উচ্চ প্রবৃদ্ধির জন্য চাই মানবসম্পদের উন্নয়ন by সালমা ইসলাম

নিকট-ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সুসংবাদ না থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও খ্যাতিমান বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনার দিকগুলো উঠে এসেছে। গত কয়েক বছরের বিশ্বমন্দার কথা বিবেচনায় রেখে বলা যায়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সব বাধা কাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে। বিশ্লেষকদের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ আমূল বদলে যাবে বিশ্ব অর্থনীতির চিত্র। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, আগামী দিনগুলোতে অনেক দেশে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, ২০৫০ সাল নাগাদ যে কয়েকটি দেশে মোটামুটি উচ্চ প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে তার একটি বাংলাদেশ। উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধির ধারা ধরে রাখতে হলে দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি যেসব কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতা সৃষ্টির আশংকা তৈরি হয় সেসব বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের বিকল্প নেই। আমাদের এখন ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করার বিষয়েই গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে আগামী দিনগুলোতে বিভিন্ন দেশে বৈশ্বিক গড় প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখাই অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, সেখানে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কাজটি কত কঠিন তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রাকৃতিক সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত শতকে এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধি কেবল জাপানই অর্জন করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করুণ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে দীর্ঘসময় উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে জাপান। আমাদের দেশে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে না পারলে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হতে পারে। উন্নয়নের দৌড়ে প্রতিযোগী অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের এগিয়ে থাকতে হলে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য এমন বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব থাকলে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়বে না এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে বিনিয়োগের অন্যতম বাধা ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ। ঋণের সুদের হার না কমলে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো থাকলেও বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। একজন শিল্পোদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে কোনো কারখানা প্রতিষ্ঠা করলে যাতে উৎপাদন শুরু করতে কোনোরকম বাধার সম্মুখীন না হন, সেটা নিশ্চিত করা অতি জরুরি। কোনো বাধা তৈরি হলে কেবল উদ্যোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, একই সঙ্গে অনেক কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট হবে। এ ধরনের পরিস্থিতি অন্যান্য বিনিয়োগকারীকেও হতাশ করবে।
রেমিটেন্স ও তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; এ দুই খাতে আরও জোর দেয়া দরকার। তবে দীর্ঘমেয়াদে দেশের টেকসই উন্নয়নের কথা চিন্তা করলে এ দু’খাতে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়নেই আমাদের বেশি জোর দেয়া প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, দেশের দ্রুত অগ্রগতির জন্য শুধু শ্রমনির্ভর শিল্প-কারখানার ওপর নির্ভর না করে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প-কারখানার বিকাশের দিকেও জোর দেয়া উচিত। উচ্চ প্রযুক্তির শিল্প-কারখানায় কাজ করার যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করতে সক্ষম না হলে প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প-কারখানা বিকাশের গতি বেগবান হবে না। কারণ এ ধরনের শিল্প-কারখানায় বিদেশী কর্মীর চেয়ে দেশী কর্মীর ওপরই বেশি নির্ভর করতে হবে। বিদেশী কর্মীর ওপর নির্ভর করে যে কোনো খাতের শিল্প-কারখানার বিকাশে স্থবিরতা দেখা দেয়ার আশংকা থাকে বেশি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে দীর্ঘসময় উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকার নেপথ্যে যেসব বিষয় কাজ করেছে তার অন্যতম হল উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। আমরা যদি উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হই, এ উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হাত ধরেই দেশে উচ্চতর গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। আগামী দিনগুলোতে সর্বক্ষেত্রে উচ্চতর গবেষণায় নেতৃত্বে থাকতে না পারলেও কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
২.
বর্তমান বাস্তবতায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আমদানিনির্ভরতা কী করে কমানো যায়- সেদিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি আমদানি করে উৎপাদনের পরিধি বাড়াতে হবে। উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা দরকার। বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁচামাল আমদানির পরিবর্তে দেশে উৎপাদনের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি কুটির শিল্পের বিভিন্ন পণ্যের বাজারজাতকরণের দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। দেশের যেসব প্রান্তিক মানুষ একমাত্র কুটির শিল্পের ওপর নির্ভরশীল, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের উৎপাদিত পণ্যেও বৈচিত্র্য আনা সম্ভব।
যেসব ব্যক্তি কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িত কিংবা প্রান্তিক চাষী, তাদের সন্তানরা যাতে উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কল-কারখানায় দক্ষ কর্মী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। এ ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিতে হবে যুগোপযোগী শিক্ষা বিস্তারে।
শিক্ষা সম্পর্কে আমাদের দেশের অনেক মানুষের ভুল ধারণা রয়েছে। তারা মনে করেন, তাদের সন্তানের উচ্চশিক্ষা জরুরি। সন্তানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য অনেকে নিজের শেষ জমিটুকুও বিক্রি করে দেন। দরিদ্র পরিবারের কোনো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর কাক্সিক্ষত চাকরি না পেলে ওই পরিবারের সদস্যরা হতাশ হন। ওই ধরনের পরিবারের শিক্ষার্থীরা যাতে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের সব ধরনের শিক্ষা বিশ্বমানের হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যাতে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিজের মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়, তাদের তেমনভাবে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষার্থীর মূল্যায়নে তাদের সৃজনশীলতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
সম্প্রতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়ন ও পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে আনার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কোনো কোনো আলোচক মনে করেন, পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা কমালে এ খাতে অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে। যারা পরীক্ষার সংখ্যা কমানোর কথা বলেন তাদের মনে রাখা দরকার, পরীক্ষার সংখ্যা কমালে তা শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জনের প্রাথমিক বা প্রস্তুতি পর্বেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। একসময় কারও কারও ধারণা ছিল, প্রাথমিক সমাপনীর মতো পরীক্ষা দিতে গিয়ে শিশুরা হয়তো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। বাস্তবে আমরা লক্ষ করি, শিশুরা আনন্দের সঙ্গে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে শিশুরা যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে এতেই স্পষ্ট হয় তারা আনন্দের সঙ্গেই বিষয়টি মেনে নিয়েছে। বারবার পরীক্ষার মুখোমুখি হলে অন্তর্মুখী শিশুরাও নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা করে। এতে তাদের বিভিন্ন বিষয়ে জানার কৌতূহল বাড়ে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার সংখ্যা কমলে শিশুদের কৌতূহল বৃদ্ধির সুযোগ সংকুচিত হবে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই যেসব শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে, তারা ব্যক্তিগত জীবনে সফল হতে হিমশিম খায়। প্রাথমিকের কোনো শিক্ষার্থীই ঝরে পড়বে না- এটা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে দেশের টেকসই উন্নয়নে নানা ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সময় একজন শিক্ষার্থীর মানবিক গুণাবলীর পরিপূর্ণ বিকাশেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া দরকার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যক্তির মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ করায় কী ধরনের ভূমিকা রাখবে এ নিয়ে মতভেদ থাকলেও আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হাজার বছরের মানবিক সংস্কৃতিকে ধারণ করার পক্ষে নিজের অবস্থান অটুট রাখে, এ বোধ তাদের ভেতর জাগ্রত করতে হবে। আবহমান কালের রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত না হলে একজন শিক্ষার্থী বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জন করলেও তার ভেতর অনেক অপূর্ণতা থেকে যাবে। আমাদের কোনো শিক্ষার্থীর ভেতর যাতে এ অপূর্ণতা না থাকে এদিকে সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
আনন্দের মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ শুরু না হলে শিশুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় না। কী করে শিশুরা আনন্দের সঙ্গে অধ্যয়নে যুক্ত থাকবে তা গবেষণা করে বের করতে হবে। কেবল অনুকরণ করে শিক্ষার কোনো ক্ষেত্রেই প্রকৃত অগ্রগতি সম্ভব নয়। আমাদের শিশুদের মন ও মননের বিকাশে সহায়ক পাঠ্যপুস্তক রচিত না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অনিশ্চিত থেকে যাবে। অনুকরণনির্ভর অধ্যয়ন দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্গত মর্মবাণীর প্রতি শিশুদের যাতে আগ্রহ বাড়ে, এমন পুস্তকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। হাজার বছর ধরে প্রচলিত আমাদের সংস্কৃতির মানবিক দিকগুলোর সঙ্গে শিশুদের পরিচয়ের সুযোগ বাড়াতে হবে।
একজন শিক্ষার্থী যাতে শুধু প্রযুক্তি বা শুধু মানব বিদ্যায় পারদর্শী হয় তাহলে তার মধ্যে এক ধরনের অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। এটা দূর করার জন্য যাতে সে উভয় বিষয়ে পারদর্শী হতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। একজন শিক্ষার্থী আজীবন কী করে সর্বোচ্চ মানবিকতার চর্চায় উদ্বুদ্ধ হবে- এ বিষয়ে গবেষণা অব্যাহত রাখতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ বলতে কী বোঝায়- এ বিষয়টিও গভীরভাবে ভাবতে হবে।
৩.
বহুমুখী প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকার পরও চলমান বিশ্বমন্দার প্রভাব থেকে উন্নত দেশগুলোর বেরিয়ে আসতে না পারার বিষয়টি বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিশ্লেষকরা পেছনে ফেলে আসা ঘটনার বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেন কেন বিশ্বমন্দা এত দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে কী ধরনের নীতি অবলম্বন করলে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে মন্দার কবল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব- এটাই এখন বিশ্ববাসীর অন্যতম চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরের বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধির হার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অনেক দেশেই প্রবৃদ্ধি অর্জনে এক ধরনের স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে। উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প-কারখানা বিকশিত হওয়ার পরও যেসব দেশের প্রবৃদ্ধিতে স্থরিবতা সৃষ্টি হয়েছে- সেসব দেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছার কাজটি অত্যন্ত কঠিন। কোনো কোনো দেশের প্রবৃদ্ধি দুই অংক থেকে ৪ শতাংশ, এমনকি ২ শতাংশ হওয়ার বিষয়টিও বিশ্ববাসীকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলবে। এসব বিষয়ে বিশ্লেষকরা গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দেবেন এটাই স্বাভাবিক। সাধারণভাবে বলা যায়, রফতানি কিংবা উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে একক পণ্যের ওপর নির্ভর করলে ঝুঁকি থাকে বেশি। উৎপাদিত পণ্য কিংবা রফতানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পণ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। রফতানির ক্ষেত্রে মাত্র কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভর করলেও উচ্চমাত্রার ঝুঁকি থেকেই যায়।
পারমাণবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনার পর পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাপানের মতো উন্নত দেশকেও হিমশিম খেতে হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজনীয় স্বেচ্ছাসেবক গড়ে তোলা জরুরি।
সম্প্রতি ইবোলা ভাইরাসের আতংক বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার পর আমরা লক্ষ করেছি, এ বিষয়ক ডাক্তার ও নার্সের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ ধরনের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদেশী ডাক্তার ও নার্সদের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে নিজ দেশের ডাক্তার ও নার্সদের ওপর নির্ভর করলে দ্রুত সুফল পাওয়া যায়। ইবোলা আতংকের মতো যে কোনো পরিস্থিতি জনবলের অভাবে মোকাবেলা করতে দেরি হলে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ না থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় বহুমুখী সংকটের সৃষ্টি হয়।
যেহেতু বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সামনে অনেক বিকল্প থাকে, তাই তাদের বিনিয়োগে উৎসাহী করার জন্য নতুন শিল্প স্থাপনে আগ্রহীদের স্বল্পসময়ে শিল্প-কারখানা চালু করার ক্ষেত্রে বাধাগুলো দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মতো দেশী বিনিয়োগকারীরাও যাতে সমান সুযোগ পান সে জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া দরকার। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কোনো উদ্যোক্তার বিনিয়োগে উৎসাহ কমে গেলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ২০৫০ সালের বিশ্ব অর্থনীতি সম্পর্কে যে পূর্বাভাস দিয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০৫০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বাংলাদেশে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে দেশটি ২০৫০ সালে অর্থনীতির আকারের দিক থেকে নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি বৃহৎ অর্থনীতির দেশকে ছাড়িয়ে যাবে। উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানটি যেসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশের অগ্রগতির পূর্বাভাস দিয়েছে তার অন্যতম হল প্রযুক্তি ও দক্ষ মানবসম্পদ। এ দুই ক্ষেত্রে কোনো দেশ পিছিয়ে থাকলে অন্য অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও কাক্সিক্ষত অগ্রগতিতে বহুমাত্রিক অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
৪.
বিশ্বমন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে মন্দা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে দেশে দেশে শ্রম সাশ্রয়ী প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ফলে আমাদের দেশের কর্মীরা গতানুগতিক দক্ষতা নিয়ে বিদেশে গিয়ে তেমন সুবিধা করতে পারবে না। কেবল বিদেশে যেতে আগ্রহী কর্মীই নয়; দেশের শিল্প-কারখানায় কাজ করতে আগ্রহীদের দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি সম্প্রতি জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, সেসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করে আমাদেরও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে শ্রমঘন শিল্প-কারখানার পাশাপাশি উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ শিল্প-কারখানা দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। আমাদের প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ শিল্প-কারখানার বিকাশে মনোযোগ বাড়াতে হবে। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী উচ্চ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ শিল্প-কারখানায় দক্ষ মানবসম্পদের চাহিদা বাড়বে। এ ধরনের মানবসম্পদ গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম না হলে আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ার আশংকা দেখা দেবে।
কোনো একটি দেশ প্রতিবেশী দেশের তুলনায় একবার পিছিয়ে পড়লে সেদেশের অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কত ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়, তা গ্রিসের অর্থনীতির দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়। গ্রিসকে ইইউভুক্ত দেশগুলো উদারভাবে সহায়তা করেছে। এমন সহায়তা না থাকলে পিছিয়ে পড়া কোনো দেশের অর্থনীতিতে কী ভয়াবহ অস্থিরতার সৃষ্টি হবে, এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে আগে থেকে প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। মানবসম্পদ উন্নয়নে পিছিয়ে থাকলে যে কোনো অস্থির পরিস্থিতি মোকাবেলা করা কত কঠিন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। মানবসম্পদ উন্নয়নে বাংলাদেশের ইতিবাচক ধারা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি : প্রকাশক, যুগান্তর

No comments

Powered by Blogger.