কোন পথে ২০১৬ সালের বিশ্ব: অস্থিরতা বাড়তে পারে বাংলা-পাক-ভারতে by মাসুম খলিলী

২০১৫ সালের শেষার্ধেই মধ্যপ্রাচ্যে সর্বব্যাপী সঙ্ঘাত বিস্তৃত হওয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে। এ সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে এশিয়ায়ও। আফগানিস্তান থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১৬ সালে বাড়তে পারে অস্থিরতা এবং প্রভাব বিস্তারের লড়াই। এ সময়ে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের। এরপর সেখানে কারা ক্ষমতায় থাকবে, তালেবানদের সাথে সরকারের বোঝাপড়া কী হবে, নতুন পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী পাকিস্তান বা ভারতের কী ভূমিকা থাকবে, কতটা সক্রিয় প্রভাব থাকবে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা চীনের- ইত্যাদি নানা প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের সুরাহার জন্য তিক্ত প্রতিযোগিতা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দেখা যাবে অচিরেই।
পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রশ্নে রাজনৈতিক সরকারের ওপর প্রভাব বাড়ছে নিরাপত্তা বাহিনীর। আফগানিস্তান ও কাশ্মিরসহ সংবেদনশীল ইস্যুগুলোয় সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার কমে আসছে রাজনৈতিক সরকারের। প্রতিবেশী ভারতের সাথে সম্পর্ক তৈরির প্রচেষ্টার মধ্যেই অনাস্থা নতুন করে বৃদ্ধির মতো ঘটনা ঘটতে পারে। বৈশ্বিক প্রভাববলয় পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া বিদায়ী বছরে ভারত-পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সম্পর্কে শুরু হয়েছিল, তা ২০১৬ সালে স্পষ্ট অবয়ব নিতে পারে। দুই দেশের নিরাপত্তা সম্পর্কের ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।
ভারত সরকার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি অর্জন, নতুন কাজ সৃষ্টি ইত্যাদি বিষয়ের ওপর অধিক জোর দিতে গিয়ে বিভিন্ন সংবেদনশীল সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হচ্ছে। এর প্রভাব পড়তে পারে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের প্রভাবও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পড়তে পারে। নেপালের তরাই অঞ্চলের মাধেসিদের বিদ্রোহ ধরনের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সালে ভারত ও চীনের সাথে দেশটির সম্পর্কে যে মেরুকরণ শুরু হয়েছিল, তা একটি অবয়ব নিতে পারে। ভারত চাইবে মাধেসির দাবিকে সমন্বয় করে বিষয়টির নিষ্পত্তি হোক; কিন্তু নেপালের মূল ধারার নেতারা রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও কর্তৃত্ব নেপালিদের হাতে রাখার ব্যাপারে আপসহীন থাকতে পারেন। এতে নেপাল আরো বেশি ঝুঁকে যেতে পারে চীনের দিকে। এর ফলে নেপাল নিয়ে দিল্লি-বেইজিং ঠাণ্ডা লড়াই জোরদার হতে পারে।
বাংলাদেশকে ভারত তার নিরাপত্তা রাডারে আরো কঠিনভাবে আবদ্ধ করার ওপর গুরুত্ব দেবে। এতে এখানকার রাজনীতি ও নিরাপত্তাপ্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ একতরফা করার প্রচেষ্টায় প্রতিপক্ষের সাথে নেপথ্য লড়াইও শুরু হতে পারে। আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতীয় নির্দেশনায় সেকুলারাইজ করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, সেটাকে বহাল রেখে একধরনের গণতান্ত্রিক চর্চার আবহ আনার প্রতি গুরুত্ব দিতে পারে। এর প্রভাবে ২০১৬ সালেই আয়োজন হতে পারে নির্বাচনের। আবার দেশটির নিরাপত্তা পরিস্থিতি আইএসের মতো চরমপন্থী দলের জঙ্গি তৎপরতা বিস্তৃতির কারণে অবনতিও ঘটতে পারে।
ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মালদ্বীপে প্রভাব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ২০১৬ সালে অস্থিরতা সৃষ্টির ঘটনা ঘটতে পারে। এর ওপর দক্ষিণ চীন সাগরে সৃষ্ট উত্তেজনার একটি প্রভাব থাকতে পারে। শ্রীলঙ্কা সরকার ভারসাম্য নীতির ওপর গুরুত্ব দেয়ায় দেশটি আরো একটি স্থিতিশীল বছর পার করতে পারে।
আফগানিস্তান : প্রভাব বিস্তারের লড়াই
ভূকৌশলগত বিবেচনায় আফগানিস্তান এমন একটি অঞ্চল, যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলো যুগের পর যুগ প্রচেষ্টা চালিয়েছে। দেশটি থেকে ২০১৪ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী বিদায় নেয়ার কথা ছিল। প্রেসিডেন্ট ওবামা নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও তালেবান উত্থানকে কেন্দ্র করে এ প্রত্যাহার বিলম্বিত করেছেন। ২০১৬ সালে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হওয়ার কথা। ২০১৫ সালে তালেবানদের প্রাদেশিক রাজধানী কুন্দুজ দখলের পর সেনা প্রত্যাহারের পর সরকারের হাতে দেশটির নিয়ন্ত্রণ থাকবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে তালেবানদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর নেতৃত্বে একটি বাহিনীকে স্থলাভিষিক্ত করতে; কিন্তু প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার বিকল্প নেই। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানে ভারতীয় উপস্থিতির ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র আপত্তি রয়েছে। আফগান সরকারের ওপর ভারতের কিছু প্রভাব থাকলেও তালেবানদের ওপর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে পাকিস্তানের। শেষ পর্যন্ত আমেরিকাকে আফগানিস্তানের ব্যাপারে সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ইরানের কিছুটা সংশ্লিষ্টতা রাখা গেলেও ভারতের বড় কোনো ভূমিকা এখানে মার্কিন প্রত্যাহার-উত্তর সরকারে থাকার সম্ভাবনা কম। ২০১৬ সাল হতে পারে এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। গভীর স্বার্থসংশ্লিষ্টতার কারণে আফগান ইস্যুতে পাকিস্তান-চীন-রাশিয়া এক দিকে আর যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অন্য দিকে ভূমিকা রাখতে পারে। ইরান পালন করতে পারে মধ্যবর্তী ভূমিকা।
পাকিস্তান : রাষ্ট্রনীতিতে সেনাপ্রাধান্য বাড়বে
২০১৬ সালে পাকিস্তানের নওয়াজ সরকারের চতুর্থ বছর পার হবে। বাণিজ্যমুখী রাজনীতিবিদ হিসেবে নওয়াজ শরিফ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যখনই পালন করেছেন, তখন ভূরাজনৈতিক বিষয়ের চেয়ে অর্থনৈতিক বিষয়াবলি প্রাধান্য পেয়েছে। এ কারণে তিনি ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে বাড়তি আগ্রহ প্রকাশ করেন; কিন্তু পাকিস্তানের ভেতরে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও গোয়েন্দা এস্টাবলিশমেন্টের যে ডিপ স্টেট বা নিয়ন্ত্রণ শক্তি রয়েছে, তারা অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দিল্লির আদি ডকট্রিনের ব্যাপারে বরাবরই সন্দিহান। নওয়াজ শরিফ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার ব্যাপারে রাজনৈতিক সম্পর্কের অজুহাতে সীমা অতিক্রম করতে চাইলে ডিপ স্টেটের বাধা তৈরি হয়। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা গ্রহণের পর নওয়াজ শরিফ তার শপথ অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানের ‘নিয়ন্ত্রক শক্তি’ পছন্দ করেনি। এরপর ইমরান খান ও ড. তাহিরের আন্দোলনের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করা হয় নওয়াজের ওপর। এবার ভারতের সাথে অফট্র্যাক ও গোপন আলোচনার মাধ্যমে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগের একপর্যায়ে মোদি নওয়াজের বাড়িতে হাজির হন ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ করে। নেপথ্যে কাশ্মির ইস্যু নিষ্পত্তির ব্যাপারে আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতায় একটি উদ্যোগের কথা ছড়িয়ে পড়ে, যে উদ্যোগ অনুসারে কাশ্মিরের বর্তমান নিয়ন্ত্রণরেখাকে চূড়ান্ত সীমানা ধরে নিয়ে এটিকে নিষ্পন্ন করে ফেলা হবে। পাকিস্তান যখনই দুর্বল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে, তখনই দিল্লি এ প্রস্তাবে এই প্রতিবেশীকে সম্মত করানোর চেষ্টা করেছে। ১৯৭৩ সালে সিমলা চুক্তির সময় এ ধরনের একটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল। পারভেজ মোশাররফের ফর্মুলা হিসেবে একই বিষয় আবার সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। পাকিস্তানের মূল নিয়ন্ত্রকেরা কাশ্মিরের মানুষের স্বাধীনতা বা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে এ ধরনের সমঝোতাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য আত্মঘাতী মনে করেন।
আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের ভারতপন্থী অংশটি মনে করে, কাশ্মির সমস্যার নিষ্পত্তি হলে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সরকারপ্রধান মোদি ও নওয়াজকে বেগিন-সাদাতের মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া যাবে। আর কাশ্মির সমস্যার সমাধান হলে পাকিস্তানের সামরিক ও গোয়েন্দা এস্টাবলিশমেন্টের অবয়ব সঙ্কুচিত হবে। এতে রাষ্ট্রটির প্রতিরক্ষা সামর্থ্যও কমে আসবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে পাকিস্তানের আঞ্চলিক প্রভাব কমিয়ে ভারতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রক শক্তি এটি কোনোভাবেই হতে দিতে চায় না। এবার পাঠানকোটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় নতুন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টার ওপর এক দিকে কালো ছায়া বিস্তার করেছে, অন্য দিকে দিল্লি-ইসলামাবাদ সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৬ সালে এই উত্তেজনাকর সম্পর্কই চলতে থাকার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ভারতের সামনে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ
২০১৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সামনে রয়েছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। এক দিকে বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভায় বিপর্যয়কর ফলাফল আর সংস্কার কর্মসূচিতে বাধা প্রদান, অন্য দিকে রয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোয় ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রায়ই হুমকির মধ্যে পড়া। নেপালে মাধেসিদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থার সাথে ভারত জড়িয়ে পড়ায় চীন নেপালের সাথে কৌশলগত গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে নিজের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়ায় যেকোনো সময় সার্বিক অবস্থা উল্টোমুখী হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষত আইএসের সন্ত্রাসী তৎপরতার আওতা যেভাবে এখানে বাড়ছে, তা উদ্বেগ সৃষ্টি করছে মোদি প্রশাসনের সামনে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ককে যেভাবে মোদি এগিয়ে নিতে চাইছেন, সেভাবে ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। পাঠানকোটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে জঙ্গি হামলা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশের সহায়তায় সাত রাজ্যে বিদ্রোহ তৎপরতাকে শান্তি আলোচনায় রূপান্তরিত করার ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা সাফল্য এলেও বিদ্রোহীদের মূলধারাকে এর মধ্যে আনা যায়নি। আসামের বিদ্রোহীদের ওপর বিচ্ছিন্নতাবাদী পরেশ বড়–য়ার কর্তৃত্ব জোরদার হচ্ছে। এতে চীনের পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে দিল্লির ওপর মহলে। এর পাশাপাশি নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে পাঞ্জাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী নানা তৎপরতা নিয়ে। এর বাইরে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ মোদির সামনে বিজেপির জনসমর্থনে ভাটির টান নিয়ে। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিগত নির্বাচনে জনসমর্থনের জোয়ার আনতে পেরেছিলেন, সে তৎপরতাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ব কর্মসূচির ব্যাপকতা। সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা এতে এক দিকে বাড়ছে, অন্য দিকে বিজেপির পাল্টা শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মেরুকরণ সৃষ্টি হচ্ছে। দিল্লি বিধানসভার পর বিহার রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির বিপর্যয় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে এক মঞ্চে আসতে উৎসাহিত করছে। সামনের রাজ্য বিধানসভার যে নির্বাচন রয়েছে তার মধ্যে আসাম ছাড়া আর কোনো রাজ্যেই ২০১৬ সালে বিজেপি সাফল্য পাবে বলে মনে হচ্ছে না।
বিজেপির সামনে এগোনোর বাহন হওয়ার কথা ছিল অর্থনীতি। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ প্রচারণা চালানো হচ্ছিল শাসক শিবির থেকে; কিন্তু ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি চীন দশককাল ধরেই অর্জন করে এসেছে। মোদি এখন জাপানি বিনিয়োগ, চীনের নেতৃত্বাধীন ব্রিকস ব্যাংক ও এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তা এবং আমেরিকার সাথে প্রতিরক্ষা শিল্পের সহযোগিতা চুক্তির কল্যাণে এক ধরনের চাঙ্গা অবস্থা সৃষ্টি করতে পারবেন শিল্পায়নে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও মোদি সাফল্য পাবেন। কিন্তু এ জন্য তিনি রাজ্য-কেন্দ্র নির্বিশেষে অভিন্ন করহার সৃষ্টিসহ যে সংস্কার আনতে চাইছেন, তাতে সফল হবেন কি না নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থতা এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশ : জঙ্গি অস্থিরতার শঙ্কা
২০১৬ সাল বাংলাদেশের জন্য একটি অস্থিরতাপূর্ণ ও ঘটনাবহুল বছর হতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক। যারা ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে দেখছেন তারা মনে করেন, ২০১৬ সালে এখানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেবে। জামায়াতকে স্বনামে বা ভিন্ন নামে অথবা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করতে দেয়া হবে। এ নির্বাচনের ফলাফলে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ থাকতে পারে। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ এককভাবে অথবা একটি সেকুলার-জাতীয় সরকারের অংশ হিসেবে ক্ষমতায় থাকতে পারে। বিএনপি উল্লেখযোগ্য আসন নিয়ে বিরোধী দলে থাকতে পারে। অথবা নির্বাচনে সৃষ্ট জোয়ারে নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা সফল না হলে সরকারও গঠন করতে পারে কিংবা হতে পারে জাতীয় সরকারের অংশীদার। এ নির্বাচনের আগে এ সরকার ক্ষমতায় থাকতেই মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালতের একটি পর্যায়ের সমাপ্তি টানা হবে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে প্রভাবশালী বৈশ্বিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক ক্ষমতাধর ভারত। চীনের থাকতে পারে দুর্বোধ্য এক বাণিজ্য স্বার্থকেন্দ্রিক ভূমিকা। অন্য দিকে যারা এতটা আশাবাদী নন, তারা বাংলাদেশে চরমপন্থী সঙ্ঘাতের সমূহ শঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন। গ্লোবাল রিসার্চ অনলাইন সাময়িকীতে খ্যাতিমান বিশ্লেষক অ্যান্ড্রো কোরিবকো (Androw korybiko) তেমন একটি দৃশ্যপট এঁকেছেন। তিনি ‘২০১৫ ট্রেন্ডস অ্যান্ড জিওপলিটিক্যাল ফোরকাস্ট’ শিরোনামে বিশ্বপরিস্থিতির গতিধারা দীর্ঘ বিশ্লেষণে বাংলাদেশ অংশের শিরোনাম দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ টার্নিং ইনটু বাংলা-দায়েশ’। এতে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ স্বল্পতম সময়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সামনের কাতারের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আইসিস পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ মুসলিম দেশটির ১৫ কোটি মানুষের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করতে পারে। ‘ছোট আকারের’ সন্ত্রাসী ঘটনা দিয়েও এখানে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে আইসিস। যদিও আইসিসের উগ্রপন্থার প্রতি আকর্ষণবোধ করার মতো মানুষ এখানে এক শতাংশও পাওয়া যাবে না; কিন্তু বাংলাদেশে ইসলামিস্টদের ওপর নানা ধরনের দমনপীড়ন, মিয়ানমারের বাংলাভাষী রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার অস্বীকার করা, আসামে বাংলাভাষী মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার হওয়া ইত্যাদি আইএসের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে।
বাংলাদেশ সরকারের সামনে এ ধরনের একটি ঝুঁকির ব্যাপারে গোয়েন্দা তথ্য থাকতে পারে। হয়তো বা এ কারণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে ভারত-রাশিয়া বলয় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করার পরও আমেরিকার পরামর্শে বাংলাদেশ সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা কেটে যেতে পারে। ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে আমেরিকার সহায়তাও পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু এতে বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ঝুঁকিও রয়েছে চীন, রাশিয়া- এমনকি ভারতেরও। এ বিষয়টির প্রভাব ২০১৬ সালের বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে পড়তে পারে।
নেপাল : চীন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধের ক্ষেত্র
২০১৫ সালে গণপরিষদের সংবিধান গ্রহণ এবং কমিউনিস্ট পার্টি ও মাওবাদী জোটের সরকার গঠন আর ভারতের সমর্থন নিয়ে নতুন সংবিধানের বিরুদ্ধে তরাই অঞ্চলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালিদের আন্দোলনে হিমালয়ান দেশটিতে ঘটনাবহুল ও তাৎপর্যপূর্ণ এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে চীনের সাথে মহাসড়ক যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে নেপাল। অবরোধের কারণে নেপালের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ভারতবিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। এর জের ধরে নেপালের সাথে ভারত ও চীনের সম্পর্কের মাত্রা পুনর্নির্ধারণের একটি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে নেপাল ভারতের সাথে সম্পাদিত ১৯৫১ সালের মৈত্রী চুক্তি বাতিল করতে পারে অথবা অনুরূপ একটি মৈত্রী চুক্তি চীনের সাথেও স্বাক্ষর করতে পারে।
অন্য দিকে, ভারতীয়রা নেপালের সার্বিক পরিস্থিতির ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হলে দেশটির সরকার মাধেসিদের দাবি মেনে নিতে পারে। এটি করা হলে অন্যান্য জাতিতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোও একই দাবি নিয়ে মাঠে হাজির হতে পারে। ভারতের সাথে সম্পর্কের অধিক অবনতি ঘটলে তরাই অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা শুরু হতে পারে। ভারত এতে প্রত্যক্ষ ইন্ধন জোগালে বিষয়টি বড় রকমের আঞ্চলিক অস্থিরতা ও স্নায়ুযুদ্ধের কারণ হতে পারে। এ কারণে ২০১৬ সাল নেপালের জন্য হতে পারে অস্থিরতার বছর।
শ্রীলঙ্কা : ভারসাম্য নীতি অনুসৃত হবে
চীনপন্থী রাজাপাকসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর সিরিসেনার সরকারের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার নীতির আমূল পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল; কিন্তু চীনের বিপুল বিনিয়োগ ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি এবং সার্বিক বিবেচনায় সিরিসেনা সে ধরনের বিপ্লবী পরিবর্তন থেকে সরে এসে ভারসাম্য নীতি অনুসরণ করতে থাকেন। তিনি নিজে ভারত সফরের পর চীন সফরেও গেছেন। রাজাপাকসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি। তবে তিনি এখনো শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একজন নির্ণায়ক বলে প্রমাণ রেখেছেন। শ্রীলঙ্কার পরবর্তী নির্বাচনের আগে ভুলগুলো শুধরে নিতে পারলে রাজাপাকসে ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনী সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে ভূমিকা রাখছে তা আগামীতেও দেশটিকে একতরফা নীতি অনুসরণ থেকে সরিয়ে রাখতে পারে।
দুই ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপ ও ভুটান
দক্ষিণ এশিয়ার দুই ক্ষুদ্র দেশ মালদ্বীপ আর ভুটানও এখন আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক প্রভাবশালীদের দৃষ্টির বাইরে নয়। মালদ্বীপের রাজনৈতিক অস্থিরতা কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত মুহাম্মদ নাশিদ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর অনেকটাই ছিটকে পড়েছেন। নানা মামলা ও হয়রানির মুখে তিনি কোনোভাবেই রাজনীতির নিয়ন্ত্রকের আসনে বসতে পারছেন না। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়ামিন গাইয়ুমকে হত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য তার সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার ও বিচারের সম্মুখীন করা হচ্ছে। বিশ্বের আবহাওয়াগত বিবেচনায় সবচেয়ে ভঙ্গুর হিসেবে পরিচিত এই দ্বীপমালার দেশটি ভূকৌশলগত কারণে ক্ষমতাধরদের প্রভাব বিস্তার প্রতিযোগিতার শিকার। এ কারণে এটি যেকোনো সময় অস্থিরতার মধ্যে পড়তে পারে। এর মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা হলো, মালদ্বীপের সৌদি জোটে যোগদান।
ভুটানের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ পরোক্ষভাবে ভারতের কাছে। দেশটির পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় দিল্লির প্রভাবে। বড় বড় প্রশাসনিক, বিশেষজ্ঞ ও টেকনিক্যাল পদগুলোতে বসে আছেন ভারতীয়রা। নরেন্দ্র মোদি তার প্রথম বিদেশ সফরের জন্য এই ভুটানকেই বেছে নিয়েছিলেন। ভুটানের আরেক প্রতিবেশী চীন সহায়তার হাত বাড়িয়েছে দেশটির প্রতি এবং বিভিন্ন প্রকল্পে বিপুল বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ফলে এ শান্তির ক্ষুদ্র দেশটিতেও শুরু হয়েছে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের মধ্যে।
সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়া ক্রমেই দু’টি আন্তর্জাতিক বলয়ের প্রভাবের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার মতো দু-একটি দেশ একধরনের ভারসাম্য বজায় রাখতে চাইছে। বাংলাদেশের শেখ হাসিনাও চীন-রাশিয়াকে আস্থায় রেখে ভারত-আমেরিকার এজেন্ডা পূরণে মনোযোগী রয়েছেন, যার জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা তিনি পার হতে পেরেছেন। এখানে প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ের পক্ষগুলোর মধ্যে স্বার্থের সঙ্ঘাত যেমন রয়েছে, তেমনি আবার নির্ভরতাও রয়েছে। মহাসড়ক, রেল ও পাইপলাইন সংযোগের অর্থনৈতিক স্বার্থ অনেক সময় সঙ্ঘাতকে জয় করে সহযোগিতার বন্ধন তৈরি করে। অস্থির সম্ভাবনার মধ্যেও এটিই হলো দক্ষিণ এশিয়ার সামনে আশার আলো।
mrkmmb@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.