খালেদা কেন ইতিহাসকে অস্বীকার করছেন? by সোহরাব হাসান

খালেদা জিয়ার মন্তব্য কেবল আমাদের শহীদ পরিবারগুলোকে অপমান করেনি, গোটা জাতিকেও অসম্মান করেছে। যদিও আমি তাঁর বক্তব্যে মোটেই বিস্মিত হইনি। কেননা আমাদের দেশে ইতিহাস বিকৃতির ধারা চলে আসছে। তবে তাঁর কথায় আমরা বিভ্রান্ত হব না। কারণ সত্যেরই জয় হবে।
—মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে খালেদা জিয়ার দেওয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় শহীদ মুনীর চৌধুরীর সন্তান আসিফ মুনীর
ইতিহাস বিকৃত করতে তাঁরাই মেতে ওঠেন, ইতিহাস নির্মাণে যাঁদের ন্যূনতম ভূমিকা থাকে না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখতে না পারলেও স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারের পতন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ভূমিকার পুরস্কারস্বরূপ জনগণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপির বাঘা বাঘা সব নেতাকে এরশাদ ভাগিয়ে নিলেও একদা গৃহবধূ খালেদা জিয়া সাহস ও কর্মীদের ওপর ভর করে দলকে পুনর্গঠিত করে ক্ষমতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন আরও পাঁচ বছর পর, ১৯৯৬ সালে।
গত আড়াই দশকের রাজনৈতিক সমীকরণে দেখা যায়, স্বৈরাচারী এরশাদের দল জাতীয় পার্টি যেমন শেখ হাসিনার কাঁধে ভর করেছে, তেমনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামী খালেদা জিয়ার ঘাড়ে চেপে বসেছে। তাই দুই নেত্রীর রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে অনেক সময় মূল চরিত্রের চেয়ে পার্শ্বচরিত্রের ভূমিকা প্রাধান্য পেয়ে থাকে। গত সোমবার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত সমাবেশে খালেদা জিয়া ‘আজকে বলা হয় এত লাখ লোক শহীদ হয়েছেন; এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে’ বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা সেই পার্শ্বচরিত্রকে খুশি করার জন্য কি না, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শহীদের সংখ্যা তো কেবল একটি সংখ্যা নয়। এর সঙ্গে সমগ্র জাতির স্পর্ধা ও ভালোবাসা জড়িত। এর সঙ্গে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দেওয়া লাখ লাখ শহীদের স্বজনদের আবেগ ও বেদনা জড়িত। এর সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অহংকার জড়িত। আসিফ মুনীর যে অপমানের কথা বলেছেন, সেটি তাঁর একার নয়। প্রতিটি শহীদ পরিবারের কথা। একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নেত্রী, যিনি তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি কী করে লাখ লাখ শহীদ পরিবারকে অপমান করলেন? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের ওপর খালেদা জিয়ার যত রাগই থাক না কেন, সেই রাগ ঝাড়তে শহীদদের টানতে পারেন না। ‘আজকাল এত লাখ বলা হয়’ বলেও তিনি শহীদদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে পারেন না।
খালেদা জিয়া সেদিনের সমাবেশে আরও অনেক কথা বলেছেন। তিনি পৌরসভা নির্বাচনে সরকারি দলের জোরজবরদস্তির কথা বলেছেন। তিনি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতনের কথা বলেছেন। সরকারের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন। এসব অভিযোগের সবটাই ভিত্তিহীন তা-ও বলব না। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ পদ্মা সেতু করতে পারবে না। তিনি ক্ষমতায় এসে দুটি পদ্মা সেতু করবেন। খুবই ভালো কথা। বাংলাদেশের মানুষ দুটি পদ্মা সেতু পাবে। এর চেয়ে আনন্দের খবর আর কী হতে পারে?
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির নেত্রী আওয়ামী লীগের ওপর তাঁর রাগ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ পরিবারের ওপর ঝাড়লেন কেন? খালেদা কারও নাম না নিয়ে বলেছেন, ‘তিনি স্বাধীনতা চাননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।’ এই তিনি কে, স্পষ্ট না করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিএনপির নেত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই ইঙ্গিত করেছেন। শেখ মুজিব যদি স্বাধীনতা না চেয়ে থাকেন, স্বাধীনতাটা এল কীভাবে? একাত্তরের ১ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ কার নির্দেশে চলেছে—শেখ মুজিব না পাকিস্তান বাহিনীর? জিয়াউর রহমান কার নামে ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন? একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় যে সরকারটি গঠিত হয়েছিল, সেটিই বা কার নেতৃত্বে?
খালেদা জিয়া সেদিন যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে সমাবেশ করেছিলেন, তাঁদের বর্তমান অবস্থান যাই হোক না কেন, তাঁরাও স্বীকার করবেন শেখ মুজিবের নামেই তাঁরা যুদ্ধ করেছেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চাইলে পাকিস্তানি শাসকেরা কেন তাঁকে কারাগারে রাখবে? কেন দেশদ্রোহের অভিযোগে ফাঁসির দণ্ড দেবে? সেই দণ্ড ইয়াহিয়া খান কার্যকর করতে পারেননি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায়। একাত্তরে জিয়াউর রহমান যে সেক্টর কমান্ডার ও পরে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, সেটিই বা কোন সরকারের অধীনে? বিএনপির চেয়ারপারসন যেভাবে এ কে খন্দকার ও শারমীন আহমদের বইয়ের ব্যাখ্যা করেছেন, সেটিও সঠিক নয়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু কোন প্রকৌশলীর সহায়তায় খুলনা থেকে আনা একটি ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছিলেন, শারমীন আহমদের বইয়ে তার বিস্তারিত বিবরণ আছে। শুনে নয়, বইটি পড়েই তাঁর কথা বলা উচিত ছিল।
তাই খালেদা জিয়াকে বলব, আজকের রাজনৈতিক বিবাদে একাত্তরকে টেনে আনবেন না। শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁদের পরিবারকে অপমান এবং মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করবেন না। আপনার এসব বক্তব্য স্বাধীনতার বিরোধীদের খুশি করলেও ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের স্বজনদের। আপনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৩২ বছর ধরে বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কখনোই শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। আজ কেন তুলছেন? সেদিনের সভায়ও আপনি বলেছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচার আপনারাও চান, তবে সেটি আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে। তাহলে ক্ষমতায় থাকতে কেন সেই বিচার করলেন না? আপনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগও নাকি রাজাকারের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিল। তাহলে সেই রাজাকারের বিচার করলেন না কেন? আপনি দ্বিতীয়বার যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে সরকার গঠন করলেন। আর প্রথমবার জামায়াতের নেতা গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ যে ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক গণ–আদালত গঠন করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহ মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন।
একাত্তরকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা কোনোভাবেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা কিংবা বাস্তববোধের প্রতিফলন হতে পারে না। যে কথাগুলো এত দিন পরাজিত পাকিস্তানের জেনারেল, আমলা, সেখানকার লেখক, বুদ্ধিজীবীরা বলতেন, সেই কথা বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেত্রী করতে পারেন না বলেই আমাদের মনে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল। অথচ খালেদা জিয়া সেটাই করেছেন। তাও এই বিজয়ের মাসে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশে দুই রাজনীতিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সরকার ও রাজনৈতিক মহল যেসব মন্তব্য করেছে, তা ছিল খুবই উসকানিমূলক। এর মাধ্যমে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান নিজেদের অপরাধই শুধু আড়াল করছে না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধটাকেও তারা অস্বীকার করছে।
কিন্তু বিএনপির মতো একটি জনপ্রিয় দলের নেত্রী কী করে তাদের কথায় সুর মেলালেন? তিনি বলেছেন, ‘আজকাল বলা হয় এত লাখ লোক শহীদ হয়েছেন।’ এটি কি আজকাল বলা হওয়ার বিষয়? মুক্তিযুদ্ধে কত মানুষ শহীদ, কত নারী ধর্ষিত হয়েছেন, কত মানুষ নির্যাতিত ও দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, কত পরিবার সবকিছু হারিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পর সে সবের একটি সরকারি ভাষ্য প্রকাশ করা হয়, যা আজ ইতিহাসের অংশ। কিন্তু এও সত্য যে নয় মাস ধরে পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের যে অপরিমেয় ক্ষতি, তা কোনো পরিসংখ্যানেই তুলে আনা সম্ভব নয়। পরাজিত পাকিস্তান শুরু থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের হাতে নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা কমিয়ে দেখাতে উঠেপড়ে লেগে যায়। খ্যাতনামা পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মির কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ সফরকালে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা যে ভাড়াটে লেখকদের দিয়ে মনগড়া ইতিহাস লেখাচ্ছে, তা অকপটে স্বীকার করেছেন। এদের মধ্যে কোনো কোনো গবেষক নাকি ডাবল এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের এই সব অপপ্রচারের জবাবে একটি কথাই বলব, মিথ্যে দিয়ে কখনো সত্যকে আড়াল করা যায় না, সত্যের জয় হবেই।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা, অনেক কাহিনি এখনো অনুদ্ঘাটিত। অনেকে চুয়াল্লিশ বছর পরও হারিয়ে যাওয়া স্বজনের অপেক্ষায় আছেন। সেই স্বজনহারা মানুষদের কী বার্তা দিলেন খালেদা জিয়া?
ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান বলেছেন, কিছু কিছু জাতীয় বিষয় আছে যা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে না। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতের মতো শহীদের সংখ্যা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে খালেদা জিয়া নিজের মর্যাদা ও সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর মতে, শহীদের সংখ্যাটি কারও রান্নাঘরের আলোচনার বিষয় নয়, যে তার ওপর আপনি প্রশ্নচিহ্ন বসিয়ে দিতে পারেন। তাঁর এই মন্তব্য পাকিস্তান ও দালালদের স্বার্থ হাসিল করবে।
শহীদের সংখ্যা নিরূপণের সর্বজন স্বীকৃত পদ্ধতির কথা উল্লেখ করে এম এ হাসান বলেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী পক্ষ দাবি করেছে নাৎসি বাহিনী ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছে, নাৎসি বাহিনীর আইনজীবীরা এটিকে অতিরঞ্জিত বললেও তা গ্রাহ্য হয়নি। ইতিহাসের বিকৃতি রোধে ১৪টি ইউরোপীয় দেশ গণহত্যা অস্বীকার আইন অনুমোদন করে, যাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা অস্বীকারকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাটিও নিরূিপত হয়েছে অনেক আগেই। এ নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তোলা বা প্রশ্ন করার সুযোগ নেই।
তাই মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপির নেত্রী যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অযাচিত প্রশ্ন রেখেছেন, আশা করি, সেটি তিনি প্রত্যাহার করে নেবেন। অন্যথায় সমালোচেকরা ‘পাকিস্তানিেদর খুশি করতে তিনি এই মন্তব্য করেছেন’ বলে যে অভিযোগ এনেছেন, সেটাই সত্য বলে মানুষ ধরে নেবে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.