কাউন্সিলের আগেই চেয়ারপারসন নির্বাচন by কাফি কামাল

আগামী ১৯শে মার্চকে সম্ভাব্য তারিখ ধরে দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। ভেন্যু বুকিংয়ের জন্য চিঠি ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অনুমতি চেয়ে দু-একদিনের মধ্যেই আবেদন জানাবে দলটি। ভেন্যু বুকিং ও অনুমতি সাপেক্ষে চূড়ান্ত হবে কাউন্সিলের দিন-তারিখ। সেটা চূড়ান্ত হলেই দলের চেয়ারপারসন পদে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা ও দ্রুততম সময়ে চেয়ারপারসন নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে বিএনপি। কাউন্সিলের শুরুতেই এ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই আগেভাগে এ প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় দলটি। এছাড়া তারিখ চূড়ান্ত হলেই গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের জন্য কাউন্সিলরদের কাছে প্রস্তাবনা আহ্বান করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মহাসচিবের কাছে জমাকৃত প্রস্তাবনাগুলো গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের পর দলের স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপন করবেন। কাউন্সিলে সবার মতামতের ভিত্তিতে সেগুলোর সংযোজন-বিয়োজন করা হবে গঠনতন্ত্রে। তবে কাউন্সিলের আগেই দলের তৃণমূলে চলমান পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সরকারের প্রতিবন্ধকতা এড়াতে এবারের কাউন্সিল নিয়ে খুব বেশি হাঁকডাক থাকবে না। নীরবেই এ মহাযজ্ঞটি সমাধান করতে চায় তারা। বিএনপি নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সদস্যসহ একাধিক সিনিয়র নেতা এবং দলের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছেন। দলের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে সাংগঠনিক কাঠামোতে কয়েকটি নীতিগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে কাউন্সিলে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মতবিনিময় সভা ও দলীয় ফোরামে চেয়ারপারসনের কাছে উত্থাপিত কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে- এক নেতা এক পদ নীতিতে কমিটি গঠন, জাতীয় নির্বাচনে এমপি প্রার্থীদের স্থানীয় কমিটির পদে না রাখা, দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব পদটি সংরক্ষিত রাখা, জাতীয় নির্বাহী কমিটির পরিধি কমানো, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টামন্ডলীকে বিএনপির উপদেষ্টামন্ডলীতে পরিণত এবং মন্ত্রণালয় ভিত্তিক চেয়ারপারসনের পরামর্শক কমিটি গঠন। বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের তরফে দলীয় কাউন্সিলের ঘোষণা দেয়ার পরপরই কাউন্সিল আয়োজনের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করে বিএনপি। দুই সপ্তাহ প্রস্তুতির পর শনিবার রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়। তবে কাউন্সিলের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি সে বৈঠকে। তবে আগামী ২৮শে মার্চ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের আগেই বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠানের ব্যাপারে মতামত এসেছে নীতিনির্ধারণী কমিটির শনিবারের বৈঠকে। নেতারা জানান, সামপ্রতিক বছরগুলোতে দু’দফায় প্রাথমিক প্রস্তুতি নেয়ার পরও সরকারের নানা পদক্ষেপের কারণে কাউন্সিল আয়োজন থেকে সরে আসতে হয়েছে বিএনপিকে। এবারও সরকারের তরফে যে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন তারা। তাই সরকারি দলের কাউন্সিলের আগে বিএনপি কাউন্সিল আয়োজন করতে চায়। যাতে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে নির্বাচন কমিশন ও দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে এ ব্যাপারে বিএনপি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে পারে। পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে একটি ভিডিও বার্তার মাধ্যমে দীর্ঘ বক্তব্য দিয়েছিলেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান। তার সে বক্তব্য নেতাকর্মীদের করেছিল দারুণভাবে উজ্জীবিত। এবারের কাউন্সিলেও তিনি একটি ভিডিও বক্তব্য দেবেন বলে জানিয়েছেন একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র। বিএনপি সূত্র জানায়, আগামী ১৯শে মার্চকে প্রাথমিকভাবে বিবেচনায় রেখে ১৫ থেকে ২৪শে মার্চের মধ্যে কাউন্সিল আয়োজনের জন্য ভেন্যু বুকিং ও প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন জানানোর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভেন্যু হিসেবে প্রথম পছন্দে রয়েছে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনকে রাখা হতে পারে বিকল্প হিসেবে। ভেন্যু বুকিংসহ অনুমতি সাপেক্ষে দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে। এক্ষেত্রে অনুমতিজনিত জটিলতা এড়ানোর জন্য বিকল্প পথও খোঁজা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে আলোচনায় রয়েছেন দু’জন জ্যেষ্ঠ নেতা। পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন বিএনপির ভাইস বিচারপতি টিএইচ খান। কিন্তু তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের নামও প্রস্তাবনায় রয়েছে। কাউন্সিলের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি বিবেচনা করে দু’জনের মধ্যে একজনকে এ দায়িত্ব দেয়া হবে। বিএনপি সূত্র জানায়, কাউন্সিলের জন্য ২০১৩ সালে গঠিত কমিটিগুলোকে প্রাধান্য দিয়েই প্রস্তুতি কমিটি গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে স্থায়ী কমিটির শনিবারের বৈঠকে। তবে মৃত্যু, অসুস্থতাজনিত কারণ এবং নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে সেসব কমিটিতে কিছু পরিবর্তন আসবে। কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলের চেয়ারপারসন ও কেন্দ্রীয় দপ্তর ভিত্তিক দুটি উপ-কমিটি গঠন করা হবে। প্রস্তুতি কমিটিগুলোকে এ দুই উপ-কমিটি প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক সহযোগিতা করবেন। কাউন্সিলের তারিখ চূড়ান্ত হওয়ার পর প্রস্তুতির জন্য গঠিত কমিটিগুলো কাজ শুরু করবেন। এদিকে বিএনপির দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্র জানায়, আগামী কাউন্সিলে কাউন্সিলর হিসেবে অংশ নেবেন অন্তত ৩ হাজার কাউন্সিলর। শিগগিরই কাউন্সিলর তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর চেয়ারপারসনের কোটায় মনোনীত কাউন্সিলরসহ সবার কাছে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হবে। এছাড়া কাউন্সিলের প্রথম সেশনে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল, বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দল, বিএনপির জেলা, মহানগর, থানা, উপজেলা ও পৌর ইউনিটের নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। বিগত কাউন্সিলে অংশ নিয়েছিলেন কয়েকটি দেশের বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা। এবারের কাউন্সিলেও যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলের মতো ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে একটি সংগীত তৈরি করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কণ্ঠশিল্পী আসিফ আকবরকে সে সংগীতে কণ্ঠ দেয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে থাকবেন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসের সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মনির খান। জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমেই সাধারণ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পুনর্গঠন করা হয়। পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে সাংগঠনিক কাঠামোতে পরিবর্তনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলেরর পর পেরিয়ে গেছে ৬ বছর। তিন বছর পরপর কাউন্সিল আয়োজনের গঠনতান্ত্রিক ও নির্বাচন কমিশনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সেটা পারেনি বিএনপি। ইতিমধ্যে দলের স্থায়ী কমিটিসহ ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমন্ডলী ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা মৃত্যুবরণ করেছেন। দীর্ঘ অর্ধযুগের এ সময়ে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়েছেন অনেকেই। সেইসঙ্গে ছাত্রদলের রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়া সাবেক ছাত্রনেতা ও যুবনেতারা সাংগঠনিক কাঠামোতে আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। সামপ্রতিক বছরগুলোতে একাধিক মতবিনিময় সভায় সক্রিয় নেতাদের পদোন্নতি, নিষ্ক্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে নতুনদের সুযোগ দেয়ার কথা বলেছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের পদায়ন নিয়েও দীর্ঘদিন অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে বিএনপি। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন মৃত্যুবরণ করার পর থেকে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু দিন সময়েও তাকে ভারমুক্ত করা হয়নি। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে বলে নানা সময়ে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সরকারি দলের তরফেও বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে টিপ্পনি শুনতে হয়েছে চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকে। বিগত ৬ বছরে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবদানের কথা বিবেচনা করে এবারের কাউন্সিলে তাকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিবের দায়িত্ব দেয়া হতে পারে। ইতিমধ্যে দলের শীর্ষ নেতৃত্বে এ ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিকভাবে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। দলীয় সূত্র জানায়, কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে দলের নেতাদের বিগত ৬ বছরের কর্মকাণ্ড, অবদান, সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে বিগত ৬ বছরে নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলার একটি তালিকা তৈরি করে চেয়ারপারসনের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্ধারণের জন্য দলের কেন্দ্রীয় দপ্তরের তালিকা ছাড়াও নানামুখী খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। এছাড়া লন্ডন সফরকালে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভবিষ্যত কর্ণধার তারেক রহমানের সঙ্গে সাংগঠনিক পুনর্গঠন ইস্যুতে আলোচনা করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। নেতারা জানান, আগামী কাউন্সিলেই সে আলোচনার একটি প্রতিফলন ঘটবে দলের নেতৃত্ব নির্বাচনে।

No comments

Powered by Blogger.