ক্ষমতার ছায়ায় ‘রাজনীতির দোকান’ by উৎপল রায়

নিবন্ধন, গঠনতন্ত্র ও কার্যালয় কিছুই নেই। কেন্দ্রীয়ভাবেও নেই কোনো স্বীকৃতি। সংগঠনের নেতাকর্মীও হাতেগোনা। দাবি, তারা আওয়ামী লীগের অঙ্গ বা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। দলের জন্য তারা কাজ করেন। বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন। এসব সংগঠনের নেতাকর্মীদের দাবি, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং সরকারের উন্নয়নের সহযোগী। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব সংগঠনের নামে সুবিধা আদায়ই তাদের প্রধান লক্ষ্য। ‘শিশু লীগ’, ‘আওয়ামী বাস্তুহারা পরিষদ’, ‘দর্জি লীগ’, ‘বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ’ এমন সব নামের ভুঁইফোড় সংগঠনের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে।
২০০৯ সালে প্রথম মেয়াদে সরকার গঠনের পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নামে বেনামে অসংখ্য সংগঠন গড়ে উঠেছে। দলের কেন্দ্রীয় ও দায়িত্বশীল এ সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, দল যেহেতু ক্ষমতায়, তাই এসব সংগঠন রাজনীতির দোকান খুলে বসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ, স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান শেখ রাসেলের নাম ভাঙিয়ে চলছে এসব সংগঠন। দাপটের সঙ্গে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠা নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের কার্যালয় দূরের কথা, এদের কোনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি পর্যন্ত নেই। অনেক সংগঠন তাদের ঠিকানা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দাবি করলেও সেখানে তাদের কোনো অফিস বা দপ্তরও নেই। আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল ও রাজনীতি সচেতন কয়েকজন কেন্দ্রীয়  নেতা মনে করেন, এসব ভুঁইফোড় ও নামসর্বস্ব সংগঠন দলের নাম ভাঙিয়ে ‘আগাছা’ ‘পরগাছা’ হয়ে ‘স্বার্থ হাসিলের দোকান’ খুলে বসেছে। সূত্র জানিয়েছে, প্যাডসর্বস্ব এসব সংগঠনের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য, তদবিরসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া সংগঠনের নেতৃত্ব কর্তৃত্ব নিয়েও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়াচ্ছেন তারা।
অতি পরিচিত একটি সংগঠন বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট। এই সংগঠনটিতে পরিচিত মুখ অনেকে সময়ে সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি এ সংগঠনের সভাপতি টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম মামলা করেছেন তার সই জাল করে প্রতারণার। অভিযোগ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অরুণ সরকার রানার বিরুদ্ধে। রানা যদিও অভিযোগ করেছেন, তার স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে একই প্যাডে। সই জাল করে সংগঠনের নামে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ করে তারানা হালিমের পক্ষে মামলাটি দায়ের করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর পর্যায়ের বেশ কজন প্রভাবশালী নেতা, সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী নামসর্বস্ব এসব সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এমনকি সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তারা নিয়মিত অংশ নেন।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যুবলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও যুব মহিলা লীগ দলের সহযোগী সংগঠন। এছাড়া ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদকে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ আরও কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠনও আওয়ামী লীগের নামে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, ১৫ই আগস্ট শাহাদাৎবার্ষিকী, শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জন্মদিবসসহ জাতীয় নানা দিবসের কর্মসূচি পালন করে। এসব সংগঠনের পাশাপাশি নতুন গজিয়ে ওঠা সংগঠনও দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালনে সক্রিয় থাকে। নতুন করে উদ্ভব হয়েছে ‘শিশু লীগ’, ‘আওয়ামী দর্জি লীগ’, ‘আওয়ামী চালক লীগ’ ‘আওয়ামী সমবায় লীগ’সহ আরও কিছু সংগঠন। এছাড়া নামে বেনামে চলছে নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, জননেত্রী পরিষদ, আওয়ামী ওলামা লীগ, আওয়ামী বাস্তুহারা লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, ডিজিটাল বাংলাদেশ ফোরাম, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, জনতার মঞ্চ, জনতার প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী রিকশাচালক মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, বঙ্গবন্ধু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, আমরা মুজিব সেনা, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, জননেত্রী পরিষদ, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক পরিষদ, স্বাধীনতা পল্লী চিকিৎসক পরিষদসহ অসংখ্য নামসর্বস্ব সংগঠন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে এছাড়া ওলামা লীগ, বঙ্গবন্ধু মঞ্চ, বাংলাদেশ হকার্স লীগসহ ২২টি সংগঠনের একটি জোট (সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক জোট) ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ আহূত বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগর আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুল হক সবুজ এই জোটের চেয়ারম্যান হয়ে জোটের নেতাকর্মী ও সংগঠনের দেখ-ভাল করতেন। কিন্তু ব্যাপক সমালোচনার মুখে তিনি সম্মিলিত আওয়ামী সমর্থক জোটের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। বর্তমানে নিয়াজ মোহাম্মদ খান নামে আওয়ামী লীগের একজন নেতা এই নামসর্বস্ব জোটের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. নূহ-উল-আলম লেনিন মানবজমিনকে বলেন, দল ক্ষমতায় থাকলে যা হয় সংগঠনের নামে তা-ই হচ্ছে। এরা রাজনীতির নামে রাজনীতির দোকান খুলে বসেছে। কেন্দ্রীয় ও মহানগর আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও এসব সংগঠনের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা বিবৃতি দেয়। মনগড়া নানা কথা বলে। আমরা এসব পাত্তা দিই না। আমার ধারণা, বিএনপি-জামায়াতের লোকজনও এসব সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, নামসর্বস্ব সংগঠনের অনেকেই কর্মসূচির নামে চাঁদাবাজি করে এরকমও শুনেছি। কিন্তু এসব তৃতীয় ও চচুর্থ শ্রেণির সংগঠনের বিষয়ে আমরা ভাবি না। আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক আলাপকালে বলেন, কেন্দ্রীয় ও মহানগর আওয়ামী লীগের কিছু নেতা এবং বর্তমান ও  সাবেক কিছু মন্ত্রী মিডিয়া কভারেজ পাওয়ার জন্য ভুঁইফোড় বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠানে যান। তারা তাদের মতো করেই সেখানে বক্তব্য বিবৃতি দেন। তবে, এসব সংগঠনের কোনো রাজনৈতিক স্বীকৃতি ও সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। তারা আওয়ামী লীগেরও কেউ নয়। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা ক্ষোভের সঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, এসব সংগঠনের কোনো দোষ নেই। কেন্দ্রীয়  ও মহানগরের শীর্ষ নেতারাই এদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন। এদের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও নিয়মিত অংশ নিচ্ছেন। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের বিপক্ষে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বললে যে কোনোভাবেই বলা যায়। এসব নামসর্বস্ব সংগঠনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে কথা বলার কোনো যুক্তি দেখি না।
মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ নামের একটি সংগঠনের সভাপতি ফাতেমা জলিল সাথী বলেন, আরও চারজন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের ব্যানারে কর্মসূচি পালন করলেও তার পরিচালিত সংগঠনটিই আসল। আলাপকালে তিনি জানান, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা তার পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আর একই নামে অন্য চারটি সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করছেন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী। গত কয়েক বছর ধরে আওয়ামী শিশু লীগের ব্যানারে একটি সংগঠনের কিছু শিশু কিশোরকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সভা, সমাবেশ ও মানববন্ধনে অংশ নিতে দেখা গেছে। এছাড়া একই সংগঠনের নামে মাঝে মাঝে ব্যানার ও প্যানাফ্লেক্সও শোভা পায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ছবি। ব্যানারে লেখা থাকে ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যত’। খোঁজ নিয়ে  জানা গেছে, ২০১২ সালে ‘শিশু লীগ’ নামে এ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বেশ কিছুদিন সক্রিয় থাকলেও বিগত কয়েক মাস ধরে শিশু লীগের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা রাজধানীর ডেমরা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ মুন্সী। মানবজমিনকে তিনি বলেন, আমি একটি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীদের একত্র করে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের পড়ালেখাসহ তাদের যাবতীয় বিষয় দেখভাল করার। কিন্তু অনেকেই বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। তাই কয়েক মাস ধরে শিশু লীগের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে তা আবার চালু হবে কিনা তা বলতে পারছি না। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ব্যানার ফেস্টুন ও দলীয় কর্মসূচিতে শিশুদের নিয়ে অংশগ্রহণের বিষয়টি অস্বীকার করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.