নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার আহ্বান বিশিষ্টজনদের

দেশের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, গণতন্ত্র আর নির্বাচন নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক না কেন নির্বাচনের সঠিক পদ্ধতি বের করা উচিত। এজন্য প্রয়োজন সবাইকে নিয়ে আলোচনার। নির্বাচনের পদ্ধতির পথ বাতলে দিয়েছেন কেউ কেউ। তারা বলেন, উচ্চ কক্ষের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন দেয়ার। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার দূরদর্শী মানুষদের উচ্চকক্ষে আনতে হবে। যারা কোনো ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নন। দেশে এখন ভারসাম্যপূর্ণ গণতন্ত্র নেই বলেও মন্তব্য করেন তারা। বলেন, ভোটারদের ক্ষমতা না দিলে দেশে গণতন্ত্রের নামে এরকম স্বৈরতন্ত্র চলবে। গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে  ‘গণতন্ত্র ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন’ শীর্ষক উন্মুক্ত সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সিএফএসডি)। সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারি জেনারেল মাহফুজ উল্লাহ। আলোচনায় অংশ নেন নানা শ্রেণি ও পেশার ২৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আসম আবদুর রব বলেন, এদেশের মালিক জনগণ-আজকের অবস্থা দেখলে এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। জনগণের ক্ষমতায়ন কি আছে? আমরা দেশে জনগণের ক্ষমতায়ন চাই, বাকস্বাধীনতা চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আগে উন্নয়ন। তার মানে বাকি সব কি নির্বাসনে? জনগণকে ক্রীতদাস বানাতে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি। লুটপাট করতে, ভোটের অধিকার কাড়তে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে যাইনি। মগের মুল্লুক বানানো হয়েছে দেশটাকে। তিনি বলেন, এখন মিছিল, মিটিং করতে দেয়া হয় না। অথচ মিছিলের কারণেই আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে। সমালোচনা করতে দেবেন না, কথা বলতে দেবেন না, তাহলে ক্ষমতায় থাকবেন কি করে? আ স ম রব বলেন, দেশে এখন দ্বি-দলীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে জনগণের ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। এ কারণে মানুষ কারও প্রতি আস্থাশীল নয়। কর্মীরা যদি দলের নেতাদের নিয়ে সন্দিহান হন তাহলে সে দল আন্দোলন করতে পারে না। রাজনৈতিক দলের কারণেই আজ গণতন্ত্র ভারসাম্যহীন অবস্থায় রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন আর কেউ মানে না মন্তব্য করে তিনি উচ্চ কক্ষের হাতে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের পরামর্শ দেন।
নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর বলেন, গণতন্ত্রের অর্থ কেবল নির্বাচন নয়। এটা একটি উপাদান মাত্র। এক্ষেত্রে নির্বাচনের পদ্ধতি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, দেশে বিভিন্ন সেক্টরে পদোন্নতি নিয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে নিচের দিকে কাজ করার লোক পাওয়া যায় না। বেতন বৃদ্ধি আর পদোন্নতি দিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে অনেকের টেবিল-চেয়ারও নেই। সরকারের মধ্যে জনভীতি থাকলে এভাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা হয়। তিনি বলেন, সমাজের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার বাইরে থাকা অপরাধের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে। অন্যায় আচরণ করে, নিজেদের কথাকে আইন হিসেবে বাস্তবায়ন করতে চায়। ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর এ অবস্থায় দায়িত্ব থাকে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে এগিয়ে নেয়ার। বাংলাদেশে এরকম দল বিএনপি। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে সরকার তার অপকর্মের কারণে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ৩০ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। সরকারের পাওয়ার করিডরে হাঁটাহাঁটি করেন না এমন ব্যক্তি ছাড়া এ টাকা আয় করা তো দূরের কথা পাচার করাও সম্ভব নয়।
সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, সকল দল মতকে উপলব্ধি করতে হবে গণতন্ত্র কখনও চাপা দেয়া যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব দেশে গণতন্ত্র উদ্ধার করতে হবে। সবাই নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে প্রচার করে। আসলেই কি তাই? মানুষ আজ বিকল্পর ওপরও নির্ভর করতে পারছে না। তিনি বলেন, সত্যিকার স্বপ্ন নিয়ে যদি মানুষকে রাস্তায় নামানো যায় তাহলে কোনো শক্তি তা ঠেকাতে পারবে না।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, এক দল মনে করেন ৭১-এর আগে কোনো ইতিহাস ছিল না। আর এক দল মনে করেন ৭৫-এর পর কোনো ইতিহাস ছিল না। ক্ষমতাসীনদের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন না তারা অমুক্তিযোদ্ধা। তারা দেশেই থাকার অধিকার রাখে না। আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন রাস্তায় নামতে পারি না। নামলেই গুলি। এক ওসি আমাকে বলেছেন, আমাদের গুলির হিসাব দিতে হয় না। পৌরসভা নির্বাচনের নানা চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে তো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
বিএনপির সাবেক নেতা শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন শুধু জাতীয় পর্যায়ে চিন্তা করলে চলবে না দলের ভেতরেও করতে হবে। জাতীয় রাজনীতি করতে দু’দলের ভেতরে কতটা গণতান্ত্রিক অবস্থা আছে বা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্বাস করে তা বড় প্রশ্ন। এ অবস্থায় তারা যদি গণতন্ত্রের কথা বলে তাহলে কিভাবে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদের কোনো স্থান নেই। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, নীতি ও আদর্শের দিক থেকে বড় দুই দলের মধ্যে বড়দাগে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। আজকাল তো গণতন্ত্রের জন্য ভোটেরও দরকার হয় না। ভোটের অধিকার আদায় করতে আন্দোলনের প্রয়োজন কি-না তা তাত্ত্বিক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এরশাদ বিদায় নিয়েছেন তবে তার প্রেতাত্মা এখনও আছে। নারীকে পুরুষ আর পুরুষকে নারী বানানো ছাড়া সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়েছে। অর্থনীতি আজ পুরো লুটপাটে পরিণত হয়েছে। বড় দুই দলের কাছে গণতন্ত্র মানে ক্ষমতা বা গদির পরিবর্তন। সেটা যে কোনো প্রক্রিয়াতে হলেই হলো। ক্ষমতার প্রত্যাশী বিএনপি সেই রাজনীতিই করছে। মানুষের রাজনীতি করছে না। যে কারণে আন্দোলন করতে গিয়ে তারা বারবার একা হয়ে যাচ্ছে।
বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ভোট দিয়ে জনগণ ক্ষমতার মালিক হয় না। আসলে শাসক দল ভোট নিয়ে ক্ষমতা ব্যবহারের অনুমোদন আদায় করে নেয়। এটাকে কখনো গণতন্ত্র বলা যায় না। দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। পশুকে ছোট দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলে মনে হয় সে বাঁধা। আর লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখলে মনে হতে পারে সে ছাড়া। এখন গণমাধ্যমকে লম্বা দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করা মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়াল, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আহমেদ আজম খান, ইম্প্যাক্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল আমীন, সাবেক কূটনীতিক আব্দুল্লাহ আল হাসান, ব্যারিস্টার সারোয়ার হোসেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ, ব্যারিস্টার পারভেজ আহমেদ, এডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুক্তি, প্রফেসর সুকোমল বড়ুয়া, সুইডেন প্রবাসী মিজান চৌধূরী, এডভোকেট দীপেন দেওয়ান, এডভোকেট ওয়াহিদা, ব্যারিস্টার এজাজ কবির, নারী উদ্যোক্তা মাহমুদা হাবিবা, চিকিৎসা বিজ্ঞানী প্রফেসর মাজহারুল হক ও ড. ফেরদৌসি বেগম। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য রাখেন সাবেক কূটনীতিক ও সিএফএসডি’র প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোসেন।

No comments

Powered by Blogger.