উন্নয়ন হলেও সুখ অধরা থাকছে by আবুল মোমেন

বাংলাদেশ এগোচ্ছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উন্নয়নের বিবেচনায় অনেক বিশেষজ্ঞের কাছেই বাংলাদেশ এক বিস্ময়। এই বিস্ময়কর চমকপ্রদ অগ্রগতির জন্য জনগণের সঙ্গে সরকার, বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন।
এরপরে কি আর কথা থাকবে না? ইংরেজ বাঘা বুদ্ধিজীবী বার্ট্রান্ড রাসেলের ‘বাহ্যরূপ ও বাস্তবতা’—এপিয়ারেন্স অ্যান্ড রিয়ালিটি-যুক্তিজালের গোলকধাঁধায় না ঢুকেও বলা যায়—বোধ হয় থাকবে। ছোট্ট দেশ, সার্কের সদস্যরাষ্ট্র ভুটানের রাজা তাবড় অর্থনীতিবিদ ও দুঁদে উন্নয়নবিশারদদের সূচকগুলোতেই কিন্তু সন্তুষ্ট থাকেননি। তিনি নতুন ভাবনার জোগান দিয়েছেন। দেশের উন্নয়নের হদিস নেওয়ার প্রচলিত মাপকাঠি জিডিপি, জিএনপি—অর্থাৎ মোট দেশীয় উৎপাদন, মোট জাতীয় উৎপাদন ইত্যাদিতে উন্নয়নের সম্পূর্ণ চিত্র উঠে আসে বলে মনে করেন না তিনি। রাজা ওয়াংচুক মনে করেন প্রথমত, মানুষের উন্নয়নের চাহিদা কেবল বস্তুগত বিষয়ে সীমিত থাকতে পারে না। দ্বিতীয়ত, উন্নয়নের চাহিদার রূপ ও মান দেশভেদে ভিন্ন ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে তাঁর মতে, সব মানুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য—সুখ। তাই তিনি বলেছেন, কোনো দেশের উন্নয়ন বোঝার মাপকাঠি হবে জিএনএইচ—গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস, মোট জাতীয় সুখের পরিমাপ।
ভুটানের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হাসিখুশি লোকদের অল্প দেখার অভিজ্ঞতায় বেশ সুখী আর সমাজটাকেও শান্তিপূর্ণই মনে হয়েছে। ওদের বিষয়ে বেশি বলার অধিকার আমার নেই। তবে আমরা সবাই জানি গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যগতভাবেই অল্পে তুষ্ট, আশুতোষ। পশ্চিমা একটি জরিপেও দেখা গেছে, সুখের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ওপরেই আছে। এর অর্থ এ দেশের জনগণ বা সাধারণ মানুষ মোটামুটি সুখেই আছে।
এই জরিপের ফল কি সত্য? বাস্তব চিত্র কি এতে উঠে এসেছে? আবারও আমরা রাসেলের গূঢ় তর্কের মুখোমুখি হই—বাহ্যরূপ আর বাস্তবতায় কি ফারাক আছে? জানি, জরিপ আর পরিসংখ্যান অনেক সময় বোকা বানায় আমাদের, ডাহা মিথ্যাও বলতে পারে। তা ছাড়া সুখ বা শান্তির মতো বিমূর্ত এবং নিতান্ত মনোজগতের বিষয়ে পরিমাণগত ধারণা দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে উন্নয়নের প্রচলিত অধিকাংশ সূচকেই বাংলাদেশের চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হলেও সেসব অর্জনকে একটুও খাটো না করে বাস্তবতার আলোকেই বলা যায়, বাংলাদেশের বহু মানুষ সুখেও নেই, শান্তিতেও নেই।
দেশে অনেক ধরনের বৈষম্য বিরাজ করছে এবং তাতে এক পক্ষ অন্য পক্ষের আধিপত্যের কারণে বঞ্চিত বা বঞ্চিত-শোষিত উভয়ই হচ্ছে। অনেক উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশের সমাজকাঠামো সামন্তধাঁচের, ধর্মসংস্কারশাসিত এবং মোটা দাগে রক্ষণশীল ও পুরুষতান্ত্রিক। এমন সমাজে নারী সর্বস্তরের—কর্মক্ষেত্র থেকে সংসার, শৈশব থেকে বার্ধক্য, সধবা থেকে বিধবা ইত্যাদি—বৈষম্যের শিকার, স্বভাবতই অনেকেই নিগ্রহ ও লাঞ্ছনার শিকার এবং প্রায় ঢালাওভাবে পুরুষতন্ত্রের যৌন পীড়নের আতঙ্কে কাটাতে বাধ্য হয়। তার সুখ বড় ঠুনকো, ভাসা-ভাসা, অনেক সময় মেকি এবং ছেলেভোলানো ছলনার বেশি নয়।
বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বহুকাল ধরেই—সেই পাকিস্তান আমল থেকেই বৈষম্যের শিকার। কখনো রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উভয় প্রকার বৈষম্যের শিকার তারা। দীর্ঘকাল ধরে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় কেবল বৈষম্যের কারণেই নয়, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা-নিপীড়নের ফলে ভয়ার্ত জীবন কাটাচ্ছে। তারা যে অসুখী, তার কিছু স্পষ্ট পরিসংখ্যানগত হিসাবও হাজির করা যায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তৎকালীন পূর্ববঙ্গের হিন্দু জনসংখ্যা ছিল এ দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ। পাকিস্তানে ছিল রাষ্ট্রীয় সাম্প্রদায়িকতা, ১৯৬৫-এর পরে যার গভীরতা ও ব্যাপ্তি কেবল বেড়েছে। ১৯৭১-এ স্বাধীনতার পরে এই সংখ্যা নেমে যায় ২২-২৩ শতাংশে। দ্বিজাতি তত্ত্বকে অগ্রাহ্য করে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান–ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মিলে মুক্তিযুদ্ধ করে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হলো, তাতেও সংখ্যালঘুর বিড়ম্বনা থেমে থাকেনি। অনেকেরই সম্পত্তি হাতছাড়া হয়েছে, জনসংখ্যা ক্রমাগতই কমে বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে। সুখে থাকলে কেউ দেশ ছেড়ে যায়?
আমাদের পাহাড়ের প্রতিবেশী ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস্তবতা কী? ১৯৪৭ সালে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালির সংখ্যা ছিল ২ শতাংশ। বর্তমানে সেখানে সমতলের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। নিজ দেশে পরবাসী ওরা। তারপরে তাদের দিক থেকে স্বায়ত্তশাসন, বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সরকারের দিক থেকে সামরিক অভিযানসহ জল অনেক দূর গড়িয়েছে। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির দুই দশক পূর্ণ হলেও কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে পাহাড়িদের মনে সুখ আসেনি। বস্তুত কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ থেকেই তাদের জীবনে সুখ কমতে শুরু করেছে, বাংলাদেশ আমলে তা হ্রাসের হারই বেড়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে জিয়াউর রহমানের বাঙালি অভিবাসন নীতির ফলে তা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে, যা শান্তিচুক্তিও ঠেকাতে পারেনি।
ইদানীং সংবাদপত্রে প্রায়ই পড়ি সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর চরম ভোগান্তির নানা খবর। গত ২৪ ডিসেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ পড়লাম সিলেটের উরাং জাতির রাজাসহ সবার দুরবস্থার কথা। তাদের জমিজমা ভূমিদস্যুদের হাতে গ্রাস হতে হতে এখন ২০ শতাংশও নেই। স্বয়ং রাজা ও তাঁর পরিবার দারিদ্র্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছেছেন। একই অবস্থা সাঁওতাল-গারোসহ সমতলের ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর। তারা ভিটেহারা, জমিহারা হয়ে যাচ্ছে। তার ওপর নারীরা অহরহ যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং কোনো বিচারই পাচ্ছে না। আমরা নিশ্চিতভাবে জানি, দেশের ÿক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন কেউ সুখে নেই।
খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধরা এত দিন এমন করে ভাবেনি, কিন্তু রামুর ঘটনা এবং যাজক ও গির্জার ওপর হামলার পর তাদেরও মনে শান্তি ও সুখে টান পড়তে শুরু করেছে।
দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মধ্যে অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আহমদিয়া সম্প্রদায় বেশ কয়েক বছর ধরে কট্টর সুন্নিদের হুমকি ও হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের একটি মসজিদে বোমা হামলা হয়েছে। একইভাবে দেশের আরেক ক্ষুদ্র মুসলিম সম্প্রদায় শিয়াদের একটি মসজিদেও হামলা হয়েছে, মুয়াজ্জিন নিহত হয়েছেন এবং বেশ কয়েকজন মুসলিম আহত হয়েছেন। আমরা কি কেউ খবর নিয়েছি দেশে আরও যেসব মুসলিম ক্ষুদ্র গোষ্ঠী আছে, যেমন: বাহাই, বোরা, ইসমাইলিয়া, এরা কেমন আছে? বাস্তবের আলামত বলে, তাদের মনে সুখ থাকার কথা নয়।
যদি আমরা শিশু রাজন, রাকিব, রবিউলদের কথা মনে করি, তবে শিউরে উঠে কবুল করতে হবে, এ সমাজ শিশুবান্ধব নয়। তা ছাড়া শিক্ষাজীবন যেভাবে পরীক্ষা ও জিপিএ-৫-এর দাপটে কোচিং, মুখস্থ ও পরীক্ষার শৃঙ্খলে পরিণত হয়েছে, তা শিশুর দৈনন্দিন জীবনের সুখ নষ্ট করেছে। আর অপহরণ-মুক্তিপণ-নেশা-সাইবার অপরাধ-যানজটের মিলিত ফল হলো শিশুদের জীবনে নেই অবকাশ, নেই স্বাধীনতা। খেয়াল করলে দেখা যাবে ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে এ দেশের শিশুরা শৈশবহারা, অসুখী। কিশোর-কিশোরীরাও একই বাস্তবের শৃঙ্খলে ও চাপে সুখী কৈশোর থেকে বঞ্চিত।
হয়তো বাস্তববাদীরা ভাবছেন, সুখ-শান্তি মানসিক ব্যাপার, তা ব্যক্তিগত সাধনায় অর্জন করতে হয়। না, আমরা জানি এ বাস্তব নয়, বাস্তবের বাহ্যরূপমাত্র। কথাটা আমরা তুলেছি তুচ্ছ মানুষের নগণ্য জীবনের সামান্য চাহিদার আলোকেই। এ সমাজে যাঁরা জীবনে ভোগের কিছুই না চেয়ে আপন আনন্দে সাধনমার্গে বিচরণ করতে চান, সেই বাউল-ফকির–পীর-মুর্শিদ সহজিয়া সাধকেরাও কি সুখে আছেন? তাঁদের দাড়ি-চুল কেটে লাঞ্ছিত করা হয়নি? হুমকির মুখে রাখা হয়নি?
মুক্তচিন্তার মানুষ জানেন, তাঁদের পথটি দুর্গম। তবু কেউ কি ভাবতে পারেন, এই একবিংশ শতাব্দীতে, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরও তাঁদের চিন্তা নয়, জীবনই আশঙ্কার মধ্যে থাকবে!
তদুপরি দেশের প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী, দুবারের প্রধানমন্ত্রী ও ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রীই যদি দেশের জন্মযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করেন, জাতির জনককে হেয় করেন, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের অবমাননা করেন, তখন সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষের মনে সুখ থাকে কীভাবে?
দুটি সামান্য নগণ্য কথা বলে শেষ করতে চাই।
প্রথমত, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের যে চমকপ্রদ অগ্রগতি হয়েছে, তাকে অস্বীকার করি না, বর্তমান সরকার যে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে উন্নয়নের পথে, তাও অস্বীকার করার কারণ নেই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকরের কৃতিত্ব ভোলার নয় এবং এই কর্মযজ্ঞে প্রধানমন্ত্রী যে যোগ্য নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাও মানতে দ্বিধা নেই। এসব সাফল্যে অনেকের মতো আমিও স্বস্তি পাই, আনন্দিত হই। এ দেশের মানুষের, বিশেষত তরুণদের, প্রাণশক্তির ওপরও আমি ভীষণভাবে ভরসা করি। সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে তাঁদেরই পক্ষে যে দেশের অর্থাৎ সমাজ ও সমাজমানসের প্রকৃত রূপান্তর ঘটানো সম্ভব, সে বিশ্বাস আমার আছে। ফলে আমি নিরাশাবাদী নই, এখনো আশাবাদী, তবে উদ্বিগ্ন আশাবাদী। আমাদের বুঝতে হবে সুখ-শান্তি সরকার একা এনে দিতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সমাজকে প্রাচীন সংস্কারে বন্দী রেখে, নারীকে পুরুষতন্ত্রের দাপটে রেখে, শিক্ষাকে পরীক্ষার শৃঙ্খলে বেঁধে, গণতন্ত্রকে ক্ষমতার দুর্গে আটকে, চিন্তার গতিপথে অন্ধবিশ্বাসের অর্গল এঁটে সমাজমানসের রূপান্তর করা যায় না। মনের গহিনে আলো প্রবেশ না করলে অন্ধকার কাটবে কীভাবে? এমনটা চলতে থাকলে সে সমাজে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হয়। আশঙ্কার কথা, এ দেশে মুক্তচিন্তার মানুষ তৈরিতে ভাটা চলছে, বিপরীত স্রোত বরং বেশ জোরদার বলেই মনে হয়। সমাজের আলোকন (এনলাইটেনমেন্ট) ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়। এ কাজ সরকারের নয়, সমাজের অগ্রসর মুক্তচিন্তার মানুষের। তবে এই আলোকনের সঙ্গে সঙ্গে তাকে টেকসই ও তার অগ্রগতি নিশ্চিত করতে যে কাঠামোগত সংস্কার, পরিবর্তন, নবায়ন প্রয়োজন, তা সরকারের দায়িত্ব। সে কাজ অনেকটা হচ্ছে বটে, কিন্তু আলোকন ব্যতীত কেবল কাঠামোগত উন্নয়নে মানবিক সমাজ নির্মাণ হবে না। এসব কাজ আরব্ধ রেখে উন্নয়নের বাহ্যরূপে চমকপ্রদ পরিবর্তন ঘটলেও প্রকৃত সুখ অধরাই থেকে যাবে। সে রকম আলামত এ সমাজে প্রকট হয়ে উঠছে—সেটাই ভয়ের বিষয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.