মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণায় ৯৯ ভাগই ভুয়া অ্যাকাউন্ট by হামিদ বিশ্বাস

ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলার প্রবণতা বেড়েছে। ২০১৪ সালে এক গবেষণায় এ ধরনের প্রায় ৫০০টি প্রতারণার অভিযোগ উঠে আসে। যার বেশির ভাগই পরিচয় গোপন করে বেনামে করা অ্যাকাউন্ট। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট বা বিআইবিএমের ওই গবেষণায় বলা হয়, যেসব মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট দিয়ে প্রতারণা করা হয়, তার প্রায় পুরোটাই হয় ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে। বিআইবিএমের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে তখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি। যদিও বর্তমানে তা অনেক বেড়েছে। সম্প্রতি ‘ইমপেক্ট অব মোবাইল ব্যাংকিং অন ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনার আয়োজন করে বিআইবিএম। এতে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। তাতে এসব তথ্য উঠে আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকগুলোকে জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাবেইজে প্রবেশাধিকার দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যাতে নতুন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের পাশাপাশি পুরনো অ্যাকাউন্টগুলোও পুনরায় যাচাই করা যায়।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, ব্যাংকগুলো অনলাইন ডাটাবেস থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করতে না পারায় এবং অনেক ক্ষেত্রে মোবাইলের সিম ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের কারণে মিথ্যা পরিচয়ে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খোলা সম্ভব হয়। বিটিআরসি এখন সিম যে পুনরায় রেজিস্ট্রেশন করছে, তারপর ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের সিমগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। একই সঙ্গে চাইছি প্রত্যেকটা ব্যাংক যদি জাতীয় পরিচয়পত্রের ডাটাতে প্রবেশাধিকার পায় তাহলে তারা তাদের কাছে রক্ষিত সকল অ্যাকাউন্টই যাচাই করতে পারবেন। তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের ডেটাবেসে প্রবেশাধিকার পেলে বর্তমান মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টগুলোও তারা ব্যাংকগুলোকে পুনরায় যাচাইয়ের নির্দেশ দেয়ার কথা ভাবছি। বর্তমানে সারা দেশে ৫ লাখ এজেন্ট আছে। দিনে লেনদেন ৩৫ লাখ টাকা। বিষয়টি কঠিন। ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে বলে তার ধারণা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেমস বিভাগের (পিএসডি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (নভেম্বর পর্যন্ত), দেশে বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ৩ কোটি ১২ লাখের কিছু বেশি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এর মধ্যে সক্রিয় রয়েছে ১ কোটি ২৫ লাখ ৪৭ হাজার অ্যাকাউন্ট। নভেম্বর মাসের হিসাব থেকে দেখা যায়, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে বর্তমানে দৈনিক লেনদেন হচ্ছে ৪৯৭ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ২৮টি ব্যাংকের অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং করছে ২০টি ব্যাংক। কয়েকটি ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে মোবাইল ব্যাংকিং কেবল বিকশিত হচ্ছে। টাকা পাঠানোর এ মাধ্যমটি সাধারণ মানুষের কাছে খুব সহজ ও ঝামেলামুক্ত। ২০১৪ সালের জুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রিকশাচালক মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠান। মোবাইল ব্যাংকিং বিকশিত হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ নমনীয়।
মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালিত হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গাইডলাইনস অন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ফর দ্য ব্যাংক’ অনুসারে। ওই বিধিতে বলা হয়েছে, মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনা করবেন গ্রাহক নিজে। এজেন্টের কাজ হলো, গ্রাহকের হিসাবে টাকা ভরে দেয়া এবং সে টাকা বের করে দেয়া। কোনো এজেন্ট সরাসরি অন্য এজেন্ট বা গ্রাহককে টাকা পাঠাতে পারেন না। টাকা পাঠানোর কাজটি গ্রাহক নিজেই করবেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থা মানা হচ্ছে না। দেখা গেছে, এজেন্ট একাই শত শত সিম নম্বরে অ্যাকাউন্ট খুলে বসে আছেন। কেউ টাকা পাঠাতে চাইলে তিনি সেসব নম্বর ব্যবহার করে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এতে প্রকৃত প্রেরক ও প্রাপককে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। দেশের প্রচলিত আইনে এটা অপরাধ।
জানা গেছে, টাকা লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে এই মোবাইল ব্যাংকিং যেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছে, তেমনি এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে প্রতারণা, চাঁদাবাজি এবং মুক্তিপণ আদায়েরও ঘটনা ঘটছে।
আবুল হোসেন নামের একজন গ্রাহক সমপ্রতি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগ করেন। বলেন, ‘আমাকে অজ্ঞাত নম্বর থেকে ফোন করে বলে যে আপনার মোবাইলে ১৫০০ টাকা চলে গেছে। আমার স্ত্রীর কাছে পাঠাতে গিয়ে ভুলে চলে গেছে। টাকাটা দয়া করে ফেরত দেবেন? আবুল হোসেন বলেন, আমার নম্বরে কোনো টাকা আসেনি। ওই প্রান্ত থেকে লোকটি বলে, তাহলে আমি বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। মুহূর্তেই বিকাশের একটি এসএমএস আসে। যাতে লেখা টাকা এসেছে। ওই লোক আবার ফোনে বলে ভাই এবার পেয়েছেন। আবুল হোসেন বলেন, হ্যাঁ; এসেছে। তাহলে এবার টাকাটা ফেরত দেন। সরল মনে আবুল হোসেন নিজের পকেট থেকে ওই লোকের কাছে ১৫০০ টাকা পাঠিয়ে দেন। পরে দেখা গেল আবুল হোসেনের নম্বরে কোনো টাকাই আসেনি। কিছুক্ষণ পর থেকে ওই লোকের নম্বর আর খোলা পাওয়া যায়নি। এই ভুক্তভোগী অবশ্য পরে লজ্জা পেয়ে আর পুলিশের কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেননি। যোগাযোগ করা হয়েছে বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলমের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান আলম জানান, ২০১৪ সালে এ ধরনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রায় ৫০০টি অভিযোগ এসেছে। তবে লেনদেনের তুলনায় খুব বেশি নয়। কারণ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বছরে ১০০ কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। তবুও বিয়ষটি কিছুটা চিন্তিত করে। কারণ যথাযথ নিয়ম পরিপালন করা হয় না। যত্রতত্র ন্যাশনাল আইডি কার্ড পাওয়া যায়। এসব বন্ধ হলে দ্রুতই সমাধান হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
একজন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব অভিযোগের ৯৯% ক্ষেত্রেই দেখা গেছে প্রতারণায় ব্যবহৃত মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট তৈরি করা হয়েছিল ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে।
বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তারা মানুষকে ফোন করে, তারপর তারা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের ফলস অ্যাকাউন্টে টাকাটা নেয়ার চেষ্টা করে। একদল সিএনজি বা গাড়ি চুরি করে টাকা পাঠাতে বলে। আবার কিছু টিভিতেও বিজ্ঞাপন দেয়, যে তারা বিভিন্ন তাবিজ দিয়ে মুশকিল আসান করবে। তারপর মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট দিয়ে টাকা নেয়। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সামরিক কর্মকর্তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত এ ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলেও গবেষণায় দেখা গেছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া রেজিস্ট্রেশন ফরম দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ওই ফরম পর্যাপ্ত নয়। তাই অনেকে নিজেদের পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রেশন করছেন। তাই অনিয়ম বাড়ছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, এমনটি হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া এই রেজিস্ট্রেশন ফরম আমাদের আদলে তাদেরই ছাপানোর কথা।

No comments

Powered by Blogger.