দমিত মানুষের শক্তির খোঁজে by আনু মুহাম্মদ

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: অসাধারণ শিল্পস্রষ্টা
যদি বেঁচে থাকতেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, এই ১২ ফেব্রুয়ারিতে তাঁর বয়স হতো ৭৩। অথচ মাত্র ৫৪ হওয়ার আগেই তিনি অকাল মৃত্যুর কবলে পড়লেন। গত ১৯ বছরে কী গভীর অবদান যোগ হতো বাংলা সাহিত্যে, আমাদের দেখা ও বোঝার শক্তিতে, আমাদের লড়াইয়ের দিগন্তে, তা কি চিন্তা দিয়ে ধরা সম্ভব? মৃত্যুর আগের ১৭ বছরে ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি উপন্যাসসহ বেশ কিছু অসাধারণ গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। মৃত্যুর আগের ১৩ বছরে হয়ে উঠেছিলেন অদম্য সংগঠকও। একজন মানুষের বেঁচে থাকা ও না থাকার মধ্যে কী তফাৎ তৈরি হয়, স্বজনদের মধ্যে কতটা শূন্যতা তৈরি হয়, সে অভিজ্ঞতা সবারই আছে। কিন্তু ইলিয়াসের মতো একজন মানুষের অকাল মৃত্যু পুরো একটা জনপদের, একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর এবং তাঁর সাহিত্যের, তাঁর জগৎকে নতুনভাবে নির্মাণের আবছা স্বপ্ন ও চলমান লড়াইয়ে যে কী অপূরণীয় ক্ষতি তৈরি করে, তা বলে বোঝানো কঠিন।
ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। ১৯৮৪ সাল থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ অনেক ঘনিষ্ঠ হয় একই সংগঠনে একসঙ্গে কাজ করার সূত্রে। সেই সময় দেড় দশক ধরে যে কয়েক দফা আমি ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’ নামে লেখক শিল্পী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম, তার পুরো সময়টাতেই ইলিয়াস ভাই খুবই সক্রিয়ভাবে সঙ্গে ছিলেন—ছিলেন তারপরও। বদরুদ্দীন উমরের পর ১৯৮৬ তে আমাদের অনুরোধে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক সুদূর রাজশাহী থেকেও সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, এটা ইলিয়াস ভাইয়ের জন্য পরম স্বস্তির ব্যাপার ছিল। তিনি হাসান ভাইকে কখনো ছাড়তে রাজি ছিলেন না। আর ইলিয়াস তখন থেকেই সহসভাপতি। আরেকজন সহসভাপতি ছিলেন চট্টগ্রাম থেকে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ। এই সময়কালে এঁদের সঙ্গে আলোচনা, পাঠ, বিতর্ক, পথসন্ধান, অনুষ্ঠান, সাংগঠনিক কাজ, আড্ডা, বিভিন্ন অঞ্চল সফর, কী যে আনন্দ আর সমৃদ্ধির সময়—তা মনে করলে ইলিয়াসের অভাবের কষ্টই বাড়ে।
তৃণমূল সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হলো ১৯৯২ সালে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই ছিলেন সম্পাদক। যেমন আলোচনা, লেখা, শিক্ষকতা তেমনি সম্পাদনা—সব জায়গায় ইলিয়াস একই রকম আনন্দ আর গভীর নিষ্ঠা ও শ্রম দিয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, পুরো দায়দায়িত্ব নিয়ে পরম মমতায় সব কাজ করতেন। সেই তৃণমূল-এর চতুর্থ সংখ্যা ছিল আয়তনে বৃহত্তম, কিন্তু তা প্রকাশিত হয়েছিল ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’ সংখ্যা হিসেবে। আমাকেই সেই সংখ্যা সম্পাদনা করতে হয়েছিল!
ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই বহুদিন পর আমার আঠার মতো লেগে থেকে পড়া উপন্যাস। আমি ‘সাহিত্যের মানুষ’ নই। সাহিত্য সমালোচনার এখতিয়ার নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকলেও এই উপন্যাসটি পাঠের পর এটা নিয়ে লেখার তীব্র তাগিদ অনুভব করেছিলাম। সেই তাগিদ থেকেই একটি দীর্ঘ পর্যালোচনা হিসেবে যা লিখেছিলাম, তা আসলে এই গ্রন্থ পাঠে আমার নিজের উপলব্ধি ও প্রতিক্রিয়া। আমার লেখার কথা ইলিয়াস জানতেন না, একেবারে ছাপা অবস্থায় দেখেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী চিলেকোঠার সেপাই বিষয়ে পরে লিখেছেন, ‘...এ এক নতুন বাংলা ভাষা, শহরের ধুলো-কাদা-মবিল-আবর্জনা-হঠাৎ ধনীর বর্বর অসভ্যতা আস্তাকুঁড়ের মানুষদের বারুদ হয়ে ওঠার ভাষা। শহরের নিচুতলার সমাজের মানুষের বাংলা ভাষা এমন ইজ্জত পায়নি সাহিত্যে। যেমন দেখার চোখ, তেমনি স্বচ্ছ ও কঠিন রাজনীতিক বিশ্বাস, তেমনি ধারালো হিউমার।’ (তৃণমূল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা, জানুয়ারি ১৯৯৮) এরপর খোয়াবনামা নিয়েও একই রকম কিংবা আরও তীব্র তাগিদ থেকে লিখেছিলাম। খোয়াবনামা যখন পড়েছি ও তা নিয়ে যখন লিখছি তখন ইলিয়াস কমিউনিটি হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন।
লেখায় ও জীবনে সব ধরনের মানুষই ছিল ইলিয়াসের মনোযোগের ক্ষেত্র। সব মানুষই বাস করে একই শারীরতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে। কিন্তু সামাজিক, ঐতিহাসিক কারণে এর মধ্যেই ঘটে বহু বিভাজন: শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতপাত, জাতি, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ...। বৈচিত্র্য অস্বীকৃত হয়, মহিমান্বিত হয় বৈষম্য। সম্পত্তির ব্যক্তি মালিকানা, বৈষয়িক লোভ, দখল, ক্ষমতা সর্বোপরি মানুষ ও প্রকৃতি বিদ্বেষী মতাদর্শ একই চেহারার মানুষের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক তৈরি করে। কেউ কেউ শাসন, দখল, বিত্ত আর নির্মমতায় অমানুষ হয়; বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তার জগৎ থেকে উৎপাটিত হয়, বঞ্চিত, প্রতারিত হয়ে দলিত আর দমিত থাকে। নিপীড়নের নানা ব্যবস্থা বৈধতা দিতে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রের নানা প্রতিষ্ঠান, আইনকানুন, সাহিত্য-সংস্কৃতি। ইলিয়াস তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে এই বৈপরীত্য অনুসন্ধান করেন নিজে নির্মোহ থেকে, সন্ধান করেন মানুষের ভেতর মানুষকে।
নিজ গণ্ডির মধ্যবিত্ত ব্যক্তি অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইলিয়াসের লেখক ও চিন্তা জীবনের শুরু। কিন্তু তার মধ্য দিয়েই তিনি এই জগতের বন্দিশালা অতিক্রম করেছেন। পরিবর্তিত হয়েছে তাঁর ইতিহাস-জীবন-দর্শন সম্পর্কিত চিন্তার কাঠামো। মধ্যবিত্তের আত্মপ্রবঞ্চনায় ভরা চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন তিনি, কিন্তু তাঁর মধ্যে আটকে থাকেনি। দৃষ্টি ও চিন্তাশক্তি প্রসারিত হয়েছে, সমাজের জালের মুখোমুখি হয়েছেন, ইতিহাস তাঁকে খুলে দিয়েছে অজানা জগৎ। মানুষের মধ্যে দেখেছেন বহু মানুষ, সন্ধান পেয়েছেন মানুষের অসীম শক্তি ও সৃজনশীলতার বিশাল সমুদ্র।
চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে কৃষককর্মী চেংটু নিহত হয়, মিছিল সভা সমাবেশ দখল হয়ে যায়, হাড্ডি খিজির বুকে গুলি খায়। কিন্তু এখানেই তো জগৎ শেষ হয় না। চেংটু, খিজির থেকে যায় কোথাও না কোথাও। খোয়াবনামায় ব্রিটিশদের হাতে গুলি খাওয়া মুন্সী যেভাবে পাকুড়গাছে গিয়ে বসে, তার মরণ হয় না। তেভাগা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় কিন্তু তমিজ তার ডাকেই অনির্দিষ্ট পথে পা বাড়ায়। ভবিষ্যতের দায়িত্ব নিয়ে শক্ত মাটির ওপর দাঁড়ায় তমিজ-ফুলজানের মেয়ে সখিনা। সামরিক শাসন ভেঙে বুকে গুলি নিয়ে হাড্ডি খিজির যখন রাস্তায়, তখন দেখা-অদেখা অসংখ্য মানুষের মিছিল মুক্তির এক প্রবল মানবিক স্রোত তৈরি করে।
বহু রকম শৃঙ্খলের মধ্যেও অতীত থেকে ভবিষ্যতে প্রবাহিত মানুষের চৈতন্য অনুসন্ধান করতে করতেই ইলিয়াস নতুন নতুন প্রান্তরে হাজির হচ্ছিলেন। এভাবেই বাস্তবতার ভেতর পরাবাস্তব, চেতনের মধ্যে অচেতন, জাগরণের মধ্যে স্বপ্ন, বর্তমানের ভেতর অতীত মানুষকে এক থেকে অসংখ্য রূপে হাজির করতে থাকেন তাঁর লেখায়।
প্রকৃতপক্ষে অতীত থেকে ভবিষ্যতে প্রবাহিত মানুষের অন্তর্গত শক্তির সন্ধান এবং তাঁকে পুষ্ট করাই ইলিয়াসের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই অনুসন্ধানে তিনি একজন অসাধারণ শিল্পস্রষ্টাই কেবল নন, একই সঙ্গে একজন বিপ্লবী তাত্ত্বিকও বটে।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu/anujuniv@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.