বিপন্ন মানুষের বন্ধু by এ এইচ এম বজলুর রহমান

আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে পঞ্চম বিশ্ব বেতার দিবস। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে অনুকরণীয় মডেল। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশে বিশ্ব বেতার দিবস পালিত হচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশ বেতার, প্রাইভেট এফএম এবং কমিউনিটি রেডিও অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে রেডিও স্টেশনগুলো পালন করছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
সরকার ইতিমধ্যে ২৮টি প্রাইভেট এফএম এবং ৩২টি কমিউনিটি রেডিও এফএম অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেতার ১২টি আঞ্চলিক বেতারকেন্দ্র এবং ৩৫টি এফএম পরিচালনা করছে।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা তথা সাধারণ মানুষকে অপরিসীম শক্তি ও সাহস জুগিয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আজও সেই স্মৃতি আমাদের নাড়া দেয়। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, স্বাধীনতার পর দেশের উন্নয়নেও শক্তিশালী বাহন হিসেবে স্বীকৃত। গুটিবসন্ত প্রতিরোধ, ম্যালেরিয়ামুক্ত অভিযান, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা, জাতীয় টিকাদান, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, গণসাক্ষরতা, কৃষি উন্নয়ন, ডায়রিয়া প্রতিরোধ, শিশু ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, নারী পাচার রোধ, এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ, মাদকাসক্তি রোধে রেডিও কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে এখনো মানুষ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকার অনুষ্ঠান শোনার জন্য উদ্গ্রীব থাকে।
রেডিও এখন শাখা-প্রশাখায় অনেক বিস্তৃত। মূলত চারটি ধারায় রেডিও সম্প্রচার করে থাকে, যথা: পাবলিক সার্ভিস, আন্তর্জাতিক রেডিও, বাণিজ্যিক রেডিও এবং কমিউনিটি রেডিও।
পাবলিক সার্ভিস ব্রডকাস্টিং প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ বেতার যেমন অনুষ্ঠান ও খবর সম্প্রচার করছে; তেমনি বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস, ভয়েস অব আমেরিকা, এন এইচ কে, রেডিও তেহরান, রেডিও চায়না ও অন্যান্য বিদেশি মাধ্যমেও বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে পারছি। আবার দেশে সাম্প্রতিক কালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সম্প্রচার করছে শহরভিত্তিক বেসরকারি এফএম রেডিও। সব মিলিয়ে রেডিওর প্রচার দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে।
পাবলিক রেডিও, আন্তর্জাতিক রেডিও কিংবা বাণিজ্যিক রেডিও যেভাবে সম্প্রচার করে, তাতে সমাজের সব মানুষ সুষমভাবে প্রচারের সুযোগ পায় না। এসব রেডিও প্রকৃতিগতভাবে শহরকেন্দ্রিক ও মুনাফানির্ভর। গ্রামীণ মানুষের কথা তারা তেমন প্রচার করে না। এতে গড়ে ওঠে কেন্দ্র ও প্রান্তের মধ্যে তথ্য বিভাজন; যা জাতীয় উন্নয়নের অন্তরায়। এ বাস্তবতা মাথায় রেখে সারা বিশ্বে কমিউনিটি রেডিওর ধারণা বিকশিত হয়।
কমিউনিটি রেডিও হচ্ছে কমিউনিটিভিত্তিক রেডিও। এখানে সাধারণভাবে সীমিত প্রযুক্তিগত স্থাপনার মাধ্যমে অল্পসংখ্যক মানুষ কাজ করে। ভৌগোলিকভাবে এর প্রচার এলাকা ছোট। হতে পারে একটি গ্রাম বা শহরতলি। সম্প্রচারে এফএম ট্রান্সমিটার ব্যবহৃত হয়। অলাভজনকভাবে পরিচালিত এ রেডিওতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। শুধু জানা নয়, নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কমিউনিটি রেডিও সমাজের প্রান্তীয় মানুষকে জায়গা করে দেয়। স্থানীয় সমস্যার কথা জানানোর পাশাপাশি সমাধানের পথও দেখায় কমিউনিটি রেডিও।
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি) ২০০০ থেকে বাংলাদেশে গ্রামীণ জনপদে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উন্নয়নমূলক তথ্য ও জ্ঞানবিনিময়ের পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি সেবা তথ্যসমূহসহ জীবনঘনিষ্ঠ তথ্য জনগণের মাঝে সহজবোধ্য ভাষায় প্রচারের লক্ষ্যে কমিউনিটি রেডিও চালু করার জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেছে।
তারই ধারাবাহিকতায় তথ্য মন্ত্রণালয় কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র বাংলাদেশে কমিউনিটি রেডিওবিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে চলমান ১৬টি কমিউনিটি রেডিও প্রতিদিন ১২৫ ঘণ্টার বেশি সময় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে। এক হাজার জন যুব নারী ও যুবকের অংশগ্রহণে নতুন ধারার এ গণমাধ্যমটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ১৪টি জেলায় সর্বমোট ৬৮টি উপজেলার বর্তমানে প্রায় ৫৫ লাখ জনগোষ্ঠী কমিউনিটি রেডিওর সুবিধা ভোগ করছে।
কমিউনিটি রেডিও স্টেশন পর্যায়ে সর্বমোট পাঁচ হাজারটি শ্রোতাক্লাব শ্রোতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে। প্রথমবারের মতো স্থাপিত কমিউনিটি রেডিওগুলোর অর্জন ইতিমধ্যে সব মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আরও ১৬টি কমিউনিটি রেডিও অনুমোদন পেয়েছে। আমরা আশা করছি আগামী ডিসেম্বর ২০১৬ সালের মধ্যে ওই ১৬টি কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচারের কাজ শুরু করবে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি রেডিওগুলোর মূল প্রভাব হলো জনগণের দোরগোড়ায় স্থাপিত এই গণমাধ্যম দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজেদের কথা সরাসরিভাবে বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে কণ্ঠহীনদের কণ্ঠস্বর সোচ্চার হওয়া ও শোনার সুযোগ। এই নয়া গণমাধ্যম সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং পরিবেশের ক্ষেত্রে পল্লি অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে তথ্য এবং যোগাযোগের অধিকার এনে দিয়েছে। সুশাসন নিশ্চিতকরণে জনপ্রতিনিধি, সরকারি এবং বেসরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনসাধারণের সংলাপ আদান-প্রদানের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান খাতগুলোর সঙ্গে জনসাধারণের সরাসরি সংযোগ স্থাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
দুর্যোগকালীন যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি সংঘটিত হওয়ার আগে, পরে ও দুর্যোগকালীন রেডিও একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম। জরুরি পরিস্থিতিতে সাড়াদান অধিকতর স্বচ্ছ ও সহজতর হতে পারে, যখন থাকে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকেরা নিরাপদ পরিবেশে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন। রেডিও দুর্যোগে বেঁচে যাওয়া ও এমনকি আশ্রয়শিবিরে অবস্থানকারী বিপদাপন্ন ব্যক্তিদের মর্যাদা জুগিয়ে সহায়তা করে।
সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ এবং কমেনের সময় উপকূলীয় অঞ্চলে স্থাপিত কমিউনিটি রেডিওগুলোর ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয়। বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের সর্বশেষ খবর জানার ক্ষেত্রে উপকূলের মানুষের প্রধান উৎস ছিল কমিউনিটি রেডিও।
দুর্যোগ ও জরুরি অবস্থায় আঘাতপূর্ব, আঘাতকালীন ও দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ের জন্য রেডিও খুবই শক্তিশালী। রেডিও শ্রোতাদের সক্ষম করে এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ জনসাধারণকে সুরক্ষা দিতে মানবাধিকার ও উদ্ধারকর্মীদের এগিয়ে আসতে উদ্যমী করে তোলে।
দুর্যোগ ও কোনো জরুরি অবস্থায় রেডিওর ভূমিকা খুবই শক্তিশালী। সম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সচেতন করতে রেডিওর সক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে সামাজিক গণমাধ্যমেরও সক্ষমতা রয়েছে, তবে সামাজিক গণমাধ্যমগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো নির্ভরযোগ্য রেডিওর সঙ্গে সংযুক্ত হলে এর প্রভাব আরও বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে।
এ মুহূর্তে আরও অন্তত ৫০-৬০টি কমিউনিটি রেডিওর অনুমোদন প্রদান করলে সুবিধাবঞ্চিত তথা মিডিয়া ডার্ক এলাকাগুলো কমিউনিটি রেডিওর আওতায় আসবে।
এতে কণ্ঠস্বর ভেসে উঠবে দেশের প্রান্তীয় মানুষের। সবাই সুযোগ পাবে তার কথা নিজের মতো করে বলার। সব জনগোষ্ঠীর ভাবনা জানতে পারবেন দেশের নীতিনির্ধারকেরা। স্থানীয় সরকারি এবং বেসরকারি কর্তৃপক্ষ সরাসরি জানবে তাদের উদ্দিষ্ট মানুষের চাওয়া-পাওয়া।
এ এইচ এম বজলুর রহমান: বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন।

No comments

Powered by Blogger.