এটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ রায় by ইকতেদার আহমেদ

পৃথিবীর যেকোনো দেশে জনমানুষের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়ার পর তা নিজেরা সুরাহা করতে না পারলে আদালতের শরণাপন্ন হন। এ ক্ষেত্রে আদালতকে নিজ দেশের সংবিধান, আইন ও বিধি-বিধানের আলোকে সিদ্ধান্ত দিতে দেখা যায়। আদালতের সিদ্ধান্ত অধিকাংশ দেশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় বিরোধ নিরসনে সহায়ক কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটি মামলাসংক্রান্ত একজন সাবেক প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত বিরোধ নিরসনের পরিবর্তে উত্তপ্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
২০১০ সালে ১৮তম প্রধান বিচারপতির অবসর-পরবর্তী ১৯তম প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্ন দেখা দিলে দু’জন জ্যেষ্ঠ ও সার্বিক বিবেচনায় উৎকৃষ্ট বিচারককে অতিক্রান্ত করে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি হিসেবে তার ব্যাপ্তিকাল ছিল প্রায় আট মাস। প্রধান বিচারপতি পদে আসীন থাকাবস্থায় তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায় দেন। ওই মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধতা ও সপ্তম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত মামলাদ্বয়ের আপিল শুনানি। এ দু’টি আপিল মামলার মধ্যে প্রথমোক্তটির ক্ষেত্রে তিনি পদে বহাল থাকাকালীন সংক্ষিপ্ত আদেশ দেন এবং দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে পদে বহাল থাকাকালীন পূর্ণাঙ্গ আদেশ তিনি দেন। প্রথমোক্তটির সংক্ষিপ্ত আদেশে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক, তাই বেআইনি, তবে পরবর্তী দু’টি নির্বাচন সংসদের অভিপ্রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। দ্বিতীয় আপিলটিতে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন যে, সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত ক্রান্তিকালীন বিধান বলতে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালকে বুঝাবে। এ সময়কালের বাইরের কোনো সময়কে ক্রান্তিকালীন সময় বলা যাবে না এবং বলা হয়ে থাকলেও তা অকার্যকর হবে।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর সংক্ষিপ্ত আদেশটি দেয়া হয় ১০ মে, ২০১১ সালে এবং অতঃপর ওই বিতর্কিত প্রধান বিচারপতি ১৭ মে, ২০১১ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি অবসরগ্রহণ-পরবর্তী ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১২ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত তার ৩৪২ পৃষ্ঠাসংবলিত রায়ে অবসরগ্রহণের ১৬ মাসেরও অধিক সময় পর স্বাক্ষর করেন।
এখন প্রশ্ন- উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক অবসরগ্রহণ-পরবর্তী রায় লিখতে ও রায়ে স্বাক্ষর করতে পারেন কি না? উচ্চ আদালতের বিচারপতি বা বিচারকেরা সাংবিধানিক পদধারী হিসেবে শপথ ও সংবিধানের ৯৬ নম্বর অনুচ্ছেদের অনুবলে প্রস্তুতকৃত আচরণবিধি দিয়ে পরিচালিত। উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক বিচারপতি বা বিচারক পদে নিয়োগ-পরবর্তী শপথগ্রহণ ব্যতিরেকে পদে আসীন হন না এবং যে তারিখে তিনি বিচারপতি বা বিচারকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন সে তারিখ থেকে তিনি স্বপঠিত শপথ থেকে অবমুক্ত হয়ে যান। তাই স্বভাবত প্রশ্ন জাগে, উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারক স্বপঠিত শপথ থেকে অবমুক্ত হওয়ার পর তার পক্ষে পূর্বে শ্রুত বা পূর্বে আংশিক প্রদত্ত কোনো মামলার রায় বা পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার বা তাতে স্বাক্ষর করার সুযোগ আছে কি না?
উপরিউক্ত বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানসহ দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধি, সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগ রুল এবং দেওয়ানি আদেশ ও কার্যাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আইন বা বিধি-বিধানের কোথাও উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতি বা বিচারককে অবসরগ্রহণ-পরবর্তী পূর্বে শ্রুত বা পূর্বে আংশিক প্রদত্ত মামলার রায় বা পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার সমর্থনে ক্ষমতা প্রদানপূর্বক কোনো অধিকার দেয়া হয়নি। আর অধিকার দেয়া না হয়ে থাকলে আইনের অবস্থান দাঁড়ায় অবসরগ্রহণ-পরবর্তী কোনো বিচারপতি বা বিচারক কর্মে বহাল থাকাকালীন শ্রুত বা আংশিক প্রদত্ত কোনো মামলার রায় বা পূর্ণাঙ্গ রায় লিখলে এবং তাতে স্বাক্ষর দিলে তা হবে আইনের পরিপন্থী। তা ছাড়া উপরিউক্ত আইন ও বিধানাবলিতে রায় ঘোষণা বিষয়ে স্পষ্টত যে কথাগুলো বলা হয়েছে, তার মর্মার্থ হলো- আদালত মামলার শুনানি সমাপ্ত হওয়ার পর তৎক্ষণাৎ অথবা অন্য কোনো ভবিষ্যৎ দিনে পক্ষগণ অথবা তাদের আইনজীবীদের জ্ঞাতকরণপূর্বক প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করবেন এবং রায় ঘোষণাকালে বিচারক তাতে স্বাক্ষর ও তারিখ দেবেন। একবার স্বাক্ষরিত হলে করণিক বা গাণিতিক ভুল অথবা আকস্মিক ফসকান (Accidental slip) বা বিচ্যুতি (Omission) ব্যতীত রায়ের অপর কিছু সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।
পূর্ণাঙ্গ রায় দৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি ও ছয়জন বিচারক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আপিল মামলার শুনানি গ্রহণ করেন এবং পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও তাতে স্বাক্ষর করার সময় একজন বিচারপতি অবসরে ছিলেন এবং একজন বিচারপতি ও পাঁচজন বিচারক নিজ নিজ পদে বহাল ছিলেন। অবসরে যাওয়া বিচারপতিসহ কর্মরত প্রধান বিচারপতি এবং দু’জন বিচারক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সন্নিবেশিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বেআইনি ঘোষণা করেন। অপর দিকে, দু’জন বিচারক এটিকে সংবিধানসম্মত ঘোষণা করেন এবং একজন বিচারক সংবিধানসম্মত ঘোষণা করে এ বিষয়ে বিজ্ঞচিত সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার সংসদের ওপর ছেড়ে দেন। যেহেতু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও রায়ে স্বাক্ষরকালীন সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি পদে বহাল ছিলেন না, তাই আইনের দৃষ্টিতে তিনি যে রায় দিয়েছেন তা এখতিয়ারবিহীন ও মূল্যহীন। এ বাস্তবতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়টি ৩:৩ এর বিভক্ত রায়।
১৯তম প্রধান বিচারপতি সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আপিল মামলার প্রবর্তক বিচারক (Author Judge)। আপিলের রায় দেয়ার সময় তার সাথে যারা সম্মত হয়েছেন রায়টি তার দ্বারা পরে স্বাক্ষরিত হওয়ার কারণে এ ধরনের সম্মতি রায়টির মৌলিকত্বের ওপর আঘাত হানে কি না তা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে আপিল আদালতের বিচারকেরা সমভাবে বিভক্ত হলে যে বিধান অনুসৃত হয় তাতে বলা হয়েছে, অভিমত দেয়ার ক্ষেত্রে আপিল আদালতের বিচারকেরা সমভাগে বিভক্ত হলে মামলার ওপর তাদের অভিমতসহ একই আদালতের অপর বিচারকের সম্মুখে মামলাটি উপস্থাপিত হবে এবং ওই বিচারক তার বিবেচনায় যথাযথ শুনানি গ্রহণের পর স্বীয় অভিমত দেবেন এবং রায় বা আদেশ ওই অভিমতের আলোকে প্রণীত হবে।
দেওয়ানি আপিলের ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধিতে বলা হয়েছে, ভিন্নমত লিপিবদ্ধ করতে হবে এবং যে ক্ষেত্রে আপিলটি একাধিক বিচারক কর্তৃক শ্রুত হয়, সে ক্ষেত্রে কোনো একজন বিচারক আদালতের রায়ের সাথে দ্বিমত পোষণ করে থাকলে আপিলে যে সিদ্ধান্ত বা আদেশ দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন, তা লিখিতভাবে বিবৃত করবেন এবং এর ওপর তিনি তার যুক্তিও বিবৃত করবেন। অপর এক বিধিতে বলা হয়েছে, ভিন্নমত পোষণকারী বিচারকের রায়ের ডিক্রিতে স্বাক্ষরের প্রয়োজন নেই। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আপিল মামলাটির সাথে ডিক্রি কার্যকরণের বিষয় সম্পৃক্ত না থাকায় ভিন্নমত পোষণকারীদের রায়ের ডিক্রিতে স্বাক্ষর করা বা না করার বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক।
স্পষ্টত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিষয়ে আপিল বিভাগের রায়টি সংবিধান ও অন্যান্য আইন এবং বিধি-বিধানের আলোকে সমভাবে বিভক্ত গণ্য হওয়ায় আপিল বিভাগে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর শুনানির সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন বিচারক না থেকে থাকলে সংবিধানের ৯৮ নম্বর অনুচ্ছেদের আলোকে হাইকোর্ট বিভাগের কোনো বিচারককে যেকোনো অস্থায়ী মেয়াদের জন্য আপিল বিভাগে আসন গ্রহণের ব্যবস্থা করবেন এবং শুনানির পর তিনি যে সিদ্ধান্ত দেবেন তার আলোকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায়ের ফলাফল নির্ণীত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত রিটটি দায়ের করা হয় ১৯৯৯ সালে। পরে এ রিটটি শুনানির জন্য তিনজন বিচারক সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করা হয় এবং ওই বেঞ্চ সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ২০০৪ সালে বৈধ মর্মে ঘোষণা করে। অতঃপর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়েরের পর দীর্ঘ দিন আপিল মামলাটি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে ছিল এবং ১৯তম প্রধান বিচারপতি পদে আসীন হওয়ার পর এ আপিলটি শুনানির উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ওই প্রধান বিচারপতি যে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন তা পর্যালোচনায় দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত রায়ে তিনি যে অভিমত দিয়েছিলেন তার সাথে পূর্ণাঙ্গ রায়ের ভিন্নতা রয়েছে। সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল রাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থ ও জনগণের নিরাপত্তার প্রয়োজনে আগামী দু’টি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের বিচারকদের নিয়োগের বিধান বাতিলের বিষয়ে সংসদ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অপর দিকে, সাবেক প্রধান বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ রায়ে আগামী দু’মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হওয়ার বিষয়ে অভিমত ব্যক্ত করে নির্বাচনকালীন সরকারের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ওপর। সংক্ষিপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ রায়ের এ ভিন্নতাকে দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীরা গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করেছেন।
১৯তম প্রধান বিচারপতির প্রদত্ত রায়ে দেখা যায়, তিনি তার রায়ে আইন, বিধি-বিধান ও নীতি-নৈতিকতাকে উপেক্ষা করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ১/১১-এর জরুরি সরকারের কার্যক্রমকে বৈধতা দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন- এ বৈধতার জন্য কি কোনো আবেদন ছিল? এ বিষয়ে কি কোনো শুনানি হয়েছে? আবেদন না থেকে থাকলে এবং শুনানি না হয়ে থাকলে কেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সংসদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে জনগণের শেষ ভরসাস্থল খ্যাত সর্বোচ্চ আদালতকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন? এখানে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো- রিট দায়েরের সময় ১/১১-এর অস্তিত্ব ছিল না। তাই রিটে সে বিষয়ের প্রতিকার চাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। রিটে যে বিষয়ে কোনো আলোচনা নেই, সে বিষয়টি কী করে ১৯তম প্রধান বিচারপতির রায়ের আলোচনায় স্থান পেল? এমনকি আপিল বিভাগে শুনানি গ্রহণকালীন এ বিষয় অ্যামিকাস কিউরি বা রাষ্ট্রপক্ষের কেউ কোনো আলোচনা করেছেন সে সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। রিট দায়ের ও নিষ্পত্তি পর্যন্ত যে শিশুর জন্ম হয়নি, সে কী করে আলোচনায় এলো? যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের অনভিপ্রেত আলোচনা দুঃখজনক ও দুরভিসন্ধিমূলক, যা শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের দৃষ্টিতে গুরুতর অসদাচরণের শামিল।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রধান বিচারপতি স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত রায় জমা দিয়ে তা ফেরত নিয়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পুনঃদাখিল করেছেন। দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের দৃষ্টিতে এ ধরনের পরিবর্তন ও পরিমার্জন অসততা, অন্যায় ও প্রতারণা। এ ক্ষেত্রে ভূতাপেক্ষ কার্যকারিতা দিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাকে বিচারের আওতায় আনা হলে ভবিষ্যতে আশা করা যায় জাতিকে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে না, যদিও সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পরবর্তী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের গঠনপ্রক্রিয়া অদ্যাবধি নির্ধারণ করা হয়নি।
১৯তম প্রধান বিচারপতি সুস্পষ্টভাবে সপ্তম সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত আপিল মামলার রায়ে উল্লেখ করেছেন যে, কোন্ সময়টি ক্রান্তিকালীন সময় হিসেবে গণ্য হবে এবং ওই সময় ব্যতীত অপর কোন সময়কে ক্রান্তিকালীন সময় হিসেবে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। দৃশ্যত এ অভিমত দ্বারা ইতপূর্বে সংসদ পঞ্চম ও সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে অসাংবিধানিক শাসনব্যবস্থাকে যেভাবে বৈধতা দিয়েছিল, সে পথটি রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে দৃষ্টিকোণ থেকে যেখানে জনগণের সমার্থক সার্বভৌম সংসদের ক্ষমতা রুদ্ধ, সেখানে কী করে ১৯তম প্রধান বিচারপতি ১/১১-এর সরকারকে অযাচিতভাবে অবৈধ বলে এর কার্যক্রমকে মার্জনা দিয়ে সংসদের ঊর্ধ্বে আদালতকে স্থান দিলেন?
১৯তম প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থাকাকালীন তার কার্যকলাপ প্রধান বিচারপতি তো দূরের কথা উচ্চ আদালতের একজন বিচারকের কাছ থেকে প্রত্যাশিত কার্যকলাপের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল কি না সে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি প্রধান বিচারপতি পদে বহাল থাকাকালীন ট্রুথ কমিশনের কাছে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকে কর্মরত তার কনিষ্ঠ ভ্রাতার চেক জালিয়াতি-সংক্রান্ত একটি মামলা চলমান ছিল। মামলার রায়ের দিন ঢাকা জেলা জজ আদালতসহ সিএমএম আদালতে আকস্মিক পরিদর্শনে যান তিনি। পরে দেখা যায় সে মামলা থেকে তার ভাই বেকসুর খালাস পেয়ে যান এবং নথি থেকে জালিয়াত-সংক্রান্ত চেকটি গায়েব হয়ে যায়। এ একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে হয়ত অনেক কিছু বের হয়ে আসবে।
ইতপূর্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহালের দাবিতে জাতি অনেক আন্দোলন সংগ্রাম দেখেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা বা না থাকার বিষয়টি সংসদের একক এখতিয়ার। আদালতের বিভক্ত রায়ে এটিকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাঠামো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব সংসদের ওপর ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়। আদালত ও সংসদ জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনে বাস্তবতার নিরিখে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করলে আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে জাতিকে এ অনাহূত বিতর্কের সম্মুখীন হতে হতো না। এ অনাহূত বিতর্কের পেছনে যার কার্যকলাপ মুখ্য তিনি অন্য কেউ নন, ১৯তম প্রধান বিচারপতি। সংবিধান, আইন, বিধি-বিধান ও নীতি-নৈতিকতা পর্যালোচনা করে তিনি নিজেই বিবেচনা করে দেখতে পারেন অবসরগ্রহণ-পরবর্তী তার রায় লেখার ও রায়ে স্বাক্ষর দেয়ার অবকাশ ছিল কি না, সংক্ষিপ্ত ও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে ভিন্নতা গ্রহণযোগ্য কি না, স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত রায় জমা দিয়ে তা ফেরত নিয়ে পরিবর্তন ও পরিমার্জন আইন দ্বারা সমর্থিত কি না এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে ১/১১-এর বিষয়টি আলোচনায় এনে সেটিকে অবৈধ বলে মার্জনা দেয়ার সুযোগ ছিল কি না? এ চারটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে এটি একটি প্রশ্নবিদ্ধ রায়।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.