ক্যানসারে ভুগছে ১৫ লাখ- চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অপর্যাপ্ত by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও আফরিন আপ্পি

রোজিনা বেগম। মরণব্যাধি ব্ল্যাড ক্যানসারে আক্রান্ত। জাতীয় ক্যানসার হাসপাতালের বারান্দায় কোনোরকম বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। শিশু মাইমুনা। বয়স ৮। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২০৭ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছে। ৩ মাস পর পর তাকে রক্ত দিতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধু রোজিনা বা মাইমুনা নয়, দেশে বছরে এক লাখ ২১ হাজার মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। মারা যাচ্ছে অন্তত ৯১ হাজার মানুষ। দেশে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগী রয়েছেন অন্তত ১৫ লাখ। ক্রমে এ সংখ্যা বাড়ছেই। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গত এক বছরে ৮০ শতাংশ রোগী বেড়েছে বলে হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে। চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিনে দিনে ক্যানসারের প্রকোপ বাড়লেও দেশে এর পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। নেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসক এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় দেশে মোট চিকিৎসা ব্যয়ের একটি বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে এই ক্যানসারের চিকিৎসায়। দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় আক্রান্তদের অনেকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন।
ক্যানসারের পেছনে যে কারণ রয়েছে তার বেশিরভাগই মনুষ্য সৃষ্ট।  এর মধ্যে একটা বড় কারণ হলো তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন। আর অতিমাত্রায় তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে। আবার অনিরাপদ খাদ্যগ্রহণকেও চিকিৎসকরা ক্যানসারের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন। কৃষিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের খাদ্যদ্রব্যকে করে তুলছে অনিরাপদ। এর উপর রয়েছে ফলমূল ও মাছে ফরমালিনের ব্যবহার। বায়ুদূষণকেও ক্যানসার বিস্তারের আরও একটি কারণ বলে মনে করেন তারা। বাতাসে সীসার পরিমাণ বৃদ্ধি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
সম্প্রতি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এ প্রতিষ্ঠানে আসা সবাইকে ঠিক সময়ে প্রয়োজনমতো থেরাপি দিতে পারছে না।  হাসপাতালটির ধারণক্ষমতা মাত্র ৩০০ জন। সেখানে রোগী ভর্তি দ্বিগুণ থেকে ৩ গুণ। হাসপাতালের বারান্দা, সিঁড়ি সব জায়গায় রোগীদের অবস্থান করতে দেখা যায়। তাদেরই একজন আইনুদ্দিন। বয়স ৫০ বছর। পেশায় কৃষক। বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি।  এসেছেন সুদূর টাঙ্গাইল থেকে। তার মেয়ে হাফসা জানান, অতিরিক্ত ধূমপান করার কারণে তিনি এখন ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। আবার অনেকে এমন রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন। তেমনই একজন নিলুফার তাসনীম। বয়স ৬৫ বছর। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে লড়াই করে চলেছেন এই ব্যাধির সঙ্গে। ২০০৩ সালে তার শরীরে ধরা পড়ে হস্কিন লিম্ফোমা নামক ক্যানসারের।  এরপর তিনি আর দেরি না করে শরণাপন্ন হন চিকিৎসকের। রোগটি ধরা পড়া মাত্রই উন্নত চিকিৎসা নেয়ার কারণে তিনি এখন আর ১০ জন মানুষের মতোই স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। তবে কেমো থেরাপি দেয়ার সময় তার শরীরে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস রোগ। যার কারণে কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হয়। নিলুফার তাসনীম বলেন, ক্যানসার রোগীদের অবশ্যই খাবার ও পানির বিষয়ে অনেক বেশি সচেতনতার প্রয়োজন। এমনই আরেকজন তাহমিনা গাফ্‌ফার ২০০৩ সালে আক্রান্ত হন ব্রেস্ট ক্যানসারে। পরবর্তীতে পরপর ৬টি কেমোথেরাপি দিয়ে এবং অপারেশন করে তিনি বর্তমানে সুস্থ জীবন যাপন করছেন।  চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যানসারের রোগী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে জানিয়ে ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হাসানুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, রোগটি যেভাবে প্রকোপ হারে বাড়ছে। কিন্তু সে হারে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতাল তৈরি হচ্ছে না। ফলে ভবিষ্যতে সেবা নিশ্চিত করতে না পারলে বিপর্যয় নেমে আসবে। গবেষণা বলছে, মোট ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৬০ শতাংশই পুরুষ। পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৩ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে, লিপ অ্যান্ড ওরাল ক্যানসারে ১২ শতাংশ, অন্ননালির ক্যানসারে ৮ দশমিক ২ শতাংশ।  এছাড়া আছে পাকস্থলি, হস্কিন লিম্ফোমা, মূত্রনালি, লিভার ও লিউকোমিয়া ক্যানসার। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই ব্রেস্ট ক্যানসারে আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা জানান, ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীরাই ক্যানসারে আক্রান্ত হন সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে থেমে নেই শিশুরাও। শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত লিউকোমিয়ায়। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দেশে ক্যানসার আক্রান্তদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। ২০১১ সালে এই ইনস্টিটিউটের অধীনে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৪৯৮ জন, ২০১২ সালে ৩০২০ জন, ২০১৩ সালে ৩০৪৫ জন, ২০১৪ সালে ৪০৫৭ জন এবং ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৮৫ জনে। এরমধ্যে ২০১১ সালে মারা যায় ৯২ জন। ২০১২ সালে ৯৫ জন। ২০১৩ সালে ১১৮ জন, ২০১৪ সালে ৯০ জন এবং ২০১৫ সালে ১৬৮ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি লাখে ১৮১ জন। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মফিজুর রহমান বলেন,  ক্যানসারের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে তিনি জানান, হঠাৎ করে গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। শরীরের যেকোন জায়গায় চাকা হলে তা বৃদ্ধি পাওয়া। অস্বাভাবিক রক্তপাত। যেকোন ঘা না সারা। পায়খানা ও প্রস্রাবের অভ্যাসের পরিবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে খুসখুসে কাশি থাকা। দীর্ঘদিনের জ্বর। কারণ ছাড়া ওজন অতিরিক্ত পরিমাণে হ্রাস পাওয়া। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও রোগের প্রকোপের বিবেচনায় দেশে কমপক্ষে ১৬০টি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র বা হাসপাতাল থাকা দরকার। তবে দেশে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ খুবই সীমিত। সরকারি পর্যায়ে ১৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ক্যানসার চিকিৎসায় কেমোথেরাপি (ওষুধে চিকিৎসা) দেয়া হয়। তবে জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অধ্যাপক বলেছেন, সঠিক কেমোথেরাপি দিতে পারেন মেডিকেল অনকোলজিস্ট। কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল অনকোলজিস্ট নেই। অন্যরা এই চিকিৎসা দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বিএসএমএমইউয়ের অনকোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সচেতনতার অভাবে রোগের একেবারে শেষ পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসে মানুষ। ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগীর রেডিয়েশন থেরাপি দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অন্তত ১৫ লাখ ক্যানসার আক্রান্ত রোগী আছে। এই বিশেষজ্ঞ তামাক ব্যবহার পরিহার করার পরামর্শ দেন। তামাক ব্যবহারের ফলে বেশির ভাগ ক্যানসার হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, দেশে আরও দশগুণ ক্যানসার সেন্টার স্থাপন করতে হবে। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন  এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, মানুষের মধ্যে ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে। কিন্তু সেবাটা অপ্রতুল।
বাংলাদেশের ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ‘জাপানি জার্নাল অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজি’তে বিএসএমএমইউয়ের অনকোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান  অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আকরাম হোসেন ২০১৩ সালে দেয়া তথ্যে জানান, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ১২ দশমিক ৭ মিলিয়ন (এক কোটি ২৭ লাখ) থেকে ২১ দশমিক ৪ মিলিয়ন (২ কোটি ১৪ লাখ) ক্যানসার রোগী বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে ক্যানসারের উপরে গবেষণা চালিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষকরা বলেছেন ২০০৫ সালে যে মৃত্যু হয়েছে তার সাড়ে ৭ শতাংশ ক্যানসারের সঙ্গে সম্পর্কিত। ২০৩০ সালে তা ১৩ শতাংশে পৌঁছবে।
জাতীয়  ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মফিজুর রহমান এই বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। কিন্তু সেন্টারের সংখ্যা খুবই সীমিত, যার কারণে সবাইকে চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ক্যানসার যদি প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে তাহলে চিকিৎসা নিয়ে পুরোপুরি সুস্থ জীবন যাপন করা সম্ভব। আর তাই ক্যানসারের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে যতো দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এদিকে এমন পরিস্থিতিতে আজ দেশে পালিত হবে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। আয়োজন করা হয়েছে সচেতনতা বাড়ানোর বিভিন্ন কর্মসূচির।

No comments

Powered by Blogger.