তাই তিনি আদালতকক্ষে ছিলেন কি না, তা বলতে পারবেন না।
আদালতকক্ষ থেকে সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া ‘ন্যক্কারজনক ঘটনা’ উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকে বলছি, এই মামলায় প্রভাবশালী একটি মহল প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।’ সাংবাদিকদের বের করে দেওয়ার ঘটনায় তিনি ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি আশা করেন, আগামী দিনগুলোতে সাংবাদিকদের শুনানির সময় উপস্থিত থাকতে দেওয়া হবে।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মামলার ১ নম্বর আসামি নূর হোসেনকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর থেকে তাঁর প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাত খুনের ঘটনায় করা মামলা দুটিতে অভিযোগ গঠন করা হয়। ওই দিন একটি মামলার বাদী নিহত ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেছিলেন, নূর হোসেনের লোকজন তাঁকে সব সময় অনুসরণ করে। মামলার ধার্য দিনে আদালতের চারপাশে পাহারা বসায়। ওই দিনও নূর হোসেনের ভাতিজা ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী শাহজালাল বাদলসহ চারজন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া নূর হোসেনের লোকজন আদালতের বাইরে জটলা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
ওই দিন সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, নূর হোসেন ভারত থেকে দেশে আসার পরে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো থেকে তিনি অব্যাহতি পেতে শুরু করেছেন।
গতকালের ঘটনা নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বর্ষীয়ান আইনজীবী ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) মহানগর কমিটির সভাপতি আহসানুল করিম চৌধুরী বলেন, আদালতের বিচারকাজ হবে উন্মুক্ত। সারা দেশের মানুষের আগ্রহ রয়েছে সাত খুনের বিচার নিয়ে। তাই এ মামলার সব কার্যক্রমে সাংবাদিকদের থাকতে দেওয়া উচিত।
জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মজিবুল হক বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মামলার শুনানিতে সাংবাদিকদের উপস্থিতি কাম্য। কিন্তু আজ যা হলো, তা নজিরবিহীন।
আইনজীবীরা বলেন, সাংবাদিকেরা আদালতকক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর বেলা পৌনে ১১টার দিকে বিজয় কুমার পাল বাদী হিসেবে তাঁর জবানবন্দি দেওয়া শুরু করেন। এরপর তাঁকে জেরা করেন র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা আরিফ হোসেনসহ ১০ আসামি এবং র্যাবের আট সদস্যসহ পলাতক ১২ আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীরা। মামলার অন্য আসামি নূর হোসেন, তারেক সাঈদ মোহাম্মাদ ও এম এম রানার পক্ষের আইনজীবীরা বাদীকে জেরা করতে সময় চাইলে আদালত তা মঞ্জুর করে ৭ মার্চ দিন ধার্য করেন।
নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও তাঁর চার সহযোগীকে হত্যার ঘটনায় অন্য মামলাটি করেছিলেন সেলিনা ইসলাম। গতকাল আদালত তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৩ মার্চ দিন ধার্য করেন।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে অপহরণের শিকার হন আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক। পরে তাঁদের এবং কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় করা দুই মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি নূর হোসেন, তারেক সাঈদসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

No comments

Powered by Blogger.