কেন আটকে আছে শিক্ষকদের পে-স্কেল? by মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, শিক্ষকরা না বুঝে আন্দোলন করছেন। যদিও তিনি স্পষ্ট করে বলেননি শিক্ষকরা পে-স্কেলের কোন বিষয়গুলো বোঝেননি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তা ঘোষিত অষ্টম পে-স্কেলে অনুপস্থিত রয়েছে। যে বিষয়গুলো পে-স্কেলে নেই সেই বিষয়গুলো কীভাবে শিক্ষকরা বুঝবেন সেই বিষয়টি বুঝিয়ে বলার জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন, শিক্ষকরা যে দাবিগুলো উত্থাপন করেছেন এবং যা যৌক্তিক বিবেচনায় মন্ত্রিপরিষদের অনেক সদস্য বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পে-স্কেলে রয়েছে তাহলে আমাদের শিক্ষক নেতাদের অজ্ঞতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকরা জাতির কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন সেই প্রতিশ্র“তি প্রদান করছি। আর যদি তিনি প্রমাণে ব্যর্থ হন তাহলে আমরা এ সাবেক আমলাকে আর এক মুহূর্তের জন্যও অর্থমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই না। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘জ্ঞানের অভাব রয়েছে’ এমন অভিযোগ উত্থাপন করে পরে ক্ষমা প্রার্থনা করার মাধ্যমে পার পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার কোনো ক্ষমা প্রার্থনা নয়, পে-স্কেল নিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিষয়ে অবমাননাকর বক্তব্য প্রদান করায় অনতিবিলম্বে অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছি।
অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সরকারের কাছে দয়া-ভিক্ষা করছেন! অবশ্যই প্রথম থেকে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতাদের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র আন্দোলনই এর জন্য দায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করছেন এবং তারা আমলা বা অন্য কারোর সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে চান না। তাদের একমাত্র চাওয়া সরকার প্রতিশ্র“ত স্বতন্ত্র পে-স্কেল বাস্তবায়ন। কিন্তু প্রথম থেকেই দেখেছি, শিক্ষক ফেডারেশনের নেতাদের আন্দোলন ও বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে এক ধরনের গোঁজামিল রয়েছে। তারা একদিকে বলছেন, আমরা আমলা বা অন্য কারোর সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে চাই না, অন্যদিকে আবার তারা স্বতন্ত্র পে-স্কেলের দাবি উত্থাপনের ক্ষেত্রে ‘ঝেড়ে কাশতে’ পারেননি। ফলে সরকার শিক্ষক নেতাদের এ অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়েছে। সরকার আমলাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তুলনা করেই অষ্টম পে-স্কেলের গেজেট প্রকাশ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতিতেও সেই তুলনা এখনও লক্ষ করা যাচ্ছে।
তাই একজন তরুণ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষক ফেডারেশনের নেতাদের কাছে বিনীতভাবে বলতে চাই, অষ্টম পে-স্কেলে কী বৈষম্য আছে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেলের দাবি উত্থাপন করুন। অন্যথায় অষ্টম পে-স্কেলের ছকে বন্দি থেকে কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে না। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেলের দাবি নতুন কোনো বিষয় নয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই একাধিকবার এমন প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। ‘সংকটমোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে আওয়ামী লীগের রূপকল্প-২০২১ সাল কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ শীর্ষক প্রবন্ধে ‘শিক্ষা’ উপশিরোনামে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রণয়নের বিষয়টি বলা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়েছে : ২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়নে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে’ (‘ভিশন ২০২১’, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা : ২০০৯, পৃ. ৫১)। ২০০৮ ও ’১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্র“তি রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন গঠন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের কথা বলা হয়। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে : ‘আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে’ (পৃ. ৫৮)। শিক্ষক ফেডারেশনের নেতাদের এখন উচিত হবে সবকিছু ভুলে জাতির সামনে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময়ে দেয়া প্রতিশ্র“তি তুলে ধরা এবং সেই প্রতিশ্র“তির বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন করা।
অবশ্য শিক্ষক নেতারা কতটুকু তা পারবেন তা নিয়ে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে! কারণ সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়নের জন্য শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে হতে পারে। কিন্তু দলীয় রাজনীতির শিকলে বন্দি শিক্ষক নেতাদের পক্ষে কি আদৌও তা সম্ভব হবে!
দুই.
বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে আর একটি প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোরালোভাবে উত্থাপিত হচ্ছে : এর আগে যে অর্থমন্ত্রী তার অশালীন বক্তৃতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, সেই অর্থমন্ত্রী আবারও কী করে শিক্ষকদের হেয় প্রতিপন্ন করে বক্তব্য প্রদান করেন? অবশ্যই গত কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় পাতায় ঘোরাঘুরি করা একটি ছবির মধ্যেই এ প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক ফেডারেশনের নেতাদের সেলফি উৎসবই সেই সাহসের প্রধান উৎস।
অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের সেলফির ছবিটি পোস্ট করে সালেহ হাসান নকিব নামে এক শিক্ষক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বডি ল্যাঙ্গুয়েজ একটি মারাত্মক জিনিস। কে দাস আর কে প্রভু তা সুস্পষ্ট। আবুল মালের বেপরোয়া বক্তব্যের উৎসটি এখানেই। পরোয়া করে না, কারণ পরোয়া করবার প্রয়োজন নেই।’ নকিব কি সত্যি ভুল লিখেছেন? সেদিন যদি শিক্ষক নেতারা সেলফি উৎসবে না মেতে দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে পারতেন তাহলে হয়তো অর্থমন্ত্রী তার প্রতিশ্র“তি ভঙ্গ করা এবং নতুন করে শিক্ষকদের প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য প্রদানে সাহস করতেন না। আমরা চাইব আগামী দিনে আমাদের শিক্ষক নেতারা আর সেলফি উৎসবে না মেতে দৃঢ়তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে দাবি আদায় করেই তবে ঘরে ফিরবেন।
তিন.
আন্দোলনের ধীরগতি নিয়ে সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ রয়েছে। তাদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিযোগ করছেন, শিক্ষক ফেডারেশনের নেতারা সাধারণ শিক্ষকদের স্বার্থের চেয়ে নিজের আগামী দিনের ক্যারিয়ারকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বলেই আন্দোলনের এমন ধীরগতি। অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক রাজনীতি করেন তাদের শেষ জীবনে স্বপ্ন থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হবেন। তাই কোনো শিক্ষক নেতাই চাইবেন না তার নেতৃত্বে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হোক যাতে তার সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আমরা শিক্ষক নেতাদের এ চাওয়াকে ধূলিসাৎ করতে চাই না। অথবা আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে কেউ নতুন কোনো সংকটের সৃষ্টি করুক সেটিও চাই না। কিন্তু প্রশ্ন রাখতে চাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়াই কি শিক্ষক জীবনের সার্থকতা? একবার কি ভেবে দেখবেন ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ২৭ ব্যক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদ অলংকৃত করেছেন, কয়জনকে এ দেশের মানুষ মনে রেখেছে? এমনকি ঢাবির ছাত্ররাই বা কয়জনের নাম জানে? অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না হয় বাদই দিলাম। শিক্ষক নেতাদের এ বিষয়টি ভাবার জন্যও অনুরোধ করছি।
পরিশেষে, শিক্ষক নেতাদের কাছে বিনীত অনুরোধ, দয়া করে সময় থাকতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করুন। আর সাধারণ শিক্ষকদের মান-অভিমান ভুলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ফেডারেশন ঘোষিত কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বান করছি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কঠোর অবস্থানই বলে দিচ্ছে যে, শিক্ষকদের দাবি আদায় খুব সহজে হবে না। তাই সব শিক্ষকের মনে রাখা উচিত- বিভেদ নয়, দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের বিকল্প নেই।
মো. আবুসালেহ সেকেন্দার : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
salah.sakender@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.