দুই ভাই এবং একটি মোটরসাইকেলের গল্প by তারেক মাহমুদ

ভাই মোখলেছুর রহমানের সঙ্গে মুস্তাফিজ।
বাংলাদেশি এই পেসারের জীবনের গল্পে
ভাই আর মোটরসাইকেল—দুইয়ের ভূমিকাই
খুব গুরুত্বপূর্ণ l ছবি: শামসুল হক
রাত ১২টায় ফোন। পরদিন মুস্তাফিজকে যে করেই হোক ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল বাংলাদেশে এসেছে। তাদের নেটে বল করবে মুস্তাফিজ। হ্যাঁ, মুস্তাফিজ...মুস্তাফিজুর রহমান। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাঁহাতি পেস বোলিং বিস্ময়।
ওই ফোনটা করেছিলেন মুস্তাফিজের একসময়ের কোচ শেখ সালাউদ্দিন। অতটুকু ছেলে অত রাতে এমন ফোন পেয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। সেজো ভাই মোখলেছুর রহমানকে (পল্টু) কথাটা বলতেই অভয় দিলেন, ‘চিন্তা করিস না। আমি নিয়ে যাব।’ পরদিন ছিল হরতাল। তবু দমেননি পল্টু। ভোরে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে মোটর-সাইকেলে করে ছোট ভাইকে নিয়ে আসেন খুলনার চুকনগরে। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে ঢাকা। মুস্তাফিজের সেই প্রথম ঢাকায় বল করতে যাওয়া। তবে ওটাই প্রথম মোটরসাইকেলে চড়া নয়।
ক্রিকেটাররা বড় হয়ে তাঁদের খেলোয়াড় হওয়ার পেছনের গল্পে অনেককেই টানেন। মুস্তাফিজের গল্পে আছে সাতক্ষীরার গণজাগরণ সংঘের কোচ আলতাফ বা আরেক কোচ তপুর কথা। প্রয়াত কোচ সালাউদ্দিনের কথাও ভোলার নয়। তবে এই গল্পে ভাই পল্টু ও একটি বাজাজ ডিসকভারি মোটরসাইকেলও আছে প্রবলভাবে।
এর আগে গল্প আছে আরও। মুস্তাফিজের বয়স তখন ১৪ কি ১৫ বছর। তেঁতুলিয়া গ্রামের মাঠে মাঠে খুব জনপ্রিয় টেনিস বলের ক্রিকেট। বড় ভাই মাহফুজুর রহমান গ্রামীণফোনে চাকরি পেয়ে খুলনায় আসার পর আর না খেললেও মুস্তাফিজসহ বাকি তিন ভাই ছিলেন সেসব টুর্নামেন্টের নিয়মিত মুখ। তাঁদের দলের নাম ছিল রাজাপুর আরপি সংঘ। তো এক ম্যাচে প্রতিপক্ষের এক ব্যাটসম্যানের হাতে তুলোধোনা হচ্ছিল তাঁদের সব বোলার। তাঁকে ফেরানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে অধিনায়ক পল্টু মুস্তাফিজের হাতে বল তুলে দেন। মেজো ভাই জাকির হোসেনের অস্বস্তি হচ্ছিল। অতটুকু ছেলে কি পারবে ঠিকভাবে বল করতে! মুস্তাফিজ পারলেন। প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে প্রথম বল হাতে নিয়েই দেখালেন জাদু।
কাল দুপুরে খুলনার সোনাডাঙা আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কে বড় ভাইয়ের বাসায় বসে পল্টু বলছিলেন, ‘উইকেটকিপারকে সরিয়ে আমি নিজে কিপিংয়ে গিয়ে মুস্তাফিজকে বল দিই। প্রথম দুই বলেই পরাস্ত ব্যাটসম্যান। তৃতীয় বলে বোল্ড এবং ওটা কাটারই ছিল। বলটা ব্যাটসম্যানের পায়ের পেছন দিক দিয়ে ঘুরে এসে স্টাম্পে লাগে। অবশ্য টেনিস বল তো, কাটার এমনিতেই হয়ে যায়।’
ওই একটা বলই বদলে দেয় মুস্তাফিজের জীবন। তাঁকে দিয়ে নিয়মিত বল করানো শুরু হয় তেঁতুলিয়ার টুর্নামেন্টে। দলগুলো অনেক সময় তেঁতুলিয়ার বাইরে থেকেও ভাড়ায় খেলোয়াড় আনত। একজন খেলোয়াড়কে প্রতি ম্যাচ দিতে হতো চার-পাঁচ শ টাকা। ভাইয়েরা চিন্তা করলেন, টাকা দিয়ে বাইরে থেকে খেলোয়াড় না এনে মুস্তাফিজকেই গড়েপিটে নেবেন। কয়েকটি ম্যাচ খেলার পর ছোট ভাইয়ের প্রতিভা আরও স্পষ্টভাবে ধরা দিল তাঁদের কাছে। পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হলো, মুস্তাফিজকে ক্রিকেট বলে অনুশীলন করার সুযোগ করে দিতে হবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। গণজাগরণ সংঘের হয়ে ফুটবল খেলার সুবাদে ওই ক্লাবের ক্রিকেট কোচ আলতাফ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ছিল পল্টুর। তাঁর কাছে মুস্তাফিজকে নিয়ে যেতেই একটা শর্ত দিয়ে দিলেন কোচ-ভালো খেলোয়াড় হতে হলে টেনিস বলের খেলা ছাড়তে হবে। খেলতে হবে শুধু ক্রিকেট বলে। এরপর থেকে মুস্তাফিজ আর টেনিস বলে বল করেননি। তেঁতুলিয়ায় ক্রিকেট বলে অনুশীলন করার জায়গা না থাকায় বাড়ির পেছনেই ম্যাট বিছিয়ে ক্রিকেট বলের উইকেট বানিয়ে দেন ভাইয়েরা। আর পল্টুর কথা শুনে তো মনে হলো, টেনিস বলে বল করাটা এখন পারিবারিকভাবেই নিষিদ্ধ মুস্তাফিজের জন্য, ‘টেনিস বলে অনেক জোর দিয়ে বল করতে হয়। তাতে চোটের সম্ভ্রাবনা থাকে। আমরা চাই না ওর আমাদের দলে খেলার জন্য দেশের ক্ষতি হোক।’
টেনিস বলের মুস্তাফিজ যেদিন থেকে ক্রিকেট বলের মুস্তাফিজ হয়ে গেলেন, সেদিন থেকেই তাঁর ক্যারিয়ারে ঢুকে গেল একটা বাজাজ ডিসকভারি মোটরসাইকেল। মুস্তাফিজদের বাড়ি সাতক্ষীরা থেকে ৪০ কিমি দূরে। এই পথ পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন ভোরে পল্টুর ওই মোটরসাইকেলের পেছনে চড়েই আসতেন গণজাগরণ সংঘের অনুশীলনে। জোরে চালালে ৪৫ মিনিটের মতো সময় লাগত। কিন্তু ছোট ভাইকে পেছনে বসিয়ে অত জোরে বাইক ছোটাতেন না পল্টু। তেঁতুলিয়া-সাতক্ষীরা-তেঁতুলিয়া যাওয়া-আসাতেই তাই সময় লেগে যেত ঘণ্টা দুয়েক। সাতক্ষীরা অনূর্ধ্ব-১৬ দলে ডাক পাওয়ার পরও রুটিন বদলায়নি। ফজরের আজানের পরপরই বের হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যেতেন পল্টু। শুরুর দিকে মুস্তাফিজের ঘুম ভাঙাতে অবশ্য বেশ কষ্টই হতো, ‘ছোট ছিল তো, অত ভোরে ঘুম থেকে উঠতে চাইত না। শীতকালে বেশি কষ্ট হতো। জোর করে তুলে নিয়ে আসতাম। পরে একটা সময়ে অভ্যস্ত হয়ে গেল।’
মুস্তাফিজকে শুধু গণজাগরণ সংঘ আর খুলনার চুকনগরেই পৌঁছে দেয়নি সেই মোটরসাইকেল, এটা এখন সবারই জানা যে, আজকের মুস্তাফিজুর রহমান হওয়ার পথটাকেও সেটা কমিয়ে দিয়েছিল অনেক। হরতাল আর শীতের সকালের মতো বাধা সে পথেও ছিল। তবু গতি হারাননি মুস্তাফিজ, ছন্দ হারায়নি তাঁর বোলিং। ছিপ ফেলেই নাকি পানি থেকে মাছ তুলে আনতে পারেন মুস্তাফিজ। উইকেট পাওয়াটাও এখন পানির মতো সহজ তাঁর কাছে।
সাতক্ষীরায় অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা দলের ক্যাম্প হবে। কোচ আলতাফের পরার্মশে ছোট ভাইকে সেখানে নিয়ে যান পল্টু। প্রথম দিন গিয়ে দেখেন ১৪ জনের দলে ঢুকতে শ তিনেক ক্রিকেটার হাজির। এত ক্রিকেটার দেখে পল্টু কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও মুস্তাফিজকে বুঝতে তা দেননি। তিন শ জন থেকে যে মাত্র ১৪ জন নেবে, সেটাও বলেননি। উল্টো সাহস দিয়েছেন, ‘তোকে যদি একবার বল করতে দেয় তাহলে আর বাদ দিতে পারবে না। দোয়া কর যেন বল না করিয়েই বাদ দিয়ে না দেয়।’
প্রথম কয়েকটা বল এলোমেলো হয়। পল্টু বুঝে ফেললেন, ক্রিকেট বলে বোলিংয়ের অনভ্যস্ততার কারণেই এ রকম হচ্ছে। ভাইকে ডেকে বললেন, ‘এটা তো টেনিস বল না! ক্রিকেট বলে বল আরও ওপর থেকে ছাড়তে হবে। তখন জায়গামতো পড়বে। তুই টেনিস বলে খেলেছিস বলে নিচ থেকে ছাড়ছিস। এভাবে হবে না। ওপর থেকে বল ছাড়। চার-পাঁচটা বল করার পর বলে জোর দিস।’
মুস্তাফিজ সুযোগ পেয়ে গেলেন সাতক্ষীরা অনূর্ধ্ব-১৬ দলে। এরপর তো শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পালা। বাগেরহাটে মেহেরপুরের সঙ্গে প্রথম ম্যাচেই ১০ ওভারে ৬ মেডেনসহ ৯ রান দিয়ে ৩ উইকেট! চুয়াডাঙ্গার বিপক্ষে পরের ম্যাচের আগে বড় ভাইয়ের হয়ে মুস্তাফিজের কাছে পুরস্কারের ‘ঘোষণা’ নিয়ে গেলেন পল্টু, ‘এই ম্যাচেও ৩ উইকেট পেলে তোকে স্পাইক কেডস কিনে দেব।’ প্রথমে বিশ্বাস হয়নি মুস্তাফিজের। কিন্তু ভাইয়ের স্নেহমাখা হাসি কি আর মিথ্যা বলবে! ওই ম্যাচেও ৩ উইকেট নিয়ে একসঙ্গে পেয়ে গেলেন দুই জোড়া স্পাইক কেডস। ছোট একটা বিপত্তি অবশ্য বেধেছিল। ‘খুলনায় ওর পায়ের মাপের কেডসই পাইনি আমরা। পরে সাতক্ষীরার টাউন স্পোটর্স নামে একটা দোকানে গিয়ে বললাম, এই মাপের কেডস এনে দিতে। তারাই পরে ব্যবস্থা করে দিল’-হাসতে হাসতে বলছিলেন পল্টু।
বল হাতে নতুন কিছু করার মন্ত্রও মুস্তাফিজের কানে প্রথম পড়ে দিয়েছিলেন তাঁর ওই সেজো ভাই-ই, ‘বলের গতি ওর শুরু থেকেই ভালো। ন্যাচারাল সুইংও হতো। কিন্তু আমি বলেছিলাম শুধু এগুলো দিয়ে হবে না। নতুন কিছু লাগবে।’ সেই ‘নতুন কিছু’র কিছু উদাহরণও তুলে ধরেছিলেন ছোট ভাইয়ের সামনে, ‘মালিঙ্গা যেমন আস্তে, জোরে দুই রকম ইয়র্কারই দিতে পারতেন। দুটি ঠিক একই জায়গায় গিয়ে পড়ত। ওয়াসিম আকরাম আউটসুইং যেমন দিতেন, আবার রিভার্স সুইংও করাতে পারতেন। তোরও সে রকম একটা কিছু লাগবে।’ এরপর তো জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান এনামুল হকের পরার্মশে আবিষ্কৃত কাটার বিশ্ববিখ্যাতই হয়ে গেল। যেটা ক্রিস গেইল-শহীদ আফ্রিদিদের জন্যও এখনো দুর্বোধ্য। বিপিএলে গেইলের আউটের প্রসঙ্গ তুলতেই চকচক করে উঠল পল্টুর চোখ, ‘আমি শুরু থেকেই বলছিলাম, মুস্তাফিজ গেইলকে চারটা বলও যদি করে গেইল আউট হবে। আগের দিন ফোনেও আমি ওকে বলেছি, গেইলের উইকেট তোকেই নিতে হবে।’ মুস্তাফিজের উত্তর কি ছিল জানেন? ‘সামনে যদি পাই, তাহলে তো নেবই।’
এই আত্মবিশ্বাস, বল হাতে ঠান্ডা মাথার এই ‘খুনি’ স্বভাব মুস্তাফিজের ছোটবেলা থেকেই। স্নায়ুচাপ শব্দটাই যেন তাঁর অজানা! সেটি থাকলই বা। একজন মানুষকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই জানতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। মুস্তাফিজ শুধু পেস বোলিং আর কাটারটাকেই আরও ভালো করে জানুন। ও হ্যাঁ, সেই মোটরসাইকেলটার কথাও ভুলে যাওয়া যাবে না কিন্তু।

No comments

Powered by Blogger.