জাপানের কাছ থেকে পাকিস্তানকে শিক্ষা নিতে হবে by আইরিন খান

গত ২৮ ডিসেম্বর (২০১৫) জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে এমন একটি চুক্তি হয়েছে, যা দেশ দুটির মধ্যে চলমান ৭০ বছরের পুরোনো বিরোধ ও বৈরিতা দূর করার পথ খুলে দিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান কোরীয় মেয়েদের যৌনদাস হিসেবে ব্যবহার করে, ‘কমফোর্ট ওমেন’ হিসেবেই যারা পরিচিত। দক্ষিণ কোরিয়ার সব সময়েই চাওয়া ছিল যে জাপান এই অপরাধের জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে ক্ষতিপূরণ দিক। নতুন এই চুক্তির ফলে ৭০ বছর পর দক্ষিণ কোরিয়ার চাওয়া পূরণ হতে যাচ্ছে। জাপানের প্রেসিডেন্ট শিনজো আবে দেশটির ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ ও এক বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৮ দশমিক ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার মিত্র এ দুই দেশের সহজ ও আন্তরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এ ঘটনা দীর্ঘ সময় ধরে এক বাধা হিসেবে কাজ করছিল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কোরীয় মেয়েকে জাপান কমফোর্ট ওমেন হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করে। ৭০ বছর পর এসব অপকর্মের জন্য জাপানের ক্ষমা চাওয়ার মতো দৃষ্টান্তমূলক ঘটনার পেছনে অবশ্য মানবিক কারণের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনা। পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার এ দুই মিত্র দেশগুলোর মধ্যে সুসম্পর্ক ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য খুবই দরকারি হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, অন্যদিকে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী উত্তর কোরিয়াকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাষ্ট্রগুলোর এক হওয়ার এবং একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক জোট তৈরির কোনো বিকল্প নেই। বারাক ওবামার মধ্যস্থতায় দেশ দুটি তাদের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের নয় মাসে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর হামলায় ও বর্বরতায় ৩০ লাখ মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি দুই থেকে চার লাখ নারী সম্ভ্রমহানি ও নির্যাতনের শিকার হন। (Saikia, Yasmin (2011)।(Sharlach, Lisa (2000)। ‘Rape as Genocide: Bangladesh, the Former Yugoslavia, and Rwanda’. New Political Science 1 (22): 89। P.94.)। দেশকে মেধাশূন্য করার জন্য, জাতিকে দুর্বল করার লক্ষ্যে পাকিস্তানি বাহিনী আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সহায়তায় পরিকল্পিতভাবে তালিকা তৈরি করে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম গণহত্যা ঘটিয়েছে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার একদম আগে শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, লেখক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, প্রকৌশলী, শিল্পীসহ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। ১৯৭২ সালের প্রথম তিন মাসে ৩০ হাজার যুদ্ধশিশু জন্মগ্রহণ করে। ভ্রূণ হত্যার ঘটনা ঘটেছে হাজার হাজার। পরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতির মনোবল ধ্বংস করা, বাঙালি নারীদের গর্ভে পূর্ববঙ্গে এক পাকিস্তানি প্রজন্ম তৈরি করা ছিল এই জঘন্যতম অপরাধের পেছনের রাজনীতি। যুদ্ধ শেষে এমন জঘন্য অপরাধের জন্য পাকিস্তান সরকার ন্যূনতম অনুশোচনা প্রকাশ করেনি; বরং তারা বাঙালি জাতির মনোবল বিনষ্ট করতে এই অপরাধকে ন্যায্য বলে মনে করেছে।
বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মহল থেকে এ ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা প্রার্থনা করার দাবি উঠলেও পাকিস্তান সরকার বরাবরই এসব বিষয়ে চুপ থেকেছে। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। এই সম্পর্কের ভাটা দীর্ঘ হয় যখন বাংলাদেশ তার মাটিতে যুদ্ধকালীন গণহত্যা ও নির্যাতনের মতো অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন। এ রায়কে ‘জুডিশিয়াল মার্ডার’ বা বিচার বিভাগীয় হত্যা বলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর এই প্রথম দুই দেশের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন হয়ে ওঠে। তেহরিকে তালিবান পাকিস্তান দল ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রমণের হুমকি দেয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সেখানকার জাতীয় পরিষদে নেওয়া প্রস্তাবের কঠোর নিন্দা করে প্রতিবাদলিপি তুলে দেওয়া হয়।
দুই দেশের সম্পর্কটা আরও খারাপ হয়, যখন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তারে পাকিস্তান দূতাবাসের যুক্ততার ঘটনা প্রকাশ পায়। গত বছরের (২০১৫) ৩১ জানুয়ারি ভারতীয় মুদ্রা চোরাচালান এবং বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রপন্থা প্রশ্রয়ে হিযবুত তাহ্রীর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও জামায়াতে ইসলামীকে অর্থায়নের দায়ে পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মচারী মাজহার খানকে ঢাকা ত্যাগ করতে বলা হয়। পরে একই অভিযোগে পাকিস্তান দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব ফারিনা আরশাদকেও তাঁর দেশে ফেরত পাঠানো হয়। গ্রেপ্তারকৃত ধর্মীয় উগ্রবাদীদের জবানবন্দি থেকে আরশাদের জঙ্গিবাদ প্রশ্রয়ে সম্পৃক্ততার কথা জানা যায়। গোয়েন্দা বিভাগের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ২৯ নভেম্বর (২০১৫) গ্রেপ্তারকৃত জেএমবির সদস্য ইদ্রিস শেখ ফারিনা আরশাদের গাড়িতে করে বায়তুল মোকাররম থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত যান এবং ৩০ হাজার টাকা পান। পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন কর্মচারীকে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে কোনো জোর প্রতিবাদ জানানো হয়নি। এ ঘটনার কিছুদিন পরে পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় সচিবকে প্রত্যাহার করে নিতে বলা হয় কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার দুটি উল্লেখযোগ্য ও ভূ–রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এখানে একাধারে চীন ও ভারতের মতো দুটি আঞ্চলিক শক্তির অবস্থান রয়েছে এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও এ দুটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ অঞ্চলে একদিকে যেমন ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থানে চরম বিপদ রয়েছে, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা। বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে জোরালো অবস্থান নিয়েছে, তখন পাশের কোনো দেশের জঙ্গিবাদে মদদ দেওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের জন্য সত্যিই বড় উদ্বেগের কারণ। এ দেশে জঙ্গিবাদে মদদ দেবে এমন কোনো দেশের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য খুবই কঠিন ব্যাপার। এ বিষয়টি পাকিস্তানকে বুঝতে হবে। জঙ্গিবাদ যে নিজ দেশের জন্য এক বড় অভিশাপ হয়ে দঁাড়িয়েছে, তা পাকিস্তান আজ অস্বীকার করতে পারবে না। জঙ্গিবাদ মোকাবিলা এবং দেশকে এই বিপদ থেকে মুক্ত রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় এবং এর জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও পরস্পরের নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলতে কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যকার ৫০ বছরের বৈরী সম্পর্কের বরফ ২০১৫ সালে এসে গলা শুরু করেছে। পুরো বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। পাকিস্তান ও ভারতের শত্রুতা দীর্ঘদিনের পুরোনো। চারটি যুদ্ধসহ নানা বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতিতে এ দুটি দেশে নিজেদের মধ্যকার শত্রুতা অব্যাহত রয়েছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। এখন ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। এরপরও দেশ দুটি কূটনৈতিক ও পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অতীতকে পেছনে রেখে সামনে এগিয়ে চলাই রাজনীতির মূলমন্ত্র। বাংলাদেশ উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে, আমরা সামনে এগিয়ে চলার কথা বলি, তবে তা অতীতকে ভুলে গিয়ে নয়, বরং ইতিহাসকে সঙ্গে নিয়ে। বাংলাদেশের জন্ম ও স্বাধীনতার সঙ্গে লাখো শহীদের রক্ত ও আত্মত্যাগ মিশে রয়েছে। এ দেশের মানুষ একাত্তরে ঘটে যাওয়া বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ এবং নানা অপরাধের বিচার ও অপরাধীর শাস্তি চায়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষদের ওপর ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞ ও অপমানের বিচার নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এর সব দায় পাকিস্তানকে নিতেই হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভবিষ্যতে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পাকিস্তানকে অবশ্যই ’৭১-এ ঘটে যাওয়া এই জঘন্য অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। কোরীয় জনগণের কাছে জাপানের সাম্প্রতিক ক্ষমাপ্রার্থনা ও ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দৃষ্টান্ত থেকে পাকিস্তানের শিক্ষা নেওয়া দরকার।
আইরিন খান: গবেষক। প্রতিষ্ঠাতা আইক্যান ফাউন্ডেশন।
khan.ayreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.