প্রশ্নটি মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছেই! by মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন

কয়েকদিন আগে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, তিনি বের হলে চারদিকের রাস্তাঘাট বন্ধ করে মানুষজনকে আটকে রাখায় তার ভীষণ কষ্ট হয়। রাষ্ট্রপতির এ উপলব্ধিকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কারণ রাজধানী ঢাকার রাস্তায় কোনো ভিআইপি বের হলেই বেশ কিছুক্ষণ আগ থেকেই রাস্তাঘাট ফাঁকা করার জন্য পথচারীসহ সব ধরনের যানবাহন আটকে রাখা হয়। ফলে জনসাধারণকে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। তবে গত ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যা ঘটেছে তা বোধহয় এ যাবতকালের রেকর্ড। সেদিন রাজপথের বেশ কিছু এলাকার প্রতি ইঞ্চি জায়গা দখল করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাজধানীকে সম্পূর্ণরূপে অচল করে দেয়া হয়েছিল। ওই দিন বায়তুল মোকাররমের পার্কিং থেকে বের হয়ে হাউস বিল্ডিংয়ের সামনের বড় রাস্তায় আসতেই চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেল। মনে হয়েছিল বড় রাস্তায় এসে পড়ায় এখন যেতে পারব। কিন্তু হা-হতোস্মি! সেখানে একেবারে স্থির হয়ে থাকতে হল। গাড়ির চাকা এক ইঞ্চি সচল করা গেল না। এক ভদ্রমহিলা তো গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে যেতে যেতে সরকারকে গালমন্দ করতে থাকলেন। আমার প্রোস্টেট সমস্যার কারণে আমাকে দুই আড়াই ঘণ্টা পরপর টয়লেটে যেতেই হয়। এখানে রাস্তায় গাড়ির ভেতরে বন্দি অবস্থায় প্রায় দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে তোপখানা সিগনালে অবস্থানরত পুলিশ ভাইদের কাছে গেলাম। সার্জেন্টকে বললাম, এখানে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে বন্দি অবস্থায় আছি। তিনি বললেন, কিছু করার নেই। সবদিকের রাস্তাঘাট বন্ধ। জবাবে বললাম, ২০-২৫ গজ দূরেই আমার গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত সামনের কয়টা গাড়ি যেতে দিলে আমি ডান দিক দিয়ে চলে যেতে পারতাম। তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন সামনে ডানে সব রাস্তা ব্লক। এ অবস্থায় রাস্তায় কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর দেখলাম, বিজয় নগরের দিকে কিছু গাড়ি যাওয়ার মতো ফাঁকা হয়েছে। আমি সিগনালে দাঁড়ানো একজন অফিসারকে বিষয়টি জানালে তিনি সার্জেন্টকে নির্দেশ দিয়ে কিছু গাড়ি ছেড়ে দিতে বলায় আমি সে স্থান থেকে বের হয়ে সোজা অফিসার্স ক্লাবে গিয়ে ঢুকলাম এবং প্রায় দৌড়ে গিয়ে টয়লেট ব্যবহার করলাম। রাস্তায় বন্দি অবস্থায় থেকে টয়লেট ব্যবহার করে যে আরাম পেলাম তা চিরদিন মনে থাকবে। এ আরাম এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার গোপাল ভাঁড়ের সেই গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটি বলে ফেলি : রাজা পুত্রসন্তান লাভ করায় প্রাসাদে বিরাট খানাপিনা এবং আমোদ আহলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরই এক ফাঁকে মহারাজ গোপালকে ডেকে বললেন, ‘আমি পুত্রসন্তান লাভ করায় তুমি কতটা আনন্দিত গোপাল?’ গোপাল এক মুহূর্ত ভেবেই জবাব দিলেন, ‘মহারাজ বাহ্য ত্যাগের পর আমি যে সুখ-আনন্দ পাই তেমন আনন্দই পেয়েছি’। একথা শুনে মহারাজ ক্ষিপ্ত হয়ে গোপাল ভাঁড়কে বন্দি করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করলেন। অতঃপর শূলে চড়ার আগে গোপালের অন্তিম কোনো খায়েশ আছে কিনা জানতে চাইলে গোপাল বললেন, মহারাজ মরেই যখন যাব, তার আগে আমি আপনার সঙ্গে নৌ-ভ্রমণে যেতে চাই। মহারাজও তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে রাজি হলেন এবং দু’জন নৌ-ভ্রমণে বেরিয়ে পড়লেন। গোপাল নিজেই নৌকা চালাতে থাকলেন এবং চালাতে চালাতে একদম মধ্য নদীতে চলে গেলেন। হঠাৎ এ সময় মহারাজের পেটে মোচড় দিতে লাগায় তিনি গোপালকে তাড়াতাড়ি নৌকা কূলে নিতে বললেন। আদেশ পেয়ে গোপাল নৌকা কূলের দিকে ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকলেন। এ অবস্থায় রাজা গোপালকে আরও জোরে বৈঠা চালাতে বললেন। এভাবে নৌকা কূলে ভিড়তেই রাজা নেমে দৌড়ে গিয়ে বাহ্য ত্যাগ শেষে গোপালের কাছে ফিরে এসে বললেন, ‘কী সুখ আর তৃপ্তি যে পেলাম তা বলে বোঝাতে পারব না, যাও তোমার মৃত্যুদণ্ড আমি রহিত করে দিলাম।’ গোপাল আজ্ঞে হুজুর বলে প্রাসাদ ত্যাগ করলেন।
এখন প্রশ্ন হল গোপাল ভাঁড় না হয় রোজ রাজপ্রাসাদে যেতেন এবং রাজার সঙ্গে কথা বলে সবকিছু বোঝাতে পারতেন; কিন্তু আমাদের দেশের রাজন্যবর্গকে কীভাবে কে বোঝাবেন? এ দেশে হাজার হাজার মানুষ রাস্তাঘাটে মিটিং-মিছিল ইত্যাদির কারণে বিড়ম্বনায় পড়েন, সেসবের অবসান হবে কবে? আমি না হয় সেদিন পল্টনের মোড়ে দাঁড়ানো সেই পুলিশ সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লেখাটি শেষ করলাম। কিন্তু ৪ জানুয়ারির মতো আর কতদিন জনসাধারণকে আটকে রেখে মিটিং-মিছিল করা হবে সে প্রশ্ন তো থেকেই গেল। আর মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছেই প্রশ্নটি জোরেশোরে উপস্থাপন করলাম।
লেখক-মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্টমুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : রাজনীতিবিদ, কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.